১৯৮৩ থেকে ২০১৮: কেন বারবার আটক খালেদা জিয়া?
Khaleda Zia’s Arrests and Political Targeting: ১৯৮৩, ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ সালে খালেদা জিয়াকে তিনবার গৃহবন্দি করা হয়। তখন বিএনপি ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি, আর খালেদা জিয়া ছিলেন বিরোধী জোটগুলোর ঐক্যের মুখ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়াকে ঘিরে প্রতিটি রাজনৈতিক টানাপোড়েন, প্রতিটি বিতর্ক, প্রতিটি মোড় নেওয়া ঘটনা নতুন মাত্রা পায়। দু'বারের প্রধানমন্ত্রী, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিএনপির নেতৃত্বে থাকা এই নেত্রী বারবারই রাজপথ, আদালত ও জেলে লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাপ, দুর্নীতি মামলায় কারাদণ্ড, স্বাস্থ্যের অবনতির মাঝেও তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন। তাঁর গ্রেফতার ও পুনরায় রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসার প্রতিটি অধ্যায়ই বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। জানা যাক, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক গ্রেফতার এবং পুনরায় রাজনীতিতে ফেরার প্রক্রিয়া।
খালেদা জিয়ার বন্দি জীবনের শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। তখন ‘গৃহবন্দি’ বা house arrest-এ ছিলেন। সরাসরি জেল না হলেও রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে দ্বিতীয়বার গৃহবন্দি করা হয়। তখনও রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং বিএনপির নেতৃত্বকে স্থিতিশীল রাখা সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ১৯৮৭ সালে তৃতীয়বার খালেদা জিয়া গৃহবন্দি হন। সেই সময় বাংলাদেশের রাজনীতি প্রচণ্ড উত্তপ্ত ছিল, এবং গণআন্দোলনের চাপ সামলাতে সরকারের পক্ষ থেকে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এই তিনবারের গৃহবন্দিতে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যক্রম সীমিত হলেও, তিনি দলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং গণমাধ্যমেও রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে থাকেন। এই সময়ে বিএনপি-এর নেতৃত্বের ভূমিকা বজায় রাখাটাই ছিল প্রধান লক্ষ্য।
১৯৮৩, ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ সালে খালেদা জিয়াকে তিনবার গৃহবন্দি করা হয়। তখন বিএনপি ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি, আর খালেদা জিয়া ছিলেন বিরোধী জোটগুলোর ঐক্যের মুখ। বিশ্লেষকরা বলেন, এই সময় তাঁর গৃহবন্দি হওয়ার প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন দমন এবং বিরোধী নেতৃত্বকে নেতৃত্বহীন করা। খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক ভূমিকা থেকে দূরে রাখতেই নাকি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন
মায়ের সঙ্কটেও দেশে ফিরলেন না তারেক রহমান! বাংলাদেশ ফিরতে বাধা কোথায়?
১৯৮০-এর দশকের গৃহবন্দির পর, খালেদা জিয়ার জীবনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক মোড় আসে ২০১৮ সালে। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে, খালেদা জিয়াকে নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারে নেওয়ার রায় ঘিরে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তীব্র হয়। রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে জেলে যেতেই হবে। তাঁর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার বয়সের বিবেচনায় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারেই তাঁকে রাখা হবে। রায় ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই খালেদা জিয়াকে ওই পুরনো কারাগার ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে বহুদিনের আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন অভিযোগ করেছিলেন,
‘‘নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ফরমায়েশি রায় দেওয়া হয়েছে।’’
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ রায়ে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ছিল না। তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের দণ্ড যথেষ্ট নয়। দুদকের আইনজীবীরাও জানিয়েছিলেন, তারা মামলায় খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চেয়েছিলেন। তবে আদালত তাঁর বয়স, সামাজিক অবস্থান ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে পাঁচ বছরের দণ্ড দেয়। রায়টি ছিল ৬৩২ পৃষ্ঠার।
এতিম তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা দায়ের হয় ২০০৮ সালের ৩ জুলাই। দুদকের অভিযোগ, সৌদি আরবের ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় ১২.৫৫ লাখ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকারও বেশি প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের জন্য আসে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে খালেদা জিয়া ওই অর্থ দেশের কোনো বিদ্যমান এতিমখানায় না দিয়ে অস্তিত্বহীন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করেন। তহবিল পরিচালনার কোনো নীতিমালা বা জবাবদিহির ব্যবস্থা তিনি করেননি। পরে এতিম তহবিল থেকে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা ওই ট্রাস্টে স্থানান্তর করা হয় এবং তা আত্মসাৎ করা হয়। অভিযোগে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় 'অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ' ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার কথা উল্লেখ করা হয়। ২০১০ সালের ৫ অগাস্ট দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক হারুন অর রশীদ ছ'জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন। এরপর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠন করা হয়।
এই মামলার আসামিরা হলেন, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, প্রাক্তন এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রাক্তন মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। ৩২ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ও যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার দিন ধার্য হয়েছিল ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ ভোট জালিয়াতি! কীভাবে টিকে ছিল দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন?
২০২০ সালে, করোনা মহামারির কারণে সরকার খালেদা জিয়ার জন্য শর্তসাপেক্ষ মুক্তির ব্যবস্থা করে। তবে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছিল, বিদেশে যেতে পারবেন না এবং ঘর থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। এই সময়ে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যক্রম সীমিত থাকলেও, দলের কার্যক্রমে দূর থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ ছিল। মুক্তির পরও তাঁর বিরুদ্ধে আপিলের প্রক্রিয়া চলছিল।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে, যদি কেউ নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দু'বছরের বেশি সাজা পান এবং মুক্তির পাঁচ বছরের মধ্যে নির্বাচন হয়, তাহলে তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে আদালতের রায় যদি আপিলে স্থগিত হয়, তাহলে এই বিধি প্রযোজ্য হয় না। এই কারণে বিএনপি আশাবাদী ছিল যে, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন আপিলের মাধ্যমে সচল রাখা সম্ভব।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের জন্য চ্যালেঞ্জ। ১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৭ সালে গৃহবন্দি এবং ২০১৮ সালে কারাগারে পূর্ণাঙ্গ সাজা, ৪টি গ্রেফতারই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খালেদা জিয়ার গ্রেফতার-মুক্তি ও পুনরায় রাজনীতিতে ফেরা এই বিষয়গুলি বাংলাদেশের ক্ষমতার কাঠামো, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। ১৯৮০-এর দশকের গৃহবন্দি থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় কারাদণ্ড— প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী নেতার শক্তি দমনে রাষ্ট্রের কৌশল কেমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে তা আরও স্পষ্ট করে দেয়। আবার অন্যদিকে, প্রতিটি আটক-মুক্তির পর খালেদা জিয়ার প্রত্যাবর্তনও প্রমাণ করে তিনি এখনও বিএনপির রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, এবং তাঁর অনুপস্থিতি বা উপস্থিতি উভয়ই দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে সরাসরি প্রভাবিত করে।

Whatsapp
