আসফাকুল্লা ও বিসমিল: ভারতের দু’জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর এক অন্য বন্ধুত্বের গল্প 

Ashfaqullah Khan and Ram Prasad Bismil: তাঁরা দুজনেই জানতেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কালিমালিপ্ত করতে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢালতে চাইছে। ১৯০৬ সাল থেকে হিন্দু মহাসভা এই কাজটা করছে।

যে বছর গুজরাট গণহত্যা সংগঠিত হয়, সেই বছর অর্থাৎ ২০০২ সালে তথ্যচিত্র নির্মাতা ললিত ভাচানি একটি তথ্যচিত্র নিয়ে আসেন দর্শকদের জন্য, ‘মেন ইন দি ট্রি’। আরএসএস পরিচালিত নাগপুরের একটি শাখায়, দুই যুবকের ফিরে আসা এবং তাঁদের কী ধরনের কাজ করতে হয়, কী পড়ানো হয়, তাই দেখানো হয়েছে এই তথ্যচিত্রে। ১৯৯৩ সালে ললিত ভাচানি তাঁর এই সংক্রান্ত প্রথম তথ্যচিত্রটি দর্শকদের সামনে নিয়ে আসেন, ‘বয় ইন দি ট্রি’-তে। প্রথম তথ্যচিত্রের কালী, সন্দীপ কিংবা পুরুষোত্তম আগরওয়ালদের পরিণতি দেখাতেই ললিত তাঁর দ্বিতীয় তথ্যচিত্রটি বানান বলে মনে করা হয়। তথ্যচিত্রের একটি অংশে পুরুষোত্তম আগরওয়াল, যিনি পরে দেশে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী একটি মঞ্চ স্থাপন করেন, তাঁকে বলতে শোনা যায়— আরএসএসের শাখায় ইতিহাস পড়ানোর সময়ে সচেতনভাবে ইতিহাসের বিকৃতি করা হয়। একটি সাক্ষাৎকারে দেখা যায়,  আরএসএসের শাখায় বড়ো হওয়া একজন কিশোর যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএসের ভূমিকা কী ছিল— এই প্রশ্ন করে, তখন উত্তর হিসেবে শুধু গোলগোল উত্তর পাওয়া যেত। যদি কেউ প্রশ্ন করতেন, ভগৎ সিং তো মার্ক্সবাদী ছিলেন, তা সত্ত্বেও তাঁকে সম্মান জানানো হয়, তাহলে আসফাকুল্লা খানকে কেন একইরকম শ্রদ্ধা জানানো হবে না? তখন বলা হত ভগৎ সিং মার্ক্সবাদী হলেও, শেষ বিচারে তো হিন্দু ছিলেন, কিন্তু আসফাকুল্লা খান ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ফাঁসির দড়িতে শহিদ হলেও তিনি তো মুসলমান ছিলেন, তাই তিনি কিছুতেই সমান শ্রদ্ধার যোগ্য হতে পারেন না।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ২২ অক্টোবর, কারণ এই দিনটাই আসফাকুল্লা খানের জন্মদিন। এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, কে এই আসফাকুল্লা খান আর কেনই বা তাঁকে নিয়ে ভাবতে হবে?

যে সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে আরএসএসের ১০০ বছর উপলক্ষে একটি ১০০ টাকার স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে ভারতমাতার হাতে পতাকা শোভিত, সেই সময়েই আমাদের আরও বেশি করে আসফাকুল্লা খানের মতো মানুষদের স্মরণ করা উচিৎ। আসফাকুল্লা খান, রামপ্রসাদ বিসমিল কিংবা ভগত সিং-দের কথা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা আরএসএস তাদের শাখায় সঠিকভাবে জানায় না। তারা কিছু মানুষকে সম্মান দেখায়, যাঁদের ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা খুব কম বা মোটেও ছিল না। এবং তাঁদেরকে দেখিয়ে ভুলভাবে মনে করানোর চেষ্টা করা হয়— তাঁরা প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী। কিন্তু ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইতে এমন বহু ঘটনা এবং মানুষ আছেন, যাঁদের অবদানের বিষয়গুলি জোরের সঙ্গে প্রচারিত হলে, আজকের শাসকদলেরই অসুবিধা হতে পারে।

আরও পড়ুন

রামরাজ্যের নারী ও নারীর রামরাজ্য

১৯২৭ সালের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ এবং ১৯ তারিখ, চারজন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ফাঁসিতে ঝোলায়, সেই সময়ের ইংরেজ সরকার। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা নিশ্চিত এই নামগুলি মনে করতে পারবেন। রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকুল্লা খান এবং ঠাকুর রোশন সিং। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা ‘হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে, লখনউ-এর কাছে কাঁকোরি গ্রামে একটা ট্রেন ডাকাতি করেছিলেন, যে ট্রেনে করে ব্রিটিশ কোষাগারে টাকা পৌঁছনো হচ্ছিল। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন, যার পরবর্তীতে নাম হয়— হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন, তার সদস্য ছিলেন বহু মানুষ। সদস্যরা মনে করতেন, ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে, সশস্ত্র আন্দোলনের কোনো বিকল্প হতে পারে না, যেহেতু অস্ত্র কেনার জন্য টাকার দরকার, তাই বিপ্লবীরা ঠিক করেন ট্রেনটিতেই ডাকাতি করতে হবে, যাতে ব্রিটিশদের কোষাগারের জন্য টাকা নিয়ে যাওয়া আটকানো যায়। সেই মতো পরিকল্পনা করে, ট্রেন ডাকাতি সংঘঠিত হয়েছিল, ১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট। সেদিনের ডাকাতির সঙ্গে আরও বহু বিপ্লবী যুক্ত ছিলেন, কিন্তু মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে, ব্রিটিশ শাসকেরা সেই বছরের অক্টোবর মাসে রামপ্রসাদ বিসমিল এবং ডিসেম্বর মাসে আসফাকুল্লা খানকে গ্রেফতার করে।

শোনা যায়, ডাকাতির পর, ব্রিটিশ শাসকেরা চিরুনি তল্লাশি শুরু করে, উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গা এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৪০ জন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের গ্রেফতার করে। আজকে যদি ইতিহাসের পাতা উল্টে কেউ জানতে চান— সেদিন ডাকাতির উদ্দেশ্য কী ছিল এবং কত টাকা সেদিন লুট করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁরা? তাহলে হয়ত অনেকেই টাকার পরিমাণ শুনে হাসতে পারেন। কিন্তু সেদিন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনকে একটা বার্তা দেওয়ার—  ভারতীয়দের করের টাকা দিয়ে ব্রিটিশরা আর বেশিদিন শাসন চালাতে পারবে না। সেদিন লুট হয়েছিল, মাত্র ৪৬০০ টাকা, কিন্তু তাই বা কম কী? যদিও সেদিনের ডাকাতির সময়ে অনিচ্ছাকৃত ভাবে এক ব্যক্তি খুন হন, কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশের কাছে বার্তা দেওয়ার, তা কিন্তু তাঁরা পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন।

একদিকে তখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছে, অন্যদিকে তখন বহু মানুষ মনে করতেন সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি মিলবে না। তারপরে বিখ্যাত কাঁকোরি মামলা শুরু হয় ১৯২৬ সালের ১ মে। যদিও প্রাথমিকভাবে ১৪ জনকে কোনো প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। বেশ কিছু বিপ্লবীদের শারীরিক কারণে মুক্তি দেওয়া হয়। প্রায় একবছর স্পেশাল সেশনস কোর্টে মামলা চলার পরে, ১৯২৭ সালের ৬ এপ্রিল রায় ঘোষণা হয়। সেই রায়ে, রামপ্রসাদ বিসমিল, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী এবং ঠাকুর রোশন সিং-কে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। শচীন্দ্রনাথ সান্যাল-কে যাবজ্জীবন এবং মন্মথনাথ গুপ্তকে ১৪ বছরের কারাদন্ডের আদেশ শোনানো হয়। আরও বেশ কিছু অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়ার রায়ও দেওয়া হয় ওই মামলায়। কারো দশ বছর, কারো সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয় আদালত। এই রায় ঘোষণা হওয়ার পরে গ্রেফতার হন, আরও দু'জন, যাঁদের প্রত্যক্ষ মদতেই ওই কাঁকোরি ট্রেন ডাকাতি হয়েছিল বলে বিশ্বাস করত ইংরেজ শাসকেরা, তাঁরা হলেন আসফাকুল্লা খান এবং শচীন্দ্রনাথ বক্সী। তারপরে, ইংরেজ পুলিশ আসফাকুল্লা খানকে জেরা করা শুরু করে, যাতে তিনি নিজে থেকে স্বীকার করেন, তিনি ওই ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, কিন্তু শত জেরাতেও তা অস্বীকার করেন আসফাকুল্লা খান। শেষে ১১ অগাস্ট, মামলার শুনানি হয়— রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকুল্লা খান-সহ অন্যান্যদেরও ফাঁসির আদেশ শোনানো হয়।

তাঁরা দুজনেই জানতেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কালিমালিপ্ত করতে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢালতে চাইছে। ১৯০৬ সাল থেকে হিন্দু মহাসভা এই কাজটা করছে। এরপর ১৯২৫ সালেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ। বেশ কিছু হিন্দু এবং মুসলমান নেতারা সর্বক্ষণ চেষ্টা করছিলেন—কীভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করা যায়। রামপ্রসাদ বিসমিল শেষ পর্যন্ত একটা বক্তব্যেই বিশ্বাস রাখতেন— এইরকম দুই ধর্মের মানুষেরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পরাজিত করতে গিয়ে শহিদ হয়ে মৃত্যু বরণ করতে পারেন, তাহলেই আসলে এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আটকানো সম্ভব।

বিসমিল লিখেছিলেন, ব্রিটিশ সরকার একটি সাধারণ ডাকাতির অভিযোগে তাঁর সঙ্গে আরও তিনজন বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝোলালেও, বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক কান্ডে অভিযুক্ত দোষীদের ক্ষেত্রে কিন্তু এতোটা কঠোর হয়নি। ব্রিটিশরা হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন, যদি কাঁকোরি মামলার অভিযুক্তদের রেহাই দেওয়া হয়, তাহলে দেশের নানান প্রান্তে এই ধরনের ঘটনা আরও বেড়ে যেতে পারে— যা ইংরেজদের আসনকে টলমল করে দিতে পারে। তিনি আরও লেখেন, স্যার উইলিয়াম মরিস যে সময়ে নিজে শাহজাহানপুর এবং এলাহাবাদ দাঙ্গায় অভিযুক্তদের মুক্তি দেওয়ার সুপারিশ করছেন, সেই সময়ে দেশের নানান প্রান্তে এই রকম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। যদি শাস্তি মকুব করলে, একই ধরনের ঘটনা বাড়ার প্রবণতা দেখা যায়, তাহলে তা তো সাম্প্রদায়িক ঘটনার জন্য বিশেষ করে প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। বিসমিল পরিষ্কার ভাষায় লেখেন, আসলে কাঁকরি মামলায় অভিযুক্তদের শাস্তি মকুব করলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে অন্য বার্তা যেত, যা গেলে শাসকদের ক্ষতি হত। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সেই ক্ষতি হত না। তাঁর শেষ বাক্যটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আসফাকুল্লার মতো একজন ধর্ম বিশ্বাসী মুসলমান মানুষ, তাঁর মতো একজন আর্য সমাজের সদস্যের বন্ধু হয়ে একসঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে শহিদ হতে পারেন, তাহলে সাধারণ হিন্দু মুসলমান মানুষজন কেন নিজেদের ছোটখাটো বিভেদ ভুলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না।

দেশবাসী অসংখ্য ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে তিনি লেখেন,

‘যদি আমাদের দু'জনের মৃত্যুতে আপনারা এতোটুকুও দুঃখ পেয়ে থাকেন, তাহলে অবিলম্বে ঐক্যবদ্ধ হোন এবং সেটাই হবে, আমাদের জন্য আসল শ্রদ্ধা প্রদর্শন’।

১৯ ডিসেম্বর তাঁর ফাঁসির তিন দিন আগে, ১৬ ডিসেম্বর, তিনি এই লেখাটা লেখেন। ১৯২৮ সালের জানুয়ারি মাসে পাঞ্জাবি ভাষায় প্রকাশিত, কীর্তি নামে একটি পত্রিকাতে ভগৎ সিং, একটি লেখা লেখেন, যার শিরোনাম ছিল, ‘দেশের একজন শহীদের শেষ কথা’, এখানে রামপ্রসাদ বিসমিলের এই কথাগুলোকে তিনি অনুবাদ করেন।
আসফাকুল্লা খানের শেষ চিঠি পড়লেও, তাঁদের দুজনের বন্ধুত্ব সম্পর্কে একটা আভাস পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিটি সদস্যদের মধ্যে যে কী রকম সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, তাও এই চিঠিগুলি থেকে বোঝা যায়। কোনো চিঠিতে কোনো প্রাদেশিকতা নেই, কোনো ধর্মের বাধা নেই। আসফাকুল্লা যখন তাঁর সহযোগী কমরেড শচীন্দ্রনাথ বক্সীর বোনকে চিঠি লিখছেন, তিনি তাঁকে, ‘আমার প্রিয় দিদি’ বলে সম্বোধন করছেন, তাঁর বাবা, আসফাকুল্লা যাঁকে নিজেও ‘বাবা’ বলে ডাকতেন, তাঁর উদ্দেশ্যে লিখছেন প্রণাম নেবেন। যেন বক্সীর পরিবার, তাঁর নিজের খুব কাছের পরিবার। তিনি লিখছেন,

‘আপনাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, আমাদের তো ফাঁসি হবেই, সুতরাং তার আগে যদি সম্ভব হয়, একবার আসবেন। বক্সীকে বলবেন, আমায় একবার জানাতে। আমি তোমাকে নিজের বোনের মতো স্নেহ করি, আর আমাদের মৃত্যু কখনই তোমাদের দুঃখ দিতে পারে না, উল্টে যেহেতু আমরা বীরের মৃত্যু বরণ করছি, তাই তোমরা গর্বিত হতেই পারো’।

আরও একটা জরুরী কথা এই লেখায় বলা উচিৎ। তিনি মুসলমান ধর্মে বিশ্বাসী হলেও, কীভাবে ধীরে ধীরে তিনি কমিঊনিষ্ট পার্টির মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং নিরীশ্বরবাদী ভগৎ সিং কীভাবে তাঁকে আকৃষ্ট করেছিলেন সে কথাও তিনি বলেছিলেন তাঁর লেখা চিঠিতে। ভগৎ সিং যেমনভাবে ভাবতেন— ইংরেজ শাসক চলে গিয়ে ভারতে কোনো গণতান্ত্রিক শাসকও আসে আর সেই শাসক যদি ধনী দরিদ্রের বিভেদ রেখে দিতে চায় কিংবা শ্রমিক কৃষককে শোষণ করে, তাহলে সেই স্বাধীনতার কি প্রয়োজন আছে? ভগৎ সিং এই কথাগুলোই লিখে গিয়েছেন, তাঁর বিভিন্ন লেখায়। সেই সময়ে বহু হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা যে ওই কথাগুলোতেই বিশ্বাস রাখতেন, তা বেশ বোঝা যায়। 

আরও পড়ুন

শতবর্ষে আরএসএস : ইতিহাস পুনর্লিখনের পথে মোদি সরকার?

ইতিহাস ঘাঁটলে, হয়ত এইরকম আরও বহু রামপ্রসাদ বিসমিল এবং আসফাকুল্লা খানদের উদাহরণ পাওয়া যাবে। এমনকি আজ থেকে বেশিদিন আগে নয়, গুজরাট গণহত্যার সময়ে যে হিন্দু দলিত মানুষজন মুসলমান মানুষদের হত্যা করেছিলেন— তাঁরাও পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বন্ধু হয়েছেন, সেই উদাহরণও আছে। গুজরাট গণহত্যার সময় যে অশোক পারমারের ছবি বিখ্যাত হয়েছিল, সেই মানুষটিও পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলেছিলেন, এই ধরনের ধর্মীয় দাঙ্গায়, হিন্দুদেরও কোনো লাভ হয় না, মুসলমানদেরও হয় না, লাভ হয়, সেই সব রাজনীতির কারবারিদের যাঁরা বছরের পর বছর, ধর্মের নামে বিভাজন করে চলেছেন। ললিত ভাচানির তথ্যচিত্রেও গুজরাট গণহত্যার উল্লেখ আছে।

মহা ঘটা করে আমাদের দেশের বর্তমান শাসকদল 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' পালন করে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, দেশের প্রতিটি নাগরিক যেন তাঁদের ঘরে ঘরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। কিন্তু সেইসব তো হলো উদযাপন, কিন্তু এই ভারতের স্বাধীনতা আনায় যে কত কত মানুষের আত্মত্যাগ আর বলিদানের ইতিহাস আছে, তা কি আজকের শাসকেরা আমাদের জানাতে চায়? আজকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ তাঁদের প্রতিষ্ঠার একশো বছর পালন করছে, সারা দেশে হিংসা এবং বিদ্বেষের আবহ ছড়ানো হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং দাঙ্গায় হয়ত বহু মানুষ মারা গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন, আবারও বহু বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে। আজকের সময়ে নিশ্চিত আসফাকুল্লা খান বা রাম প্রসাদ বিসমিলের মতো অনেক মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের আজকের শাসকদের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়বেন। দেশের শাসকেরা চেষ্টা করেই যাবেন ধর্মীয় বিভাজন করে, দেশটাকে শাসনে রাখতে, কিন্তু পারবে না। সেদিনও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যেমন শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছিল, আগামীতেও হবে। যদিও আজকের সময়টা আরও জটিল, যদিও আজকের সময়টা সামাজিক মাধ্যমের ভুয়ো খবরের, যা থেকেই জন্মায় অবিশ্বাস কিন্তু তাও নিশ্চিত এমন মানুষদের পাওয়া যাবে যাঁরা আগামী প্রজন্মের কাছে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উদাহরণ হিসেবে থেকে যাবেন। আসফাকুল্লা খান এবং রামপ্রসাদ বিসমিলের বন্ধুত্বের গল্প, তাই পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া জরুরি।

More Articles