অসম-বাংলাদেশ সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্রর লাইসেন্স, হিমন্ত বিশ্বশর্মার সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কোন রাজনীতি?
Assam Arms Licence: অসমের বিরোধী দলগুলি মুখ্যমন্ত্রীর এই নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে, বিশেষ করে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে এই সিদ্ধান্তকে তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করছে।
আত্মসুরক্ষার জন্য নিজের কাছে অস্ত্র রাখতে পারবে সাধারণ মানুষ। নয়া লাইসেন্স নীতি অসম সরকারের। রাজ্যের সংখ্যালঘু প্রধান, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অরক্ষিত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী অসমের ভূমিপুত্ররা এই সুবিধা পাবেন। গত মে মাসেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অসম মন্ত্রীসভা। এবার তা কার্যকর করা হল। লাইসেন্স প্রদান করার জন্য একটি অনলাইন পোর্টাল খোলা হয়েছে বলে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। ১ অগাস্ট থেকে অনলাইনে অসমের ‘আদিবাসী’ বা ‘মূলবাসী’দের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হবে বলে আগেই ঘোষণা করেছিলেন তিনি।
কেন এই নীতি?
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলছেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাস করলে, অথবা রাজ্যের কোনো অরক্ষিত ও সংবেদনশীল এলাকায়, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের বাস ৯০-৯৫ শতাংশ হলে, সেক্ষেত্রে দুই সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং নানা কারণে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ চালাতে পারে। তিনি জানান, একটি থানায় ৬-১২ জন কনস্টেবল থাকেন। যদি কোনো সমস্যাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়, জেলা সদর দফতর থেকে অতিরিক্ত বাহিনী আসতে ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগবে। আর সেই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। পুলিশ আসা পর্যন্ত নিজেদের সুরক্ষার প্রয়োজন। হামলাকারীরা যদি জেনে থাকেন যাঁর বা যাঁদের উপর হামলা করতে যাচ্ছেন, তাঁদের কাছে আত্মসুরক্ষার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র আছে। তাহলে হামলা করার আগে দু’বার ভাববেন।
কারা অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন?
অসমের ভূমিপুত্র হলেই অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যাবে বলে জানিয়েছে সরকার। আবেদনকারীদের পরিচয় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। বয়স হতে হবে অন্তত ২১ বছর। সীমান্তবর্তী অরক্ষিত, প্রত্যন্ত ও সংবেদনশীল এলাকার বাসিন্দা হলেই আবেদন করা যাবে। তারই সঙ্গে হতে হবে ‘শারীরিক ও মানসিক’ভাবে সুস্থ। এবং আবেদনকারীদের ২০১৬ সালের অস্ত্র আইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণের শংসাপত্র থাকতে হবে। অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে কোনও ফৌজদারি মামলা বা অপরাধের রেকর্ড আছে কিনা, খতিয়ে দেখা হবে।
আরও পড়ুন- বাস্তুচ্যুত ৩ হাজার ৫০০টি পরিবার! অসমের মুসলিমদের সঙ্গে কী ঘটছে?
যদিও কোন কোন এলাকাগুলি ‘অরক্ষিত' এবং 'সংবেদনশীল’, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি আবেদন প্রক্রিয়ায়। মে মাসে মন্ত্রীসভার বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, গোয়ালপাড়া, ধুবুড়ি, দক্ষিণ শালমারা, নগাঁও, মরিগাঁও এবং বরপেটা-র মতো জেলাগুলিতে এই লাইসেন্স নীতি প্রযোজ্য হবে। সে-সময়ই হিমন্ত বিশ্ব শর্মা জানিয়েছিলেন যে, অসমের ভূমিপুত্র ও জনজাতিরা নিজেদের জমিতেই বাংলাদেশিদের আক্রমণ ও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। এর থেকে যাতে তাঁরা নিজেদের রক্ষা করতে পারেন, তার জন্যই এই বিশেষ অস্ত্র নীতি চালু করা হবে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই জেলাগুলোতেই বিপুল সংখ্যক বাংলা-ভাষী মুসলিম (যাঁদের স্থানীয়ভাবে 'মিয়া মুসলমান' বলা হয়) বসবাস করেন।
অসমের বিরোধী দলগুলি মুখ্যমন্ত্রীর এই নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে, বিশেষ করে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে এই সিদ্ধান্তকে তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করছে। কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি গৌরব গগৈ বলেছেন, “অসমের মানুষ জল, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা চান, বন্দুক নয়।” সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আদালত অসম সরকারের পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছে। গগৈর মতে, এই নতুন সিদ্ধান্ত ভুয়ো এনকাউন্টারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।
আরও পড়ুন- রাহুল গান্ধী, ক্রমেই ভরসাযোগ্য হয়ে উঠছেন যেভাবে
অন্যদিকে, ২৫ জুলাই শর্মা তাঁর অবস্থান আবারও পুনরায় জানানোর পর অসম জাতীয় পরিষদের সভাপতি লুরিনজ্যোতি গগৈ একে 'বিপজ্জনক' বলে অভিহিত করেন। তাঁর ভাষায়, “এটি সীমান্তে পাহারারত পুলিশ এবং বিএসএফের প্রতি অপমান।”
অরাজনৈতিক নারী সংগঠন ‘নারী নাগরিক মঞ্চ’ সরকারের নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন শুরু করবে বলে জানিয়েছে। ৮ অগাস্ট গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ওই নারী সংগঠন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সরকারের সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ জানিয়ে তারা মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে একটি স্মারকলিপি জমা দেবে। একইসঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপও চাওয়া হবে। প্রয়োজনে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে রুখতে নারী নাগরিক মঞ্চ আদালতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করবে।
আরও পড়ুন- মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়াই ইলেকশন কমিশনের কাজ?
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর থেকেই অসমে ধারাবাহিকভাবে ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিগত এবং উপআঞ্চলিক পার্থক্যের কারণে সহিংসতা ছড়িয়েছে। ‘বাংলাদেশিরা অসম দখল করে নেবে’, এই আশঙ্কা থেকেি মূলত এই বিভাজন। ১৯৭৯-'৮৫ সালে অসম আন্দোলনের সময় যা ব্যাপক আকার ধারণ করে। ফলস্বরূপ, ১৯৮৫ সালে অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বা তারপরে অসমে প্রবেশকারী বিদেশিদের শনাক্তকরণ, ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া এবং নির্বাসন দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তারই সঙ্গে অসমিয়া জনগণের জন্য সাংবিধানিক, আইনগত এবং প্রশাসনিক সুরক্ষা এবং বিদেশিদের স্থাবর সম্পত্তি সীমিত করার বিধান ছিল।
ইতোমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি সন্দেহে’ হেনস্থার অভিযোগে তপ্ত রাজনৈতিক মহল। ভারতে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ’ ঠেকাতে তৎপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। তারই মধ্যে অসমের নতুন লাইসেন্স নীতি বিতর্কের মধ্যে ঘৃতাহুতি। যখন লোকসভার বিরোধী দলনেতা নির্বাচন কমিশন ও বিজেপির যোগসাজসে ভোটচুরির প্রমাণ ফাঁস করে দিয়েছেন, আন্দোলনে নেমেছেন এর বিরুদ্ধে, এমন পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ’ বিরোধিতার মাধ্যমে জনগণের নজর ঘোরানোর চেষ্টা চলছে না তো? রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, আগামী নির্বাচনকে মাথায় রেখেই মেরুকরণের রাজনীতি করছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। কারণ একদিকে বর্তমান শাসকদলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রীর পদের জন্য বিকল্প হিসেবে গৌরব গগৈ-এর নাম উঠে আসছে মানুষের কাছে।

Whatsapp
