শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাবে ভারত?
Sheikh Hasina Death Sentence: বাংলাদেশ গত বছরের ডিসেম্বরে প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইতে ভারতকে ‘ভার্বাল নোট’ পাঠায়। তবে ভারত এরপর থেকে সে বিষয়ে আর একটি শব্দও বলেনি।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করার তিন ঘণ্টার মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় জানায়, রায়টি তাদের নজরে এসেছে। তবে বিবৃতিতে আদালতের নামটি উদ্ধৃতি চিহ্নে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়— এই ট্রাইব্যুনালের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভারত সম্ভবত সম্পূর্ণ একমত নয়। সেই সঙ্গে ভারত মনে করিয়ে দিয়েছে, ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থেই তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। দিল্লির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও বিবিসিকে স্পষ্ট বলেছেন, এই রায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের অবস্থান বদলাচ্ছে না, এবং তাঁকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার প্রশ্নও উঠছে না। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতিকে কীভাবে দেখছেন বিশ্লষেকেরা তা বোঝা জরুরি।
৫ অগাস্ট ২০২৪-এ শেখ হাসিনা ভারতে প্রবেশের পর থেকে তাঁকে ‘সাময়িক আশ্রয়’ দেওয়া হয়, প্রথম থেকে এটাই ছিল ভারতের ঘোষিত অবস্থান। সাম্প্রতিক রায় ঘোষণার পরও সেই অবস্থানে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, তাঁকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত বা ভারতে রাখার নীতি পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা এখনও নেই। তবে প্রশ্ন হলো, প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে বাংলাদেশের অনুরোধের কী হবে?
বাংলাদেশ গত বছরের ডিসেম্বরে প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইতে ভারতকে ‘ভার্বাল নোট’ পাঠায়। তবে ভারত এরপর থেকে সে বিষয়ে আর একটি শব্দও বলেনি। কেন দিল্লি তখন অনুরোধ মানতে রাজি হয়নি? ভারতের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তখনই আভাস দিয়েছিলেন চুক্তিতে এত ফাঁকফোকর আছে যে চাইলে ভারত অনায়াসেই এই অনুরোধ নাকচ করতে পারে, অথবা বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখতে পারে। ভার্বাল নোট পাঠানোর সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়নি, বিচার প্রক্রিয়াও প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক হত্যা মামলা, আদালত প্রাঙ্গণেই সাবেক মন্ত্রীদের উপর হামলার ঘটনা দেখিয় ভারত বলেছিল, তাঁকে ফেরত পাঠালে ন্যায়বিচার পাওয়া নিশ্চিত নয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ঝুঁকিই ছিল ভারতের প্রধান উদ্বেগ। তবে এখন ডিসেম্বরের তুলনায় পরিস্থিতি বদলেছে; শেখ হাসিনা এখন গণহত্যার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত। ফলে কেন ভারত একজন দণ্ডিত পলাতককে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে— এ প্রশ্নে দিল্লির উপর চাপ বাড়ছে। শিগগিরই ভারতকে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দিতে হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ব্যাখ্যা যাই হোক, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের পাঠিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আরও পড়ুন
হাসিনার বিচার নিয়ে কী বক্তব্য আওয়ামী লীগের?
২০১৩ সালের বাংলাদেশ-ভারত প্রত্যর্পণ চুক্তিতে বলা আছে, যদি অভিযোগ ‘রাজনৈতিক প্রকৃতি’র হয়, অনুরোধ খারিজ করা যাবে। কিন্তু হত্যা, গুম, সন্ত্রাসবাদ-সহ অনেক অভিযোগকে রাজনৈতিক বলা যাবে না। শেখ হাসিনার মামলাগুলোতে হত্যা, গণহত্যা, গুম, নির্যাতনের অভিযোগ থাকায় এই ধারা ব্যবহার কঠিন। তবে ২০১৬ সালে সংশোধিত চুক্তিতে একটি সুবিধাজনক ধারা যুক্ত হয়; গ্রেফতারি পরোয়ানা পেলেই অনুরোধ বৈধ ধরা হবে, প্রমাণ দিতে হবে না। তারপরও ভারত অনায়াসে কয়েকটি যুক্তি ব্যবহার করতে পারে। প্রথমত, অভিযোগগুলো ন্যায়বিচারের স্বার্থে আনা হয়নি। চুক্তিতে বলা আছে, যদি অনুরোধপ্রাপ্ত দেশ মনে করে অভিযোগ 'সরল বিশ্বাসে আনা হয়নি', তারা প্রত্যর্পণ নাকচ করতে পারে। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত সহজেই দাবি করতে পারে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত নয়, তাই হস্তান্তর সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, অভিযোগ সামরিক অপরাধের আওতায় পড়লেও প্রত্যর্পণ খারিজ করা যায়।
সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ীর মতে,
"ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত ফরমাল। বর্তমান বিজেপি সরকার এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যম এই বিবৃতি নিয়ে উত্তেজিত। কিন্তু সরকারী বিবৃতি ছিল মাপা ও সতর্ক।"
তাঁর মতে, বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে বিবৃতিতে ভারত জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলেবে। অর্ক ভাদুড়ীর প্রশ্ন, এই ‘স্টেকহোল্ডার’-এর মধ্যে কি আওয়ামী লীগও অন্তর্ভুক্ত? যদি তা-ই হয়, তাহলে ভারত কি পরোক্ষভাবে বোঝাতে চাইছে যে তারা শুধু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নয়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে? এই দিকটি নজরে রাখা জরুরি, বলে মন্তব্য করেন তিনি। অর্ক ভাদুড়ী আরও স্পষ্ট করে বলেন,
"রায় ঘোষণা হওয়া এবং তা বাস্তবায়নের মধ্যে অনেকটা ব্যবধান রয়েছে।"
কারণ, অভিযুক্ত বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতেই অবস্থান করছেন এবং ভারত তাঁকে প্রত্যর্পণের কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। তাই দিল্লির এই বিবৃতি প্রকৃত অর্থেই একটি ভারসাম্য রক্ষার কূটনৈতিক অবস্থান। তাঁর মতে,
"এখন নজর রাখার বিষয় দু'টি— বাংলাদেশ সরকার শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার জন্য কী ধরনের নতুন পদক্ষেপ নেয়, এবং ভারত সেই পদক্ষেপগুলোর উত্তরে কী অবস্থান গ্রহণ করে।"
আরও পড়ুন
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে কী প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে
সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের মতে,
"ভারতের প্রতিক্রিয়া এক ধরনের ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’— না খুব জোরালভাবে শেখ হাসিনার পক্ষে, না আবার তাঁর বিরুদ্ধে।"
তাঁর বক্তব্য,
"ভারতের এই অবস্থান বাংলাদেশের কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।"
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন,
"২০২৩ সালের শেষের নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধীরা আশা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও বাংলাদেশের উপর চাপ দেবে। কিন্তু তখন ভারত সাফ জানিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পূর্ণ 'অভ্যন্তরীণ বিষয়', সে বিষয়ে তাদের কিছু বলার নেই। ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে ধারণা তৈরি হয়েছিল যে ভারত ইচ্ছে করেই নির্বাচন ইস্যুতে দূরত্ব বজায় রেখেছে, এবং সেই আস্থার উপর ভর করেই নির্বাচন কমিশন ভোট আয়োজন এগিয়ে নেয়।"
স্নিগ্ধেন্দুর মতে, এখন পরিস্থিতি উল্টো। তিনি বলেন,
"শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই ভারত আবার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে।"
তাই প্রশ্ন উঠছে, যখন নির্বাচন ইস্যুতে ভারত সম্পূর্ণ নীরব ছিল, এখন কেন তারা এত সক্রিয়? তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিবৃতি তাই একই সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ আবার সতর্ক কারার মতোও। তাঁর কথায়, ভারত সরাসরি বলেনি যে তারা রায়কে সম্মান করে তাঁকে ফেরত পাঠাবে, আবার এটাও বলেনি যে তারা হাসিনাকে রক্ষা করবে বা রায়কে অস্বীকার করছে। অর্থাৎ, ভারতের অবস্থান হলো, স্পষ্ট সমর্থন নয়, স্পষ্ট বিরোধিতাও নয় মাঝামাঝি অবস্থান; যাতে দু'পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখা যায়। স্নিগ্ধেন্দুর কথায়, এই দ্বৈত কূটনীতি—
“ধরি মাছ, না ছুঁই পানি”,
সেটাই এখন দিল্লির নীতি।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতেও বড় ধরনের চাপ ও সংকট তৈরি করেছে। ভারত প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখলেও বাস্তবে দিল্লি কঠিন এক সমীকরণের সামনে— একদিকে নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশের নতুন সরকারের প্রত্যর্পণ দাবি, অন্যদিকে দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্ক ও ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হিসাব। প্রত্যর্পণ চুক্তির আইনি ফাঁকফোকর এবং ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা নেই, যুক্তি ভারতকে এখনও স্বস্তির জায়গা দিচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনা দণ্ডিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও বাংলাদেশ সরকারের চাপ বেড়েছে— ভারতকে শিগগিরই স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে কেন একজন দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক নেত্রীকে তারা আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। তবুও বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, ব্যাখ্যা দিতে হলেও ভারত তার মূল অবস্থান থেকে সরে আসবে না। অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে ভারতের মাটি থেকে ঢাকার হাতে তুলে দেওয়ার সম্ভাবনা এখনো অত্যন্ত ক্ষীণ। পরবর্তী দিনগুলোতে এই ইস্যু দুই দেশের সম্পর্কের উপর নতুন উত্তেজনা ও সন্দেহের আবহ তৈরি করলেও, দিল্লি আপাতত 'সাময়িক আশ্রয়' নীতিই ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর— এটাই পরিস্থিতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।

Whatsapp
