মায়ের সঙ্কটেও দেশে ফিরলেন না তারেক রহমান! বাংলাদেশ ফিরতে বাধা কোথায়?
Tarique Rahman Still Cannot Return to Bangladesh: দলের নীতিগত অবস্থান না বদলালে তারেক ফিরতে পারবেন না, এমন ইঙ্গিত করছেন বিশ্লেষকরা। ফেরার আগে ব্রিটেনের অনুমতি লাগবে, এটিও একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মায়ের জীবন-মৃত্যুর সঙ্কটেও বাংলাদেশে ফিরতে পারছেন না বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অথচ তিনি নিজেই বলেছিলেন,
“দ্রুতই দেশে ফিরব, নির্বাচনে অংশ নেব।”
কিন্তু নভেম্বর শেষ হওয়ার মাত্র এক দিন আগে মায়ের অসুস্থতার মধ্যে ফেসবুকে লিখলেন,
“দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ আমার একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।”
কেন নিজের দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত তিনি নিজে নিতে পারছেন না? সেই সিদ্ধান্তের রিমোট কন্ট্রোল কার হাতে?
সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন,
“তারেক রহমানের স্ট্যাটাসেই সব ব্যাখ্যা আছে, আর কিছু বলার নেই।”
দলও কেবল নীরব ইঙ্গিত দিল। এরই কয়েক ঘণ্টা পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ঠিক উল্টো বার্তা দিলেন,
“সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।”
ফলে আরও প্রশ্ন ঘনীভূত হলো, যদি সরকার বাধা না দেয়, আইনি জটিলতা না থাকে, নিরাপত্তার প্রস্তুতিও থাকে তাহলে সমস্যা কোথায়?
অক্টোবরেই বিবিসি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছিলেন,
“দ্রুতই দেশে ফিরব, নির্বাচনে অংশ নেব।”
দলের অন্দরে তখন বলা হচ্ছিল, তিনি নভেম্বরেই ফিরছেন। কিন্তু নভেম্বরের শেষে এসেও তিনি জানালেন, দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের নয়। এমন অবস্থায় জল্পনা আরও তীব্র হওয়াই স্বাভাবিক। তাহলে কি বিদেশি থেকে আপত্তি? নেপথ্যে আসলে কারা?
আরও পড়ুন
৬ মাসেই পদত্যাগ! কেন বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে?
বিএনপির ঘনিষ্ঠ কিছু জন বলছেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরায় প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু কোন দেশ? কেনই বা আপত্তি জানানো হচ্ছে? এ নিয়ে দলীয় কেউই মুখ খুলছেন না। তবে বলে রাখা জরুরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারেক রহমানের সম্পর্কের জট উইকিলিকসের প্রতিবেদনে সামনে এসেছিল। বিশ্লেষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি যে বহুলাংশে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল, এটি বলাই বাহুল্য। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের নীতির পরিবর্তন ছাড়া তারেকের দেশে ফেরা অসম্ভব।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে গ্রেফতার হন তারেক রহমান। সে সময় তিনি যে কঠোর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ছিলেন তা শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচিত হয়েছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন বই, বিশেষভাবে মওদুদ আহমদের ‘কারাগারে কেমন ছিলাম (২০০৭-০৮)’ স্পষ্টই ইঙ্গিত দিয়েছে, তারেক রহমান হয়ত রাজনীতি থেকে বিরত থাকার মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন। তিনি লন্ডনে যান ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এবং ঠিক সেই দিনই তিনি দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব পদ থেকেও পদত্যাগ করেন। প্রশ্ন উঠছে, এই মুচলেকার মেয়াদ কি এখনও শেষ হয়নি? যদি শেষও হয়, তিনি কি বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সম্মতি পাচ্ছেন না?
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৫ মাস কেটে গিয়েছে। এ সময়ে তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী জুবাইদা রহমান সব মামলা থেকে আইনি অব্যাহতি পেয়েছেন। নিরাপত্তার জন্য বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনা এবং অস্ত্র লাইসেন্সের আবেদন সবই প্রকাশ্যে এসেছে। কাগজে-কলমে ফেরার বাধা নেই কিন্তু বাস্তবে আছে অদৃশ্য কিছু শর্ত যেন এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সম্প্রতি এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
“দুই দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনে বিদেশ থেকে খেলা চলছে”
এই বক্তব্য আবারও আলোচনায় এনেছে মাইনাস টু ফর্মুলাকে। বাংলাদেশে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে সরিয়ে দেওয়ার যে উদ্যোগের কথা শোনা গিয়েছিল, সেটিই রাজনৈতিক পরিসরে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ নামে পরিচিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাস্তবে লক্ষ্য ছিল আরও বড় ‘মাইনাস ফোর’। তাঁদের ব্যাখ্যায়, দুই রাজনৈতিক পরিবারের দীর্ঘদিনের আধিপত্য ভাঙতেই মূল পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর মধ্যে এক পরিবারের (শেখ হাসিনা পরিবার) নেতৃত্ব ইতোমধ্যেই বাদ গিয়েছে; অপরদিকে খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ থাকায় কার্যত সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছেন না। ফলে ফোকাস এখন পড়ে তারেক রহমানের উপর। তিনি দেশে ফিরতে পারবেন কি না এবং সেই অনিশ্চয়তা শেষ পর্যন্ত ‘মাইনাস ফোর’ পরিস্থিতিতে পৌঁছাবে কি না— তা সময়ই নির্ধারণ করবে। তারেকের দেশে ফেরার দেরি কি শেষ পর্যন্ত ‘মাইনাস ফোর’-এরই ধারাবাহিকতা?
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে বিবিসি-কে বলেছেন, “দলের বিষয় আছে, আরও অনেক বিষয় আছে, সব মিলিয়েই দেরি।” অন্যদিকে কয়েকজন নেতারা আবার জানিয়েছেন, “তফসিল হলে পরিস্থিতি যেমনই হোক তিনি ফিরবেন।” অর্থাৎ দলেরও কোনো স্পষ্ট রোডম্যাপ নেই। যেন সবাই অপেক্ষা করছে দেশ-বিদেশের সমীকরণ ঠিক হওয়ার।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ ভোট জালিয়াতি! কীভাবে টিকে ছিল দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন?
২০০১-২০০৬ সালে ‘হাওয়া ভবন’ ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে ওঠা, সেই সময়ের নানা বিতর্ক, ওয়ান-ইলেভেনের পর গ্রেফতার এই সমস্ত কিছু আন্তর্জাতিক স্তরে তারেক রহমানকে নিয়ে বিতর্কিত ভাবমূর্তি তৈরি হয়। উইকিলিকস ফাঁস হওয়া মার্কিন কূটনৈতিক প্রতিবেদনে তাঁকে 'অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত' বলে বর্ণনা করা হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও কঠোর করে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লন্ডনে তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি। আশ্রয় পাওয়ার অর্থই হলো ব্রিটিশ সরকারের সামনে কিছু নির্দিষ্ট শর্তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা, বিশেষত দেশে ফেরার ব্যাপারে। এখন প্রশ্ন হলো, সেই শর্তগুলি এখনও বলবৎ আছে কি না, নাকি বর্তমানে সেগুলোর পুনর্বিবেচনা চলছে?
বিএনপি বলেছে, মায়ের স্নেহস্পর্শ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁরও আছে। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর হাতে নেই— এর থেকেই বোঝা যায় বিষয়টি জটিল আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। মায়ের গুরুতর পরিস্থিতিতেও দেশে ফিরতে না পারা আসলে ইঙ্গিত দেয়, শেষ সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রণ সম্ভবত তাঁর নিজের হাতে নেই।
দলের নীতিগত অবস্থান না বদলালে তারেক ফিরতে পারবেন না, এমন ইঙ্গিত করছেন বিশ্লেষকরা। ফেরার আগে ব্রিটেনের অনুমতি লাগবে, এটিও একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যদিকে, ১/১১ সময়কার রাজনৈতিক চুক্তি এখনও প্রভাব ফেলতে পারে। দলও সব কার্ড একসঙ্গে খেলতে চাইছে না। বিশেষত নির্বাচন ঘিরে তাদের কৌশল বদলাচ্ছে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরা এখন বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ধাঁধাগুলোর একটি। বাংলাদেশের রাজনীতি বহুবার প্রমাণ করেছে যাঁর নিয়ন্ত্রণ দেখা যায় না, তাঁর প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে এখন ঠিক সেই অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণই আলোচনার কেন্দ্রে। তবে প্রশ্ন থাকছেই, লন্ডন, ওয়াশিংটন, দিল্লি— কাদের সম্মতিতে তাঁর দেশে ফেরা নির্ভর করছে? নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও কি সেই ‘সবুজ সংকেত’ মিলবে?

Whatsapp
