নথি যাচাই না করেই কেন ঘাড় ধাক্কা সোনালিদের? কেন্দ্রের কাছে জবাব চায় সুপ্রিম কোর্ট
Pregnant Indian Woman Sunali Khatun: আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, যাঁরা ভারতীয় নাগরিক হওয়ার দাবি করছেন, তাঁদের বক্তব্য না শুনে পুশব্যাক করা যায় না। পাশাপাশি, সোনালিদের দেশে ফিরিয়ে আনার দিকেও ইঙ্গিত দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
বাংলাদেশে পুশব্যাক বিতর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কড়া প্রশ্নের মুখে পড়েছে দিল্লি। বীরভূমের পাইকর এলাকার অন্তঃসত্ত্বা তরুণী সোনালি খাতুন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের কোনো শারীরিক যাচাইকরণ ছাড়াই বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) শুনানিতে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ কেন্দ্রকে তীব্র সমালোচনা করে। আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, যাঁরা ভারতীয় নাগরিক হওয়ার দাবি করছেন, তাঁদের বক্তব্য না শুনে পুশব্যাক করা যায় না। পাশাপাশি, সোনালিদের দেশে ফিরিয়ে আনার দিকেও ইঙ্গিত দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
প্রধান বিচারপতি সূর্যকান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ সোনালির নাগরিকত্বের পক্ষে পর্যাপ্ত নথি রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। বেঞ্চ জানায়, জন্মশংসাপত্র, পারিবারিক যোগাযোগ বা বসবাসের নথি— এসবই সরকারি প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত। আদালতের ভাষায়,
“বাংলাদেশ থেকে বেআইনি ভাবে কেউ ভারতে ঢুকলে পুশব্যাক করা যেতে পারে। কিন্তু যাঁরা ভারতের নাগরিক বলে দাবি করছেন, তাঁরা যেন অন্যায়ভাবে বিদেশে পাঠানো না হন— রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে।”
আদালত আরও নির্দেশ দেয়, আগামী ১ ডিসেম্বরের মধ্যে সমস্ত নথির পুনঃপরীক্ষা করতে হবে। বেঞ্চের কড়া ভাষায় মন্তব্য,
“নিরপেক্ষ তদন্ত করুন। পরিবারকে নিজেদের বক্তব্য রাখার পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে।”
আদালত আরও নির্দেশ দেয়, আগামী ১ ডিসেম্বরের মধ্যে সমস্ত নথির পুনঃপরীক্ষা করতে হবে।
গত জুনে দিল্লি থেকে আটক হওয়ার পর সোনালি খাতুন, তাঁর স্বামী দানিশ শেখ এবং আরও কয়েকজনকে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে পুশব্যাক করা হয় বলে অভিযোগ। সীমান্ত পেরোনোর পরই চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ তাঁদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে গ্রেফতার করে। সেই থেকেই সোনালিদের বন্দিজীবন শুরু। বর্তমানে সোনালি ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা, সঙ্গে রয়েছে তাঁর আট বছরের সন্তান। বাংলাদেশে সংশোধনাগারের ভেতরে দিন কাটাতে হচ্ছে তাঁদের।
আরও পড়ুন
আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা, বীরভূমের সোনালি খাতুনকে যেভাবে বাংলাদেশে ঘাড়ধাক্কা
পরিবারের দাবি অনুযায়ী, ১৮ জুন দিল্লির কে.এন. কাটজু মার্গ থানার পুলিশ ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে সোনালি, তাঁর স্বামী এবং আরও কয়েকজনকে আটক করে। তাঁরা জানান, কোনো তদন্ত বা নথি যাচাই ছাড়াই তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর হঠাৎই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে তাঁদের পুশব্যাক করা হয় বলে পরিবার অভিযোগ করে। সোনালির পরিবার দীর্ঘদিন দিল্লিতে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে ছিলেন। বাবা রিকশাচালক, মা ঘরোয়া কাজে যুক্ত— স্থায়ী বাড়ি বা স্থায়ী চাকরি কোনোটাই ছিল না। প্রশ্ন উঠছে, এই প্রান্তিকতার সুযোগেই তাঁদের ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে?
সোনালির বাবা ভদু শেখ ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতা হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস মামলাও দায়ের করেন। তিনি দাবি করেন, তাঁর মেয়ে ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আদালতে আইনজীবীরা জমির দলিল, ভোটার কার্ড, সোনালির সন্তানের জন্মসনদ-সহ একাধিক নথি জমা দেন। সব দিক বিবেচনার পর ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দেয় চার সপ্তাহের মধ্যে সোনালিদের ভারতে ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই, ২২ অক্টোবর কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। কেন্দ্র দাবি করে, দিল্লি পুলিশ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং FRRO— এদের মূল কার্যালয় দিল্লিতে, তাই মামলার শুনানিও দিল্লিতে হওয়া উচিত।
এই অবস্থাতেই বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে ওঠে এবং মঙ্গলবারের শুনানিতে বেঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকারের গড়িমসির তীব্র নিন্দা করে। আদালতের মন্তব্য,
“মানবাধিকার রক্ষা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। বিশেষ করে একজন গর্ভবতী নারীর নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীনতা গ্রহণযোগ্য নয়।”
পরিবারের উদ্বেগ আরও বেড়েছে এই কারণে যে, যদি সোনালির সন্তান বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেয়, তাহলে নবজাতকের নাগরিকত্ব কোন দেশের হবে? সোনালির নিজের নাগরিকত্ব নিয়েই যখন বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তখন সন্তানের আইনি মর্যাদা আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। আন্তর্জাতিক আইনে নাগরিকত্ব নির্ধারণে প্রতিটি দেশের নিজস্ব নিয়ম থাকে, ফলে দ্বিধা দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। মানবাধিকার সংগঠনগুলির বক্তব্য, এই পরিস্থিতিতে সোনালিকে অবিলম্বে ভারতে ফিরিয়ে আনা ছাড়া অন্য কোনো মানবিক সমাধান নেই।
আরও পড়ুন
অন্তঃসত্ত্বা সোনালি খাতুন বনাম ভারতরাষ্ট্র: পরিযায়ী শ্রমিকের যুদ্ধ চলছেই
দিল্লিতে কুড়ি বছর ধরে রিকশাচালক ও ঘরোয়া কাজ করে সংসার চালিয়েছেন সোনালির বাবা-মা। দারিদ্র্য ও অস্থায়ী জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে সন্তানদের মানুষ করেছেন। বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি বুঝলেও, ভারতের প্রতিক্রিয়া নীরব বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতীয় দূতাবাসে বারবার যোগাযোগ করা হলেও, ভারতীয় পক্ষের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে স্থানীয় সমাজকর্মীরা জানিয়েছেন। বাংলাদেশও চাইছে সোনালিদের যেন দ্রুত ভারতে পাঠানো হয়। অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার দেখছে আইনি লড়াইয়ের দিক। ফলে সোনালির দেশে ফেরার পথ আরও জটিল হয়ে উঠছে। প্রশ্ন উঠে আসছে, সোনালি কি শুধু একজন পরিযায়ী শ্রমিক হওয়াতেই অবহেলার শিকার? ভদ্রবিত্ত, শিক্ষিত, শহুরে কেউ হলে কি বিষয়টি এত দূর গড়াত? মিডিয়ার প্রাইমটাইমেও সোনালির নাম খুব একটা নেই। রাজনৈতিক দলগুলিও তেমন সক্রিয় নয়।
মানবাধিকার, নাগরিকত্ব এবং পরিযায়ী জীবনের অনিশ্চয়তা— এই তিনের জটিল মিশ্রণে সোনালির গল্প আজ রাষ্ট্রের বিবেককে প্রশ্ন করছে। একজন গর্ভবতী নারী বিদেশের কারাগারে পড়ে আছেন, কোনো নথি পরীক্ষা ছাড়াই তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে পুশব্যাক করা হয়েছে এই অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। এখন নজর ১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী শুনানির দিকে। সেখানে হয়ত ঠিক হবে, সোনালি খাতুন কবে ফিরবেন তাঁর নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে।

Whatsapp
