আওয়ামী লিগের শাটডাউন কর্মসূচী: কতটা প্রভাব পড়ল ঢাকায়?
Awami League’s Shutdown: শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান ট্রায়ালের রায় ঘোষণাকে সামনে রেখে পুরো বাংলাদেশে আবারও উত্তেজনা চরমে উঠেছে। রায়ের তারিখ যত এগিয়ে আসছে, দেশজুড়ে বাড়ছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন, বিক্ষোভ এবং অনিশ্চয়তা। এর মধ্যেই বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেছে দেশব্যাপী লকডাউন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি। তাদের দাবি— এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টার্গেট করেই এই মামলা সাজানো হয়েছে।
রায়ের আগে থেকেই ঢাকা-সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। অনেক স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। বাস, ট্রেন-সহ গণপরিবহণ কম চলছে। বেশ কিছু এলাকায় সকাল থেকেই রাস্তাঘাট ফাঁকা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ, র্যাব এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তাবেষ্টনী আরও আঁটসাঁট করা হয়েছে আদালত চত্বর ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে।
কেন এই মামলা? ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময় সহিংসতা ও দমনপীড়নের অভিযোগ ওঠে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT) অভিযোগ করে— নিরাপত্তা বাহিনী অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে, বহু বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে উঠে আসে শেখ হাসিনার নাম। রায় ঘোষণার আগে থেকেই তিনি ভারতে থাকছেন এবং বিচার প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নিচ্ছেন না।
আরও পড়ুন
২৬ বছর পর বাংলাদেশে ফিরছেন তারেক রহমান! ক্ষমতার কুর্সি অপেক্ষমান?
আওয়ামী লীগের অভিযোগ, “এটা আইনি নয়, প্রতিহিংসার রাজনীতি।” তাদের দাবি, বর্তমান সরকার একের পর এক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দিচ্ছে। সেই প্রতিবাদেই দলটি দেশজুড়ে লকডাউন, বিক্ষোভ এবং মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল-সহ বেশ কিছু জেলায় দলীয় নেতা-কর্মীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। কয়েক জায়গায় সংঘর্ষ, গাড়ি ভাঙচুর ও বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। সরকারের পাল্টা বক্তব্য, বিচার সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ায় চলছে। আদালতের স্বাধীনতা বজায় রয়েছে, কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা পক্ষপাত নেই।
যে কোনো রাজনৈতিক উত্তেজনার মতো এবারও এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের উপর। অফিসে যাওয়া মানুষজন রাস্তাঘাটে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বাজারে সরবরাহ কমে গিয়েছে এতে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। চিকিৎসা, শিক্ষা থেকে দৈনন্দিন যে কোনো কাজেই বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর রায় যদি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যায়, তবে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা করছে ওয়াকিবহাল মহল। রায় খারিজ হলে বিরোধীরা আন্দোলনে নামতে পারে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন, "৫ অগাস্টের পর এটি (শাট ডাউন) ছিল নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচি। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মাঝেও দলটি শাটডাউনকে বেশ সফল করতে পেরেছে— এটি একটি বড় বার্তা। তাঁর কথায়, “অভিযোগ রয়েছে গাড়ি-সহ বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগানোর ঘটনায় আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল, যদিও এসবের তথ্য প্রমাণ পাওয়া নাগরিকদের পক্ষে মুশকিল। শার্টডাউনের দিন মাঠে ওই দলের দৃশ্যমান উপস্থিতি কম হলেও বিরোধীরা সক্রিয় ছিল। এ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের উপস্থিতি জানান দিল; রাজনীতিতে যেন তাদের পুনরায় আবির্ভাব ঘটল।”
আরও পড়ুন
স্বধর্ম পালনের স্বাধীনতা বাংলাদেশে পুরোপুরি বিলোপ হয়ে যায়নি
কিন্তু মাঠে সক্রিয় না থেকেও শাটডাউন কীভাবে সফল হলো? আলতাফ পারভেজের ব্যাখ্যা, “বর্তমান সরকার জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। সেই হতাশা শাটডাউনকে কিছুটা সফল করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থান হচ্ছে, এর ফলেও আওয়ামী লীগ জনসমাজে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা পেল।” তাঁর মতে, আওয়ামী লীগের এই সক্রিয়তা কোনো আত্মসমালোচনার ফল নয়। তাঁর বক্তব্য, “আওয়ামী লীগ ক্ষমাপ্রার্থী নয়। তারা মনে করছে না যে তারা ভুল করেছে, বরং তারা মনে করছে তাদের পুনরুত্থান ঘটছে।”
ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত এই বিচার। রায় ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে— একদিকে সরকারের কঠোর অবস্থান, অন্যদিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের ইঙ্গিত। শাটডাউন কর্মসূচি দেখিয়ে দিয়েছে, প্রশাসনিক বাধা ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দলটি মাঠে তাদের প্রভাব পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। একই সময়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে পড়েছে, যা সংকটের গভীরতা আরও স্পষ্ট করে।
এখন সবার চোখ রায়ের দিকে। রায় কোন দিকে যাবে তার ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনৈতিক গতিপথ। রায় বিরূপ হলে সংঘাত আরও বাড়তে পারে, আর রায় খারিজ হলে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ এক সঙ্কটময় মোড়ে দাঁড়িয়ে— বিচার, রাজনীতি ও জনসাধারণের নিরাপত্তা এখন একই সুতায় গাঁথা।

Whatsapp
