কোটি কোটি টাকা নয় ছয়! আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের নামে আসলে কী চলছে দেশে?
Ayushman Bharat Scam: ২.২৫ লক্ষ ক্ষেত্রে, অস্ত্রোপচার করার তারিখটি দেখানো হয়েছে 'ডিসচার্জের' অনেক পরে!
দরিদ্র মানুষদের কাছে স্বাস্থ্যসেবার অর্থই বদলে দিয়েছে আয়ুষ্মান ভারত! অন্তত বিজেপি এই কথাটি প্রচারে কোনও কসুর করে না। ভারতের স্বাস্থ্যপরিষেবাতে দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষ যাতে সুবিধা পান, বঞ্চিতরা সমানাধিকার পান, তাই জন্যই তো আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প! আসলে কি তাই? প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা বা PMJAY - আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের দু'টি উপাদানের একটির মূল্যায়ন করে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (CAG) জানিয়েছে, দুর্নীতিতে ভরে রয়েছে কেন্দ্রের স্বাস্থ্য প্রকল্পটি! PMJAY-এর এটিই প্রথম CAG রিপোর্ট। এই প্রকল্পের টাকা ভাগ হয় কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ৬০:৪০ অনুপাতে। কেন্দ্রীয় সরকার-স্তরে, জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বা NHA প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। রাজ্যগুলিতে কাজ করে রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ (SHAs) এবং জেলার ইউনিটগুলি। এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হচ্ছে পরিবার প্রতি চিকিৎসার খাতে ৫ লক্ষ টাকা দেওয়া। NHA-এর তথ্য বলছে, এখনও অবধি ২৪.৪২ কোটি মানুষ এই প্রকল্পে নাম লিখিয়েছেন এবং এদের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এখনও অবধি ৬৭,৪৫৬.২১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
ক্যাগের এই মূল্যায়ন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর ২০২১ সালের মার্চ অবধি করা হয়েছে। অর্থাৎ এর মধ্যে COVID-19 মহামারীর সময়টিও রয়েছে। সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১৬১টি জেলার ৯৬৪টি হাসপাতালের উপর এই মূল্যায়ন হয়েছে৷ উল্লেখ্য, দিল্লি, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ এই প্রকল্পের আওতা থেকে বেরিয়ে এসেছে।
এই মূল্যায়নে দেখা গিয়েছে, ইনসিওরেন্সের নিষ্পত্তিতে বড় আকারের দুর্নীতি ঘটেছে। টাকা দেওয়ার আগে এই প্রকল্পের অধীনে থাকা হাসপাতালগুলি পর্যাপ্ত নিয়ম মেনে কাগজপত্র অবধি খুঁটিয়ে দেখেনি। ২.২৫ লক্ষ ক্ষেত্রে, অস্ত্রোপচার করার তারিখটি দেখানো হয়েছে 'ডিসচার্জের' অনেক পরে! স্রেফ মহারাষ্ট্রেই এই ঘটনাটি ঘটেছে ১.৭৯ লক্ষেরও বেশি! প্রায় ৩০০ কোটি টাকারও বেশি অঙ্কের হিসেব নেই ঠিকঠাক।
আরও পড়ুন- উপাচার্য কে হবেন, সেই নিয়েও রাজনীতি! রাজ্যপাল-সরকারের দ্বন্দ্বে গোল্লায় যাচ্ছে উচ্চশিক্ষা
অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে, হাসপাতাল যবে টাকা দাবি করেছে এবং SHAs যখন টাকা দিয়েছে, সেই দুই তারিখই এত আগেকার যে তখনও আয়ুষ্মান প্রকল্পের সূচনাই হয়নি! এমনকী 'ক্লেম' করার ঢের আগেই হাসপাতালগুলিকে টাকা দেওয়া হয়েছে। ১৮ বছরের বেশি বয়সী রোগীদেরও নাকি 'পেডিয়াট্রিক স্পেশালিটি প্যাকেজ'-এর অধীনে চিকিত্সা করা হয়েছে!
অডিটে আরও দেখা গেছে, ৪৫,৮৪৬টি ক্ষেত্রে রোগী ভর্তির আগেই 'ডিসচার্জ হয়ে গেছেন খাতায় কলমে! এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে একজন রোগীকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একাধিক হাসপাতালে ভর্তি দেখানো হয়েছে। 'মৃত' হিসেবে দেখানো হয়েছে এমন কয়েকজনের জন্যও লাখ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। ট্রানজ্যাকশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের তথ্যে দেখা গেছে, ৮৮,৭৬০ জন রোগী চিকিৎসার সময়ই মারা গেছেন। তাও এখনও, ২,১৪,৯২৩টি 'ক্লেম' রয়েছে যাতে এই মৃত রোগীদের নাকি নতুন করে চিকিত্সার করানো হচ্ছে। ২৪টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে এই দাবি নিষ্পত্তিতে প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, কেরল এবং মধ্যপ্রদেশে এই ধরনের ঘটনা সবথেকে বেশি ঘটেছে।
১১.০৪ লক্ষ জালি সুবিধাভোগীদের বিষয়ে কেন্দ্র রাজ্যকে সতর্ক করেছে। তবে রাজ্য মোটে ৭.০৭ লক্ষ আয়ুষ্মান ভারত কার্ড নিয়েই তদন্ত করেছে। গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, মেঘালয় এবং উত্তরপ্রদেশে এই ধরনের প্রতারণা সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ঘটেছে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায়। প্রকল্প অনুযায়ী, একবার যাচাই হয়ে গেলে প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের একটি অনন্য PMJAY আইডি জারি হওয়া উচিত। অডিট করতে গিয়ে দেখা গেছে, অসংখ্য নকল আইডি রয়েছে। অর্থাৎ যারা প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নন তারাও সুবিধা পেয়েছেন এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আধার নম্বর ছাড়াও, সুবিধাভোগীদের ফোন নম্বরও ব্যবহার করা হয়েছে। দেখা গেছে, একই বা অবৈধ মোবাইল নম্বর রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। ৭.৫ লাখ মানুষ ‘9999999999' মোবাইল নম্বর দিয়ে রেখেছেন, ১.৪ লাখ মানুষ '8888888888' নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। আধার কার্ডও যাচাই হয়নি ঠিক করে। একই আধার নম্বরে একাধিক রেজিস্ট্রেশন হয়েছে।
প্রকল্পের নির্দেশিকা অনুসারে, রাজ্যকে এই সুবিধাভোগীদের যোগ্যতা যাচাই করার জন্য প্রদত্ত মোবাইল নম্বরে এসএমএস বিজ্ঞপ্তি পাঠাতে হবে। সুতরাং এত সব ভুয়ো নম্বর, ভুল নম্বরে আদৌ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছিল কিনা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আরও পড়ুন- ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের ভাষণে ১০ মিনিট ঠাঁই মণিপুরের! মোদির মূল্যবান সময় যাচ্ছে কোথায়?
NHA-এর তথ্য অনুসারে, এই প্রকল্পের অধীনে ভারত জুড়ে ২৭,৬৪৯টি হাসপাতালকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। পর্যাপ্ত ক্ষমতা সম্পন্ন সমস্ত কমিউনিটি হেলথ সেন্টারকেও তালিকাভুক্ত বলে গণ্য করা হয়। এই হিসাবে, ১৫,০০০টি সরকারি এবং ১২,০০০টি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাও এই প্রকল্পের অংশ। ফার্মাসি, ব্লাড ব্যাঙ্ক, ল্যাবরেটরি, ডায়ালিসিস ইউনিট, পোস্ট অপারেটিভ পরিষেবা, আইসিইউ ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় সবসময়ের সহায়তার জন্য এমপ্যানেলড হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার থাকতে হবে। বিহার, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, অসম, চণ্ডীগড়, গুজরাত, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, পুদুচেরি, ত্রিপুরা এবং উত্তর প্রদেশে এমন ঘটনা ভূরি ভূরি যেখানে চিকিৎসার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম, আইপিডি বেড, অপারেশন থিয়েটার, ভেন্টিলেটর সাপোর্ট সিস্টেম সহ আইসিইউ, ফার্মাসি, ডায়ালিসিস ইউনিট, ব্লাড ব্যাঙ্ক, সবসময়ের অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার মতো মৌলিক পরিকাঠামোর অভাব সত্ত্বেও হাসপাতালগুলি তালিকাভুক্ত হয়েছে৷
ক্যাগের রিপোর্ট বলছে, ১১ টি রাজ্যে ২৪১ টি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অসৎ আচরণের অভিযোগ আছে। রাজ্য একেবারেই হাসপাতালগুলি পরিদর্শনও করে না। একেবারেই নজর না দেওয়াতে রাজ্য হাসপাতালগুলিতে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করেছে। অডিটে দেখা গেছে চারটি রাজ্য- অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব এবং তামিলনাড়ু ৫৭.৫৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত দিয়ে ফেলেছে।
গত বছর রাজ্যসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের রাজ্য মন্ত্রী ভারতী প্রবি পাওয়ার বলেছিলেন ২১০ টি হাসপাতালকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং আরও ১৮৮ টি হাসপাতালে PMJAY পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে। তাদের ২১ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু মাত্র ৯.৫ কোটি টাকার পুনরুদ্ধার করা গিয়েছে।