আইনি স্বীকৃতি মিলেছে, 'ছক্কা' ডাকা বন্ধ হবে কবে?
আজাদির যে অমৃত মূলধারার জন্য মহোৎসব, তা অন্য ধারার জন্য গরলসমান। আর এই বৈচিত্র্য স্বাধীনতার ৭৫ কেন, তারও পরে বিভেদই থেকে যাবে।
আজাদির অমৃত গিলে প্রায় ঢেকুর তোলাও হয়ে গিয়েছে, এমন সময় কারই বা ইচ্ছে করে প্রান্তিকতার আখ্যান শুনতে! তাও আবার নষ্ট প্রান্তিক, ছক্কা প্রান্তিক, হোমো প্রান্তিক, হিজড়ে প্রান্তিক। দেশ বলতে সেই হরিণের কথা মনে পড়ে, যার শিং বড়ই সুন্দর ছিল। ন্যাড়া গাছের ডালপালার মতো বৈচিত্র্যময় শিংই তার অহংকার, সম্পদ, সৌন্দর্য। শিংই তার বিপদও। ভারত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য খোঁজার যে কথা বলে, তা আসলে কিছু দেশভক্তিমূলক ভিডিও আর গা-গরম করা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার ট্যাবলো মাত্র। 'বৈচিত্র্য'-কে দেশ কখনই 'ঐক্য' করে দেখেনি, দেখলে চাপই আছে। অথচ নীতি সকলের জন্য সমান নিদান দিয়েছে। সংবিধান সকলের সমান অধিকার, সমান সুবিধার কথা বলে। ‘সকল’ কারা? ‘সকল’ কি সবাই একই ছাঁচের মানুষ? কাশ্মীরের সংখ্যালঘু আর মণিপুরের সংখ্যালঘু কি এক? গোয়ার মৎস্যজীবীর অধিকারের লড়াই কি ঠিক সুন্দরবনের শ্রমজীবীর মতোই? কেরলের উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া রূপান্তরকামী আর দিনাজপুরের ‘লেডিজ’ কি একই? তাহলে এই সমানাধিকারের গল্পে সবার জন্য সমান পাতা বরাদ্দ হল কই? সবার আকাশ একই হলো কই!
টি. এইচ. মার্শাল ‘নাগরিকত্ব এবং সামাজিক শ্রেণি’ বিষয়ক লেখায় বলেছিলেন, প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদার অধিকার রয়েছে এবং সেগুলি রাষ্ট্র দ্বারাই নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রও প্রায় সোনামুখ করে তার জন্য কতই আইন, কতই নীতি করে বাবাসাহেবের বার্তাকে ঠারেঠোরে প্রমাণ করার কসরত করল। কিন্তু গলদ যেখানে যেভাবে ছিল, বহাল রইল। এই ‘প্রত্যেক নাগরিক’ শব্দটার মধ্যে সকলকে জোড়া গেল না। প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে কখনও মহিলারা প্রান্তে পড়ে যান, কখনও প্রতিবন্ধীরা, কখনও দলিতরা, কখনও শিশুরা, কখনও নানা ধর্মাবলম্বীরা, কখনও অন্য যৌন পরিচয়ের মানুষরা, কখনও… প্রান্তে পড়ে যাওয়ার তালিকাই দীর্ঘ। সুতরাং, সকলের সামাজিক চাহিদা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার যে কাজটি রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছিল, তাতে ফাঁকি পড়ে গিয়েছে। রাষ্ট্র প্রান্তিকের জন্য ‘স্কিম’ ভাবে, আর মূলধারার জন্য সমস্ত আলো। স্বাধীন ভারতে ৭৫টা বছর কাটিয়েও তাই ঐক্যের জন্য আপ্রাণ বুলি আওড়াতে হয়, বিভেদকে স্রেফ উসকে দিলেই হয়।
এত এত ‘প্রান্তিকতা’-র মাঝে যৌন প্রান্তিকতার সঙ্গে শুধু সামাজিক বঞ্চনা মিশে নেই, রয়েছে ঘেন্না, অশ্লীলতা। তাবড় ‘প্রোগ্রেসিভ’ মানুষও কোনও হিজড়েকে কোনওদিন ‘এ আমার সহনাগরিক’ ভেবে দেখেছেন কি না, সন্দেহ। সমকামী, রূপান্তরকামীদের ‘অন্য’ বলে আমরা বৈচিত্র্যময় করেছি বটে, তবে ‘সহ’ হিসেবে দেখিনি। যৌন নাগরিকত্বের ধারণার শিকড় লুকিয়ে রয়েছে গত শতকের আটের দশকে, নারীবাদী আন্দোলনের তৃতীয় তরঙ্গে। ধারণাটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়েছিল, কারণ এটি নাগরিকত্বের ধারণার বৈচিত্র্যর পাশাপাশি অখণ্ডতার কথা বলে। কিন্তু কোথায় অখণ্ডতা? যৌনকর্মীর সন্তান তো সমাজের ‘গরিবদের’ স্কুলেই পড়ে। মাঝে মাঝে বিশেষ দিনে ব্যানার নিয়ে শিশুদের চকোলেট আর মায়েদের কন্ডোম বিতরণ করে সমাজ নিজেদের সামাজিক ‘কর্তব্য’ ফেসবুকে পোস্ট করে। তারপর? সেই শিশুর বেড়ে ওঠার সংস্কৃতি, কলেজে পড়ার সমান সুবিধা, বৃহদাংশের ‘নর্মাল’ বন্ধুদের ঠাট্টা থেকে মুক্তি নিশ্চিত হলো কি না, তা কোন আইন বলে?
আরও পড়ুন: মুক্তি পেয়ে যায় ধর্ষকরা, হিংসা-পাচারের অন্ধকারে কেমন আছে ভারতীয় মেয়েরা?
ভারতজুড়ে হিজড়ে, খুসরা, তৃতীয় লিঙ্গ, সমকামী, রূপান্তরকামী বিভিন্ন নামের আড়ালে থাকা পরিচয়ের মানুষ কি আর পাঁচজন মূলধারার নাগরিকের মতোই স্বাধীন, চলাফেরায়, মতপ্রকাশে? ভারত যদিও ভীষণ মজার দেশ। দেশের ইতিহাস, পুরাণ, মহাকাব্য, এমনকী যে সব ‘মেনস্ট্রিম’ দেবদেবী আছে, সর্বত্রই ভিন্ন যৌন পরিচয়ের মানুষদের কথা লিখিত। ভারতীয় সংস্কৃতি বলে যদিও নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা যায় না তার বৈচিত্র্যের কারণে, তবু ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তনে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ ব্যক্তিদের উপস্থিতি ও ভূমিকা অত্যন্ত স্পষ্ট। বাৎস্যায়নের কামসূত্র হোক বা বাল্মীকি রামায়ণ, শিবের অর্ধনারীশ্বরের দেহে একই সঙ্গে স্তন ও পুংলিঙ্গ, বৈচিত্র্য। মুঘলদের প্রশাসনিক দায়িত্ব বা হারেমের নিরাপত্তা- সবেতেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ভূমিকা স্পষ্ট। ঔপনিবেশিক শাসনে স্বাভাবিক যৌন বৈচিত্র্যকে ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার ছাঁকনিতে ঢালা হলো। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরুয়াতের দিনগুলোতেই ভারতীয় দণ্ডবিধিতে লর্ড ম্যাকোলের তৈরি করা ৩৭৭ ধারা এল। ‘প্রকৃতির বিরুদ্ধে’ শারীরিক মিলনকে অপরাধ করে দেখা হল ব্রিটিশ দৃষ্টি দিয়ে।
গত শতকের পাঁচের দশকের শুরুতেই হিজড়েদের নির্মূল করার জন্য বিভিন্ন কৌশলের কথা ভাবে ব্রিটিশরা। এতকাল যে পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, তা ক্রমেই ‘অস্বাভাবিক’ হয়ে সমস্যায় পতিত হলো। হিজড়েদের ‘অপরাধী উপজাতি' আইনে (১৮৭১) অন্তর্ভুক্ত করা হলো এবং ‘অপরাধপ্রবণ উপজাতি’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হলো। মধ্যরাতে যখন ভারতের স্বাধীনতার সূর্য উঠিল, তখন কি পরাধীন ভারতে প্রবর্তিত আইনকে নস্যাৎ করা হলো? ১৮৬১ সালের ৩৭৭ ধারা বাতিল হলো ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতাকে অপরাধ বলা ভারতীয় দণ্ডবিধির (IPC) ৩৭৭ ধারা বাতিল করে। আর তার ৪ বছর আগে, ২০১৪ সালের এপ্রিলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয়। অপরাধী না হওয়ার আইনি স্বীকৃতি পেতে যে দেশের লেগেছে ৭১ বছর, সেই দেশ মানসিকভাবে প্রকৃত আজাদ হতে কত সময় চাইবে, এই হিসেব আলোকবর্ষের হিসেব-সংখ্যার ধারেকাছে হলেও অবাক হব না।
স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশে ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার অবসানও ঘটে যাওয়ার কথা ছিল। তবে ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার হিসেবে তা নির্লজ্জভাবেই অব্যাহত। তৃতীয় লিঙ্গের সামাজিক প্রান্তিকতা শুধু নয়, পুলিশি নির্যাতনের কথা কারও অজানা নয়। ভারত যে সংবিধান মেনে চলার কথা বলে, তা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে সমতা, স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের কথা বলে, কিন্তু ৭৫ বছরেও তা ফাঁপা শব্দের মতো দেশের উপকূল, পর্বত, জঙ্গল, জলাভূমিতে ধাক্কা খেয়ে গোঙায়। যৌন পরিচয়ের ভিন্নতার নিরিখে মানবাধিকার লঙ্ঘন খুবই আম বিষয়। ট্রেনে হিজড়ে দেখলে বাচ্চাদের মুখ জোর করে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া, ভয় তৈরি করার কাজগুলি ভারতের ব্যাপক জনসংখ্যায় অবদানকারী অভিভাবকদের ৮০ শতাংশই করে থাকেন। সেই সন্তানের প্রশ্ন বা কৌতূহল ধামাচাপা পড়ে যায়। কলেজে গিয়ে নরম ছেলে দেখলে টিটকিরি মারার অভ্যাস সেই ট্রেনেই বোনা হয়ে যায়, রূপান্তরকামীদের কখনই সাধারণ ভাবতে না পারার ভাবনা সেই ট্রেনেই প্রোথিত হয়ে থাকে। ভয় সর্বত্র ভক্তি আনে না, কোথাও ঘেন্নাও আনে।
কিছু মহানগর বা আলোকপ্রাপ্ত স্থানে শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত রূপান্তরকামীদের স্বাধীনতার সূর্য অনেক কষ্টে যাহবা উদিত হতে পারছে একটুআধটু, ইন্ডিয়া যে ভিলেজে প্রাইমারিলি বসবাস করে বলে জানা যেত, সেখানে অবস্থা তথৈবচ। সরকার রূপান্তরকামীদের জন্য বিশেষ পরিচয়পত্রের কথা বলে, যা স্পষ্টতই প্রমাণ করে ‘ওরা-আমরা’ নীতি। ২০১৬ সালে পাস হওয়া রূপান্তরকামীদের অধিকার বিল রূপান্তরকামীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যকে বেআইনি বলে ঘোষণা করে। এই বিলে রূপান্তরকামীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ‘সুবিধাবঞ্চিত’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে দেশ। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৭ সালে ঘোষণা করে যে, গোপনীয়তার অধিকার সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং রূপান্তরকামীদের যৌন অভিমুখও গোপনীয় রাখা এখন সুরক্ষিত। অর্থাৎ প্রান্তিকদের জন্য ‘স্কিম’। সমস্যার গোড়ায় না গিয়ে পাতায় জল ঢালা। যেখানে শিক্ষা ও চাকরিই পেতে দেওয়া হয় না, সেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রূপান্তরকামীরা ক্ষমতাহীন হয়ে থাকবে, তাই স্বাভাবিক। শুধুই তো রূপান্তরকামী বা অন্য যৌন পরিচয় নয়, তার সঙ্গে জুড়ে থাকে শ্রেণিপরিচয়। মুসলিম রূপান্তরকামী হলে এক আচরণ, দলিত রূপান্তকামী হলে আরেক। মুসলিম দরিদ্র রূপান্তরকামী হলে এক, উচ্চবিত্ত হিন্দু হলে আরেক, দলিত প্রতিবন্ধী রূপান্তরকামী হলে… ভারতের সংবাদপত্র এই ঘটনার পরিণতিগুলো জানে, শব্দ বাড়িয়ে কী লাভ।
ফলত, আজাদির যে অমৃত মূলধারার জন্য মহোৎসব, তা অন্য ধারার জন্য গরলসমান। আর এই বৈচিত্র্য স্বাধীনতার ৭৫ কেন, তারও পরে বিভেদই থেকে যাবে। বিভেদ হলেই রাষ্ট্রের সুবিধা, ঐক্য সততই জোট বাঁধার কথা বলে। ঘৃণা দিয়ে তৈরি হওয়া বিভেদ আমাদেরই সহনাগরিকদের ওষুধ পেতে দেয় না, মনমতো খাবার খেতে দেয় না, স্কুলে পড়ার সুযোগ দেয় না, চাকরিতে অন্য লিঙ্গ দেখে তাড়িয়ে দেয়, মানুষ হয়ে উঠতে দেয় না। চিত্ত যেখানে বিভেদপূর্ণ, সেখানে স্বাধীনতার শির উচ্চ হবে কেমনে? ৭৫ বছরের প্রশ্নের উত্তর একদিন সংবিধান ঘেঁটে উঠে আসবেই।