একে একে গুম হচ্ছেন বালুচ মহিলারা! বালুচিস্তান আন্দোলন দমনে পাকিস্তানের নয়া কৌশল?

Baloch women in Balochistan Movement: গত ২৯ মে ভোরে, বালুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ বছর বয়সি গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের ছাত্রী মাহজাবীন বালুচকে পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার কর্পস এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কর্মীরা জোর করে আটক করে।

পাকিস্তানি প্রশাসনের একটি 'সিগনেচার' কৌশল ছিল বালুচ বিদ্রোহ দমনের। দীর্ঘদিন ধরেই বালুচ পুরুষ, শিশু এবং বয়স্কদের উপর এই নির্মম কৌশল ব্যবহার করে এসেছে পাকিস্তান। এবার, এই কৌশলের শিকার হচ্ছেন মহিলারাও। বালুচিস্তান প্রদেশ, যেখানে বালুচ বিদ্রোহীরা স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন মহিলারা। অস্ত্রের নাম গুম করে দেওয়া। জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া, তারপর সেই মানুষটির কোনও খোঁজ না পাওয়া। ২৪ বছরে মাহজাবীন বালুচ, পাকিস্তানি রাষ্ট্রের এহেন দমন-পীড়নের সর্বশেষ শিকার। মে মাসের শেষ সপ্তাহে মাহজাবীনকে অপহরণ করা হয়।

মাহজাবীনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা এক দীর্ঘ তালিকায় সংখ্যাবৃদ্ধি মাত্র। গত মার্চ মাসে বালুচিস্তানের নেত্রী মাহরাং বালুচকে আটক এবং পরবর্তীতে তাঁকে গ্রেফতারের পর থেকে, অশান্ত বালুচিস্তান প্রদেশে মহিলাদের লক্ষ্যবস্তু করার সংখ্যা বেড়েছে। বালুচ মহিলা ফোরাম বলেছে বালুচিস্তানে ঘটতে থাকা মানবাধিকার লঙ্ঘন বৃদ্ধির এ এক নিকৃষ্ট উদাহরণমাত্র। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের (OHCHR) কার্যালয় বলেছে, "রাষ্ট্রের এজেন্টদের মাধ্যমে অথবা রাষ্ট্রের অনুমোদন পাওয়া, সমর্থন পাওয়া বা রাষ্ট্রের সম্মতিতে কাজ করা কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি কাউকে গ্রেফতার, আটক, অপহরণ বা অন্য কোনও মাধ্যমে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে, তারপরে স্বাধীনতা বঞ্চিত করার বিষয়টি স্বীকার করতেও অস্বীকার করে বা নিখোঁজ ব্যক্তির অবস্থান গোপন করে" তাহলে তাকে গুম করা বলা যেতে পারে।

আরও পড়ুন- সন্ত্রাস নাকি স্বাধীনতার লড়াই? কেন বারবার রক্তাক্ত বালুচিস্তান?

মাহজাবীন বালুচ

বালুচিস্তানে এই গুম হওয়ার ইতিহাস দীর্ঘকালের। অনেকেই এখানে বহু বছর ধরে নিখোঁজ, কেউ কেউ দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে নিখোঁজ। কারও কারও মৃতদেহ পাওয়া গেছে বহু বছর পর, কাউকে জনমানবহীন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়েছে, কাউকে কবর দেওয়া হয়েছে। এতকাল সাধারণত শিশু, পুরুষ এবং বৃদ্ধদেরই গুম করা হতো। তবে বালুচ সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কার্যকলাপ যত তীব্র হয়েছে, ততই পাকিস্তান কর্তৃক বালুচ মহিলাদের জোর করে গুমের প্রবণতাও দেখা গিয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসি মে মাসেই স্বীকার করেছিলেন যে, "বিশেষ করে রাতের পর থেকে বালুচিস্তানের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাচ্ছে"। এই সুযোগ নিচ্ছেন পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনির।

গত ২৯ মে ভোরে, বালুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ বছর বয়সি গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের ছাত্রী মাহজাবীন বালুচকে পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার কর্পস এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কর্মীরা জোর করে আটক করে। মাহজাবীনকে কোয়েটার সিভিল হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর মাহজাবীনের কোনও খোঁজ নেই বলে জানাচ্ছে, দ্য বালুচিস্তান পোস্ট।

মাহজাবীনকে আটক করার কয়েকদিন আগেই তাঁর ভাই, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র মুহাম্মদ ইউনূসকে মধ্য বালুচিস্তানের বাসিমা শহরে তাঁদের বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার হয়। সন্ত্রাসবিরোধী বিভাগ (সিটিডি) এবং ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) কর্তৃক পরিচালিত নৈশ অভিযানের সময় ইউনূসকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।

মাহজাবীনের পরিবার জানিয়েছে, "নিরাপত্তা বাহিনী বারবার আমাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। আমাদের প্রিয়জনদের বিছানা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাঁদের বিকৃত দেহ জনমানবহীন জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে... অনেকেরই এখনও কোনও খোঁজ নেই"।

মাহরাং বালুচ

আরও পড়ুন-বিশ্বাসঘাতকতার সাত দশক! কেন বালুচিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়?

বালুচিস্তানে দমনমূলক গুম করার ইতিহাস

বালুচিস্তানের এই পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আন্দোলনের নেপথ্যে আছে ১৯৪৮ সালে মুহম্মদ আলি জিন্নাহ-র এক বিশ্বাসঘাতকতা। স্বাধীনতার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও কালাত খানকে পাকিস্তানে যোগদানের জন্য জোর করা হয়েছিল।

বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে, বালুচিস্তান এক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বালুচ জনগণ পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণ এবং চিনের শোষণের বিরুদ্ধে এবং চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত নিজেদের স্বার্থের জন্য আন্দোলন করছে। এই বিচ্ছন্নতাবাদী আন্দোলনকে দমাতেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনী জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করে দেওয়াকে এক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বহু বছর ধরেই পুরুষ, শিশু এবং বয়স্ক মানুষদের বালুচ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে বা রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচক সন্দেহে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এই গুমগুলির মধ্যে আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই অপহরণ, তারপরে নির্যাতন এবং কিছু ক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও জড়িত। এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ হলেন আব্দুল গাফফার ল্যাঙ্গোভ। তিনি বালুচ জাতীয়তাবাদী এবং সমাজকর্মী মাহরাং বালুচের বাবা। ২০০৯ সালে অপহৃত হওয়ার পর, ২০১১ সালে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। সারা দেহে ছিল তীব্র নির্যাতনের চিহ্ন। এই জাতীয় মৃতদেহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফেলে রাখা হয়, অন্যদের জন্য সতর্কতা হিসাবে। মৃতদেহগুলি শনাক্ত করারও অযোগ্য অবস্থায় থাকে।

বলপূর্বক অন্তর্ধান কমিশনের (COIOED) মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বালুচিস্তানে ২,৭৫২টি বলপূর্বক অন্তর্ধানের ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও ভয়েস ফর বালুচ মিসিং পার্সনসের (VBMP) মতো মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলির দাবি, ২০০৪ সাল থেকে এই সংখ্যা ৭,০০০-এর কাছাকাছি।

মহল বালুচ

জাতিসংঘের বর্ণগত বৈষম্য নির্মূল কমিটিও ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সিন্ধু এবং বালুচিস্তান প্রদেশে জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের মধ্যে গুম হয়ে যাওয়ার বাড়তে থাকা হার সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে।

পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থা এতদিন পুরুষদের আটকে রাখত, গুম করে দিত, খুন করে দিত। তবে এবার বালুচ মহিলারাও বালুচ ইয়াকজেহতি কমিটির (বিওয়াইসি) মতো আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদে সরব হচ্ছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ফলস্বরূপ, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন মহিলারাও। এখানে উল্লেখ্য, সশস্ত্র প্রতিরোধের অংশ হিসেবে অনেক মহিলা বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) আত্মঘাতী বোমারুও হয়ে উঠেছেন।

অপহৃত মহিলাদের সঠিক সংখ্যা এখনও নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে, তালিকা ক্রমেই বাড়ছে। ৩২ বছর বয়সি চিকিৎসক তথা বিওয়াইসি নেতা মাহরাং বালুচকে ২২ মার্চ কোয়েটায় একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচির সময় তাঁর বোন মেহরান-ই-সারেং-এর সঙ্গেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারপর প্রায় ১২ ঘণ্টা কোনও খোঁজ মেলেনি তাঁদের। তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং হত্যার অভিযোগ আনা হয়।

উল্লেখ্য, বালুচ জনগণের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার সমাজকর্মী মাহরাং বালুচ বালুচিস্তানের মানুষের প্রতিরোধের এক প্রতীক। দেশের অন্যতম সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে ন্যায়বিচার, শিক্ষা এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলিকে সমর্থন করছিলেন মাহরাং। তাঁর অসীম সাহসই মাহরাংকে পাকিস্তানের নিশানায় নিয়ে আসে। মাহরাং বালুচকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পাকিস্তান ছেড়ে যেতেও বাধা দেওয়া হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাহরাং লিখেছিলেন, "কোনও আইনি বা বৈধ কারণ ছাড়াই আমাকে করাচি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অন্যায়ভাবে আটকানো হয়েছিল, যা আমার চলাফেরার স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।"

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ২৮ বছর বয়সি দুই সন্তানের জননী মহল বালুচকে কোয়েটায় তাঁর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়। মহলের ছোট ছোট কন্যাদেরও আটক করা হয়। ২০১৬ সালে মহলের স্বামীর মৃত্যুর পর ৮ এবং ৫ বছর বয়সি দুই মেয়ের একমাত্র অভিভাবক মহল। মহলের ননদ বিবি গুল, বালুচিস্তান প্রদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নথিভুক্তকারী বালুচ মানবাধিকার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপার্সন। পরিবারের সক্রিয়তার কারণেই, মহল বেশ কয়েকটি প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি, রাত ১১টায়, মহল বালুচের বাড়িতে ১২ জন নিরাপত্তা রক্ষী অভিযান চালায় কোনও ওয়ারেন্ট বা কোনও আইনি নথিপত্র ছাড়াই। বেআইনি অভিযানের পর, মহল বালুচ, তাঁর মা, ননদ, বোনঝি এবং দুই মেয়েকে জোর করে দু'টি গাড়িতে করে কোয়েটার স্পিনি রোডে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ডিপার্টমেন্টের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।

বেলুচিস্তানের মানবাধিকার কাউন্সিলের মতে, ১৮ ফেব্রুয়ারি, আটক করা অন্যান্য মহিলাদের ছেড়ে দেওয়া হয় এবং একটি নির্জন এলাকায় ফেলে রেখে আসা হয়। তবে মহলকে ছাড়া হয়নি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিদা জেহরিকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই তালিকাতেই প্রতিনিয়ত জুড়ে যাচ্ছেন বালুচিস্তানের সাহসিনীরা। তালিকা বাড়ছে।

More Articles