শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে কী প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে

Bangladesh Unrest After Sheikh Hasina Death Sentence: দুপুরে রায় ঘোষণার কিছু পরেই বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে একটি আনন্দ মিছিল বের করেন।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষিত হওয়ার পর রাজধানী ঢাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। রায়কে কেন্দ্র করে সারাদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধানমন্ডি পর্যন্ত নানা স্থানে বিক্ষোভ, আনন্দ মিছিল, সংঘর্ষ ও বিবৃতি ঘিরে রাজনৈতিক তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়েছে।

দুপুরে রায় ঘোষণার কিছু পরেই বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে একটি আনন্দ মিছিল বের করেন। শিক্ষার্থীদের দাবি, গণঅভ্যুত্থানে নিহত সহপাঠী ও সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের পথে এটি 'একটি বিরল ও ঐতিহাসিক মাইলফলক'। ক্যাম্পাসজুড়ে তাঁরা স্লোগান দিতে দিতে ঘুরে বেড়ান।

এদিকে ধানমন্ডি-৩২ নম্বর এলাকায়, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুরনো বাড়ির অবশিষ্ট অংশ রয়েছে, সেখানে রায়কে ঘিরে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে উত্তপ্ত। দুপুর থেকেই পুলিশ ও একদল বিক্ষোভকারীর মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। প্রথম উত্তেজনার সূত্রপাত হয় দুপুরের দিকে; কয়েকজন মানুষ দু'টি বুলডোজার নিয়ে ধানমন্ডি-৩২ এ প্রবেশের চেষ্টা করে। পুলিশ বাধা দিলে তাঁরা নিজেদের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মী বলে পরিচয় দেন। পুলিশরা বলেন, দেশের প্রচলিত আইনে ওই বাড়ির ইতিহাসবহুল স্থাপনা ভাঙার অনুমতি নেই, তাই বুলডোজারকে তাঁরা থামিয়ে দেন।

আরও পড়ুন

ঠিক কোন কোন অভিযোগে শেখ হাসিনা মৃত্যুদণ্ড পেলেন

এর কিছুক্ষণ পর আবারও বিক্ষোভকারী দলটি সংগঠিত হয়ে শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাঁদের ধাওয়া করে। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়েন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হন। দিনভর শহরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ, সড়কে টহল, বাধা, গ্রেফতার— সব মিলিয়ে সারাদিনই ঢাকায় একটি উত্তেজনাপূর্ণ আবহ বজায় ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ আগেই ‘কমপ্লিট লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। এর ধারাবাহিকতায় রবিবার (১৬ নভেম্বর) রাত থেকেই ঢাকা-সহ কয়েকটি শহরে ককটেল বিস্ফোরণ, বাস ও দোকানে আগুন, মশাল মিছিল-সহ নানান অরাজকতার ঘটনা ঘটে। ঢাকার সড়কে যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিক দিনের তুলনায় বহুগুণ কম। আদালত এলাকায় ছিল সেনা টহল, পাশাপাশি রাজধানীতে বিজিবি(Border Guard Bangladesh)ও মোতায়েন করা হয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতি দেয়, “আবেগ নয়, সংযম প্রয়োজন”। রায় ঘোষণার পরই অন্তর্বর্তী সরকার একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড 'ঐতিহাসিক'। সরকার জনগণকে শান্ত ও সংযত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলে, রায়-পরবর্তী আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা, সহিংসতা বা আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড বরদাস্ত করা হবে না। বিবৃতিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদদের পরিবারের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা এই রায়ের মাধ্যমে পূরণ হলেও জনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারী কোনো আচরণ কঠোরভাবে দমন করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিক্রিয়া

রাতে এক পৃথক বিবৃতিতে দেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “ক্ষমতার অবস্থান যা-ই হোক, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এই রায় আবারও সেটি প্রমাণ করেছে।” তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের আদালত আজ এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছে যা বিশ্বেও প্রতিধ্বনি তুলবে। তাঁর মতে, এটি জুলাই-অগাস্ট ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে নিহত মানুষদের প্রতি ন্যায়বিচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন। একই সঙ্গে তিনি জোর দেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠনের উপর।

আওয়ামী লীগ রায় প্রত্যাখ্যান

সরকারি আদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ রায়টিকে 'পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' বলে উল্লেখ করেছে। শেখ হাসিনাও রায়টিকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।

দণ্ডাদেশ কার্যকর করতে ভারত সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান ভারতে অবস্থান করায় রায় কার্যকর করতে তাঁদের হস্তান্তর অত্যাবশ্যক। ভারতের তরফে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ এবং সব পক্ষের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করবে।

আরও পড়ুন

৬ মাসেই পদত্যাগ! কেন বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে?

বিএনপি প্রতিক্রিয়া: বিএনপি-র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, অপরাধের তুলনায় সাজার মাত্রা যথেষ্ট নয়, কিন্তু এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি শিক্ষা।

জামায়াতে ইসলামী প্রতিক্রিয়া: তারা বলেছে, তাদের নেতাদের অতীতের বিচার ছিল 'মিথ্যাচারের ইতিহাস', আর আজকের রায় 'স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও প্রশ্নাতীত'।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিক্রিয়া: দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “যেদিন রায় কার্যকর হবে সেদিনই আমরা সন্তুষ্ট হব। আগামী এক মাসের মধ্যে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে হবে।” নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, “জুলাই বিপ্লবের শহীদদের আত্মা শান্তি পাওয়ার জন্য, আহত যোদ্ধাদের ন্যায়বিচারের জন্য এই রায় কার্যকর হওয়া জরুরি।” নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, “জুলাই বিপ্লবের শহিদের আত্মা শান্তি পাওয়ার জন্য, আহত যোদ্ধাদের ন্যায়বিচারের জন্য এই রায় কার্যকর হওয়া জরুরি।”

রাষ্ট্রীয় আইনজীবীর প্রতিক্রিয়া : শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মোহাম্মদ আমির হোসাইন জানান, তিনি রায়ে 'ব্যথিত', তবে শেখ হাসিনা আত্মসমর্পণ না করলে বা গ্রেফতার না হলে আপিল করা সম্ভব নয়।

রায় ঘোষণার পর সারাদেশে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, তা প্রমাণ করে সমাজের ভিতরে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, ক্ষত ও বিভাজন কতটা গভীর ছিল। একদিকে আনন্দ মিছিল, অন্যদিকে সংঘর্ষ— দুইয়ের মধ্য দিয়ে দেশটি আজ এক অনিশ্চিত পথে দাঁড়িয়ে। আর ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত আনার প্রশ্নটি হয়ত আগামী দিনের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হবে। সব মিলিয়ে, রায়টি ন্যায়বিচারের নতুন অধ্যায় শুরু করলেও দেশের শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক স্থিতি ও সামাজিক নিরাপত্তা এখন এক কঠিন পরীক্ষার মুখে।

More Articles