১৮ লক্ষ কোটি টাকার দেনা চাপিয়ে গেছেন হাসিনা? যে বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ
Bangladesh Economy: ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসেন তখন সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ ছিল মাত্র ২ লক্ষ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তদন্ত করে আওয়ামী লীগের ব্যাপক দুর্নীতির কথা ফাঁস করে। ৮০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে। আওয়ামী সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে কীভাবে কত কত টাকা নয়ছয় করা হয়েছে তারও হিসেব দেয় ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। শেখ হাসিনা সাড়ে পনেরো বছর বাংলাদেশ শাসন করেছেন। হাসিনা সরকারে থাকাকালীন, এমনকী ক্ষমতাচ্যুতির পরে সম্প্রতিও দাবি করেছেন আওয়ামী আমলে সেই দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, হাসিনা সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের খেসারত ১৮ লক্ষ কোটি টাকা! এই বিপুল পরিমাণ ঋণে বাংলাদেশকে জর্জরিত করে দিয়ে গেছেন হাসিনা। আর আখেরে উন্নয়ন হয়নি কিছুই।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো-তে এক প্রতিবেদনে উন্নয়ন গবেষক মইনুল ইসলাম দাবি করেছেন, সরকারি প্রকল্পের খাতে বরাদ্দ হওয়া তহবিল থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুঠ করেছেন হাসিনা, তাঁর পরিবার এবং আওয়ামী ঘনিষ্ঠ নেতা-ব্যবসায়ীরা। ২০২৪ সালের ৭ অগাস্ট বাংলাদেশের আরেক দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট পরিমাণ ১৮ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসেন তখন সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ ছিল মাত্র ২ লক্ষ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন- লাশ লুকিয়ে রাখার নির্দেশ! ছাত্র আন্দোলনে হাসিনার ভূমিকা নিয়ে কী বলছে জাতিসংঘের রিপোর্ট?
অর্থাৎ শেখ হাসিনার শাসনামলে ঋণ বেড়েছে ১৫ লক্ষ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে আসেন। আর এই ব্যাপক ঋণের বোঝা এসে পড়ে সাধারণ মানুষের মাথায়! মইনুল ইসলাম হিসেব দিয়েছেন, এই মুহূর্তে প্রতিজন বাংলাদেশির মাথায় এক লক্ষ টাকার বেশি ঋণের বোঝা রয়েছে। হিসেব বলছে, এই বিপুল পরিমাণ দেনার কারণে আগামী এক দশক অন্তত বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই যাবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শ্বেতপত্রে বিস্তারে জানিয়েছিল, কীভাবে সরকারের প্রতিটি উন্নয়ন মূলক প্রকল্প থেকে টাকা পকেটস্থ করেছেন হাসিনা, তাঁর পরিবার ও আওয়ামী ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মী বা ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ, হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৃদ্ধি ঘটানোর নামে সরকার একের পর এক বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করেছে। আর সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যেই লুকিয়েছিল দুর্নীতির আকর। প্রতিটি সরকারি প্রকল্পে যা প্রকৃত খরচ, তার চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে লক্ষ কোটি টাকা। এই টাকার সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, সরকারের প্রকল্পের নামে টাকা লুঠের নেতৃত্ব দিয়েছে অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলার।
ওই প্রতিবেদনে মইনুল দাবি করেছেন, বাংলাদেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোনও না কোনও আত্মীয়স্বজন জড়িত রয়েছেন, এই প্রকল্পগুলির খরচ ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অভিযোগ, গত দশ বছরে, প্রতি বছর বিভিন্ন উপায়ে দেশ থেকে ১২-১৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, হাসিনা আমলে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনও জানিয়েছিল, সবচেয়ে বেশি টাকা নয়ছয় হয়েছে ব্যাঙ্কিং ও অর্থনৈতিক খাতে। তারপরেই আছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং শেষ তথ্যপ্রযুক্তি খাত। সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত এবং আরও কয়েকটি দেশে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ। আর এত দুর্নীতি করেও দাবি করা হয়েছে যে বাংলাদেশের জিডিপি ক্রমেই বাড়ছে।
আরও পড়ুন- ক্ষমতায় থাকতে আসিনি, দায়িত্বপালন করে চলে যাব : শফিকুল আলম
মইনুল তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, হাসিনা সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রকের অধীন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্তন পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামালের নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে প্রকৃত তথ্য বিকৃত করা হয়েছে। প্রতিবছর জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখানোর জন্য দেশের মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে। দেশের রফতানি আয়কে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হারকে সব সময়ই কমিয়ে দেখানো হয়েছে। এমনকী দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যাকেও কম দেখানো হয়েছে, যাতে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানো যায়। দেশের জনগণের জন্মহার ও মৃত্যুহার কমিয়ে দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো যায়। পাশাপাশি দেশের ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেট’ কম দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার সফল হচ্ছে প্রচার করা যায়।
বাংলাদেশের একাংশের অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, যে ২৩৪ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে তা আর দেশে ফেরত আনা যাবে না। মূল্যস্ফীতিকেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো যাবে কিনা সেই নিয়ে সন্দেহ থাকছেই। সরকার পতনের আগে হাসিনার সরকার দাবি করেছিল, বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। সাম্প্রতিক বিদেশি একটি গবেষণা সংস্থা দাবি করেছে, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মোট জিডিপি বর্তমানে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে। ফলে বিপুল ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কীভাবে নতুন বাংলাদেশ প্রকৃত উন্নয়নের উদ্দেশে সফর করবে তা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সমস্যা মোকাবিলায় আদৌ দক্ষ তো? তা নাহলে বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎ ধোঁয়াশাতেই থেকে যাবে।