ফিলিস্তিনি-ক্ষতর শুশ্রুষা হবে না কোনও মলমেই: অরুন্ধতী রায়

Arundhati Roy: ২০২৪ সালে পেন পিন্টার পুরস্কার পাওয়ার পরে পরেই অরুন্ধতী ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, গোটা পুরস্কারের অর্থটাই তিনি দান করবেন ফিলিস্তিনি শিশুদের তহবিলে।

বরাবরই ব্যতিক্রমী পথের পথিক ভারতীয় লেখিকা-সাহিত্যিক অরুন্ধতি রায়। শুধু লেখনীতে নয়, নিজের মতাদর্শ ও বক্তব্য নিয়েও বরাবর ঋজু অরুন্ধতি। ২০২৪ সালে পেন পিন্টার পুরস্কার পাওয়ার পরে পরেই অরুন্ধতী ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, গোটা পুরস্কারের অর্থটাই তিনি দান করবেন ফিলিস্তিনি শিশুদের তহবিলে। শুধু তাই নয়, গাজা ও লেবাননে যে ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে লাগাতার, পেন পিন্টারের মঞ্চেও এবার তার বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা গেল অরুন্ধতীকে। কার্যত কড়া ভাষাতেই তিনি নিন্দা করে বসলেন আমেরিকা ও ইজরায়েলের।

১৯৯৭ সালে 'দ্য গড অব স্মল থিংস' উপন্যাসের জন্য অরুন্ধতি পেয়েছেন বুকারের মতো পুরস্কার। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় উল্লেখযোগ্য বইগুলির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল সেই বই। ১৯৮৯ সালে চিত্রনাট্যকার হিসেবে পান ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডও। সেই পুরস্কারের তালিকায় তাঁর সর্বশেষ সংযোজন পেন পিন্টার পুরস্কার। নোবেলজয়ী নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টারের স্মরণে ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড ও কমনওয়েলথের সাহিত্যিকদের প্রতিবছর এই পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। চলতি বছর সেই পুরস্কারের হকদার ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়। তাঁর বলিষ্ঠ কলম ও প্রতিভাকে সম্মান জানিয়ে গত ১০ অক্টোবর ব্রিটিশ লাইব্রেরি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: এক কক্ষপথ পার, নতুন সূর্যের অপেক্ষায় আজও যুদ্ধক্লান্ত গাজা

সম্প্রতি ওই পেন পিন্টার পুরস্কারের জন্য দেওয়া বক্তৃতায় অরুন্ধতীর মুখে ফের শোনা গেল গাজার পাশে দাঁড়ানোর বার্তা। আজ থেকে নয়, দীর্ঘদিন ধরেই ইজরায়েল যেভাবে প্যালেস্টাইনের উপর দখলদারী চালিয়ে আসছে, তার কড়া সমালোচক অরুন্ধতী। সাম্প্রতিক সেই অনুষ্ঠান থেকেও ফের একবার সেই স্বরই শোনা গেল লেখিকার কাছ থেকে। তিনি জানান, প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজায় আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল ও আমেরিকা। সেই গণহত্যার ছবি আমরা দুরদর্শনে দেখছি। অসংখ্য দেশের ক্ষেত্রেই এমন গণহত্যার ইতিহাস সত্য। ইজরায়েলের ইহুদি, যারা কিনা নির্বাচিত মানুষ হিসেবে উঠে এসে ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত এবং হত্যার অমানবিকতা শুরু করেছে আরও আগে থেকেই। ইজরায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন ফিলিস্তিনিদের 'দুই পা যুক্ত পশু' বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। দেশের আরেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনের কাছে ফিলিস্তিনিরা ছিলেন 'ঘাসফড়িংয়ে'র মতো, যাদের নিমেষে পিষে মেরে ফেলা যায়। আরেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার তো মানতেই চাননি ফিলিস্তিনি শব্দটার অস্তিত্ব। এর আগেও সেই সব অনস্তিত্বহীন বলে মেনে নেওয়া মানুষগুলোকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কার্যত জাতিগত ভাবে তাদের সাফ করে দিতে চেয়েছে ইজরায়েল। যেভাবে অর্থবান প্রভাবশালী পরিবারে শিশুর নৃশংসতা দেখে নৃশংস ভাবে হাততালি দেন বাবা-মা, কার্যত গর্ববোধ করেন সন্তানদের অপরাধপ্রবণতায়, সে ভাবেই ইজরায়েল যেন এই গণহত্যা নিয়ে প্রকাশ্যে গর্ববোধ করে চলে নির্দ্বিধায়। ইজরায়েলি সেনা যুদ্ধের ময়দানে যেভাবে প্রতিটি মাত্রা পেরিয়ে গিয়েছে, ন্যূনতম মানবিক শালীনতার সীমাটুকু হারিয়ে ফেলেছে, তাতে বোধহয় অবাক হওয়ার কিছু নেই।

অরুন্ধতী মনে করেন, কোনও কিছুর বিনিময়েই ইজরায়েলের এই আগ্রাসনকে সমর্থন করা যায় না। যেভাবে ইজরায়েলে হামাসের হামলাকে সমর্থন করা যায়নি। এমনকী ৭ অক্টোবরের সেই ঘটনার পরে যেসব গাজার মানুষ হামাসের হামলাকে সমর্থন করেছে বা সেই আক্রমণের ঘটনাকে উদযাপন করেছে, তাঁদের মানবিক শালীনতা এবং দায়বদ্ধতা নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন ওঠে। লেখিকা জানান, তিনি নির্যাতিত মানুষ কীভাবে নিপীড়নকে প্রতিহত করবে বা তাঁদের সহযোগী কারা হওয়া উচিত, এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে চান না। বরং তাঁর মতে, নিজেদেরকে প্রশ্ন করা জরুরি, একটি উদার ধর্মনিরপেক্ষ জোট কি এই গণহত্যার যুদ্ধযন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে? যদি গোটা বিশ্বের সমস্ত শক্তি তার বিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে যায়, তখন তারা ঈশ্বর ছাড়া আর কার কাছে যাবে?

এখানেই না থেমে অরুন্ধতী জানান, কার্যত এই নিন্দা-নিন্দা খেলা খেলতে নারাজ তিনি। লেখিকা জানেন যে হিজবুল্লাহ এবং ইরানের শাসকদের নিজেদের দেশেই বহু বিরোধী রয়েছেন, যাদের জায়গা হয়েছে জেলে, কিংবা বিরোধিতার আরও কঠিন সাজা পেয়েছেন তাঁরা। তিনি এ-ও জানেন, তাদের বেশ কিছু কর্মকাণ্ড, যেমন বেসামরিক লোকেদের হত্যা কিংবা ৭ ই অক্টোবর ইজরায়েলে হামলা করে হামাসের সাধারণ ইজরায়েলবাসীকে বন্দি বানানো, তা যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়ে। তার পরেও অরুন্ধতী মনে করেন, গাজা বা ওয়েস্টব্যাঙ্কে কিংবা এখন এখন লেবাননে ইসরায়েল এবং আমেরিকা যা করে চলেছে তার মধ্যে তুলনা চলে না। ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামাস যে সহিংসতা দেখিয়েছে, তার মূলেও কিন্তু ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি ভূমি দখল এবং ফিলিস্তিনি জনগণের উপর জোর করে পরাধীনতার শিকল চাপিয়ে দেওয়া। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যা হয়েছে, তার শিকড় কিন্তু প্রোথিত ছিল ইতিহাসেই।

 

এর পরেই অরুন্ধতী প্রেক্ষাগৃহে বসে থাকা দর্শকদের উদ্দেশে জিজ্ঞেস করেন— "আমি আপনাদের জিজ্ঞাসা করি, এই হলে বসে থাকা আমাদের মধ্যে কে কে স্বেচ্ছায় নতিস্বীকার করতে রাজি হবেন সেই অসম্মানের কাছে, গত কয়েক দশক ধরে যার লাগাতার শিকার হয়ে চলেছেন গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ফিলিস্তিনিরা? মর্যাদাপূর্ণ পথে সব রকম চেষ্টাই করেছেন তাঁরা। ইজরায়েলের প্রায় প্রতিটি শর্তের কাছেই মাথা নুইয়েছেন। ইজরায়েলের যুদ্ধের নেপথ্যে কিন্তু কোনও আত্মরক্ষার তত্ত্ব নেই। বরং ফিলিস্তিনি জনগণ ও তাঁদের অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ মজবুত করাই একমাত্র উদ্দেশ্য ইজরায়েলের।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যার পাশপাশি গাজার বিরাট অংশের জনসংখ্যাকে বাস্তুচ্যুত করেছে ইজরায়েল। হাসপাতালে বোমা মেরেছে। ইচ্ছাকৃত ভাবে নিশানা করা হয়েছে ডাক্তার, সহায়তাকর্মী, সাংবাদিকদের। কার্যত একটা সমগ্র জনসংখ্যাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে, যাতে মদত দিচ্ছে বিশ্বের ধনীতম দেশের সরকার ও তাদের মিডিয়া। আর তার মধ্যে নিজের দেশ ভারতকেও অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন ক্ষুব্ধ অরুন্ধতি। জানান, শুধু অস্ত্র নয়, ভারত ইজরায়েলকে হাজার হাজার শ্রমিকও সরবরাহ করে। তিনি মনে করিয়ে দেন, শুধুমাত্র গত বছরেই ইজরায়েলকে সামরিক সহায়তার জন্য ১৭.৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে আমেরিকা। ফলে যে যুদ্ধবিরতির দাবি প্রায়শই তুলে আসছে আমেরিকা, তা কার্যত মিথ্যা বলেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।

অরুন্ধতি মনে করেন, ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যখন মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র তুলে ধরেন, যেখানে প্যালেস্টাইনের নামগন্ধ নেই, তখন তিনি একজন স্বপ্নদর্শী হিসেবে নিজের দেশে এবং বিশ্বের বেশ কিছু ক্ষমতাবান দেশের কাছে স্বপ্নদর্শী হিসেবে প্রশংসিত হন। যে কিনা ইহুদিদের স্বদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন। এদিকে যখনই ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনতার স্লোগান দেন, তা হয়ে যায় ইহুদিদের গণহত্যার আহ্বান। আর সেই দ্বিচারিতার জায়গাটাকেই কার্যত সকলের সামনে নগ্ন ভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন অরুন্ধতী রায়।

আরও পড়ুন: মৃত্যু উপত্যকা গাজা | এত লাশ রাখব কোথায়?

ভারত থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা, সমস্ত দেশই ঔপনিবেশিকতার শিকল ছুড়ে ফেলেছে, যেমন আজ চায় ফিলিস্তিনিরাও। অরুন্ধতি মনে করেন, আমেরিকা ইজরায়েলের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করলে হয়তো এই যুদ্ধ এতদিনে শেষ হয়ে যেত। ইজরায়েলি বন্দিরা ছাড়া পেতেন, ইজরায়েলের জেল থেকে মুক্তি পেতেন ফিলিস্তিনিরা। হামাস ও ফিলিস্তিনি পক্ষদের সঙ্গে কথা বলে হয়তো যুদ্ধশান্তির একটা পথ বেরিয়ে আসতে পারত। যাতে বেঁচে যেত লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষের প্রাণ। কিন্তু তেমনটা বাস্তবে ঘটেনি।

এরপরেই তিনি ফিরে যান মিশরীয় লেখক ব্লগার আলা আহমেদ সিফ আবদ-এল ফাত্তাহের কথায়। যার সঙ্গেএই পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছে অরুন্ধতী, পাশাপাশি যাঁকে 'রাইটার অফ কারেজ' নামেও অভিহিত করেছেন লেখিকা, সম্মান জানান তাঁর প্রতি। অবিলম্বে মিশরের জেল থেকে তাঁর মুক্তির দাবিও তোলেন তিনি। ফাত্তাহের কারাগারে বসে লেখা 'You Have Not Yet Been Defeated' বইয়ের কথা উল্লেখ করে অরুন্ধতী জানান, জয়-পরাজয়ের অর্থ নিয়ে এমন সুন্দর লেখা তিনি কমই পড়েছেন। কীভাবে রাষ্ট্রের থেকে নাগরিকেরা নিজেদের এমন স্বচ্ছতার সঙ্গে আলাদা করে নেন, এমন লেখা তিনি খুব কমই পড়েছেন বলেও জানান বুকারজয়ী সাহিত্যিক। একই সঙ্গে তিনি আশা রাখেন, "From the river to the sea/ Palestine will be Free"— ফিলিস্তিনিরা তাঁদের স্লোগানে যে স্বপ্ন দেখেন প্রতিনিয়ত, তা সফল হওয়া সময়ের অপেক্ষা বলেও মনে করেন বিশ্ববরেণ্য এই সাহিত্যিক।

More Articles