হাসিনার বিচার নিয়ে কী বক্তব্য আওয়ামী লীগের?

Sheikh Hasina Verdict: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইনস্ক্রিপ্ট-কে দেওয়া লাইভ সাক্ষাৎকারে কঠোর ভাষায় অভিযোগ তুলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে।

গত বছর জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে, তা ঘিরে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। রায় ঘোষণার আগে ও পরে ট্রাইব্যুনাল এলাকা জুড়ে ছিল নজিরবিহীন নিরাপত্তা, উত্তেজনা ও স্লোগানে উত্তাল জনতার সমাগম। তবে এই রায়কে সরাসরি ‘পক্ষপাতদুষ্ট, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হাস্যকর’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইনস্ক্রিপ্ট-কে দেওয়া লাইভ সাক্ষাৎকারে কঠোর ভাষায় অভিযোগ তুলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে।

রায়ের দিন সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনাল এবং আশপাশের এলাকায় দেখা যায় ব্যতিক্রমী নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, এপিবিএন এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল এলাকাজুড়ে। ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি প্রবেশ পথে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তায়; সাধারণ মানুষের প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সাঁজোয়া যান মোতায়েন ছিল সুপ্রিম কোর্ট মাজার গেট থেকে আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে। রায় শোনার জন্য সকাল থেকেই ভিড় জমান গণঅভ্যুত্থানের আহত মানুষ, নিহতদের পরিবার ও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। আদালতের বাইরে মিছিল, স্লোগান, ব্যানার-ফেস্টুনে জমে ওঠে এলাকা।

আরও পড়ুন

শেখ হাসিনার সম্পত্তির পরিমাণ কত?

বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল দুপুর সাড়ে ১২টার পর এজলাসে প্রবেশ করেন। টানা দু'ঘণ্টা রায় পাঠের পর ঘোষণা করা হয়— প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ড এবং প্রাক্তন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে রাজসাক্ষী হওয়ায় ৫ বছরের কারাদণ্ডের। স্বাধীনতার পর এটাই প্রথম কোনো প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড।

রায়ের পরপরই দলের শীর্ষ নেতাদের প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করে। ইনস্ক্রিপ্ট-কে দেওয়া লাইভ সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রায়টিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন। তিনি বলেন,

“এটি পক্ষপাতদুষ্ট, পূর্বনির্ধারিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনীতি। ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা জুলাই বিপ্লবের নামে প্রতিশোধ নেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে।”


ওই সাক্ষাৎকারে তিনি অভিযোগ করেন ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ বিকৃত, হাস্যকর এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত।

ওবায়দুল কাদের আরও বলেন,

“শেখ হাসিনার আমলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে আইসিটি গঠন করা হয়েছিল। আজ সেই একই আইসিটিকে অবৈধ সরকার প্রতিশোধের জন্য ব্যবহার করছে।”

আরও পড়ুন

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে কী প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে

তাঁর কথায়,

“যে ডিফেন্স কাউন্সিল যুদ্ধাপরাধের মামলায় কাজ করেছে, তাকেই (মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম) এখন আইসিটির চিফ প্রসিকিউটর বানানো হয়েছে।” তাঁর দাবি, “বিচারক থেকে প্রসিকিউশন, অনেকেই জামায়াতপন্থী ক্যাডার। জনগণ এটা জানে।”


তিনি আরও বলেন,

“মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় এসে যত আক্রোশ, যত বিদ্বেষ সবই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এই রায় সেই প্রতিহিংসারই প্রতিফলন।”

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দফতর (ওএইচসিএইচআর) শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়কে গত বছরের আন্দোলন-দমনকালীন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার মানুষদের জন্য 'তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি' বলে বর্ণনা করেছে। ওএইচসিএইচআর তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠানগতভাবে ক্রমবর্ধমান সহিংস পদ্ধতিতে বিক্ষোভকারীদের দমনের পথ বেছে নিয়েছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক মন্তব্য করেন,

“আমাদের সংগৃহীত সাক্ষ্য ও তথ্যসমূহ ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের যে চিত্র তুলে ধরে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে গুরুতর ধরন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধের পর্যায়েও পড়তে পারে।”

তিনি আরও বলেন,

“জাতি যে আঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে তা কাটিয়ে উঠতে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার অত্যাবশ্যক।”

উল্লেখ্য, রায়ের পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা বেড়েছে। আওয়ামী লীগ রায়কে 'প্রহসন' বলছে, অন্যদিকে জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনে আহত মানুষ এবং নিহতদের পরিবার আদালতের রায়কে স্বাগত জানান। তাদের বক্তব্য, এই রায় ন্যায়ের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এদিকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বেশ কিছু ছাত্রসংগঠন এবং নাগরিক সংগঠনও রায়কে ‘জরুরি’ ও ‘ঐতিহাসিক’ বলে বর্ণনা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আন্তর্জাতিক মহলের নজর এখন শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনার কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে। আসন্ন দিনগুলোতে এই রায়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অবস্থান, জনমত এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেশের পরিস্থিতিকে কোন দিকে নিয়ে যায়— তা এখনই জাতীয় আলোচনার প্রধান বিষয়।

More Articles