বিভুরঞ্জন সরকারের শেষ চিঠি, সাংবাদিকের অন্তিম পরিণতি তবে এই?
Bibhuranjan Sarkar: পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করেও নিজের আর্থিক বেহাল দশার হাল ফেরাতে পারেননি তিনি। তার কারণ সৎ, সাহসী এবং আপসহীন সাংবাদিকতা বলে বিভুরঞ্জন উল্লেখ করেছেন খোলা চিঠিতে।
২১ অগাস্ট সকাল ১০টা নাগাদ অফিস যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বের হন বাংলাদেশের 'আজকের পত্রিকা'-র সম্পাদকীয় বিভাগের সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার। তারপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। পরিবার তরফে এই মর্মে বৃহস্পতিবার রাতে থানায় জিডি করা হয়। এরপর শুক্রবার বিকেলে বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জের মেঘনায় সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মৃতদেহ পাওয়ার খবর দেয় পুলিশ। এই ঘটনায় স্তম্ভিত বাংলাদেশ। বিভুরঞ্জন সরকার নিখোঁজ হওয়ার আগে একটি 'খোলা চিঠি' লিখেছিলেন। সেখান থেকেই তাঁর এই মর্মান্তিক পরিণতির কারণ স্পষ্ট হয়। দারিদ্র্য, পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করেও নিজের আর্থিক বেহাল দশার হাল ফেরাতে পারেননি তিনি। তার কারণ সৎ, সাহসী এবং আপসহীন সাংবাদিকতা বলে বিভুরঞ্জন উল্লেখ করেছেন খোলা চিঠিতে।
এই ঘটনা সংবাদকর্মীদের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। ওই চিঠিতে বিভুরঞ্জন সরকার লিখেছেন, "আজকের দিনে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ অন্যরকম। অনেকেই সুবিধা, স্বার্থ, সামাজিক মর্যাদা বা আর্থিক স্বার্থের জন্য সত্যকে আড়াল করে লেখেন। আমি নাম আড়াল করলেও সত্য গোপন করিনি। তাই হয়তো দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে এই পেশায় কাটিয়ে সম্মানজনক বেতন-ভাতা পাই না।"

বিভুরঞ্জন সরকার
চিঠি থেকেই জানা যায় তাঁর ওষুধের খরচই মাসে ২০-২২ হাজার টাকা। সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের দিন শুরু হতো ওষুধ খেয়ে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিয়ে এবং ওষুধ কেনার টাকার চিন্তায়। আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো নানান অসুখে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। এদিকে ছেলেও অসুস্থ, তারও নিয়মিত চিকিৎসার খরচ রয়েছে। তাই ধার-দেনা ছাড়া উপায় নেই। শেখ হাসিনার দরবারে সাহায্যের আবেদন করেও কোনও সুরাহা মেলেনি বলে জানান তিনি। তাঁর অভিযোগ, অনেক সাংবাদিক জায়গা-জমি পেয়েছেন। কিন্তু তিনি দু'বার আবেদন করেও কোনো সাহায্য পাননি।
আরও পড়ুন- যুগে যুগে দেশের শত্রু নির্ভীক সাংবাদিকতাই?
বিভুরঞ্জন সরকারের চিঠি থেকেই সাধারণ সাংবাদিকদের আর্থিক পরিস্থিতির একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। দিন-রাত এক করে একনিষ্ঠভাবে একটা জীবন সাংবাদিকতার জন্য উৎসর্গ করে দেওয়ার মূল্য শুধুই হতাশা আর আর্থিক টানাপোড়েন! এই মুহূর্তে বাংলাদেশে একজন সাংবাদিক গড়ে ত্রিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করে বলে জানান সাংবাদিক আপন তারিক। বাংলাদেশের বাজারে জিনিসের যা মূল্য সেই তুলনায় এই আয় যে যথাযথ নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বছরের পর বছর একই বেতনে কাজ করে যান সংবাদকর্মীরা। অনেক ক্ষেত্রেই সাংবাদিকরা কাজ করেও বেতন পান না। এমনকি বেতন যে পান না, সেটাও লিখতে পারেন না।
আপন তারিকের অভিযোগ, সরকারের বেঁধে দেওয়া ওয়েজবোর্ড কেউ মানে না। চাকরি হওয়া-যাওয়া, বেতন বাড়া, সব মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে এই পেশাটি শক্ত জায়গায় যেতে পারেনি। মালিকরা যখন দেখে লাভ হচ্ছে না, তারা বন্ধ করে দেয়। এটা নিয়মিত হচ্ছে।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’-তেও ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের বাস্তবচিত্র। তিনি লিখেছেন, গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমের অবস্থা আরও কাহিল হয়ে পড়েছে। প্রধান উপদেষ্টা মন খুলে সমালোচনা করার কথা বললেও তাঁর প্রেস বিভাগ মনখোলা নয়। মিডিয়ার নির্বাহী দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা সবসময় আতঙ্কে থাকেন। কখন না কোন খবর বা লেখার জন্য ফোন আসে। তুলে নিতে হয় লেখা বা খবর। তাঁরও একটি লেখার জন্য ‘আজকের পত্রিকা’-র অনলাইন বিভাগকে লালচোখ দেখানো হয়েছে। যে কারণে পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক চাপ সইতে না পেরে তাঁর সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর কী করণীয় সেই প্রশ্নই বিভুরঞ্জন সরকার রেখেছেন সেই চিঠিতে।
আরও পড়ুন- যুগে যুগে দেশের শত্রু নির্ভীক সাংবাদিকতাই?
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ইনস্ক্রিপ্ট প্রশ্ন রাখে সাংবাদিক আলতাফ শাহনেওয়াজের কাছে। উত্তরে তিনি বলেন, "বিভুরঞ্জন সরকারের মতো নামি সাংবাদিকের মৃত্যু অবশ্যই দুঃখজনক। বিভুরঞ্জন সরকারের চিঠি পড়ে দেখা যায়, তাঁর যেমন ব্যক্তিগত হতাশা ছিল, তেমনই পারিবারিক টানাপোড়েন ছিল। এমনকি পেশাগত অবস্থান, বেতনাদি নিয়েও তাঁর মধ্যে অসন্তোষ ছিল, যা তাঁর চিঠিতে স্পষ্ট।"
তিনি আরও বলেন, "তবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম নিয়ে তাঁর চিঠিতে যে দাবি উঠে এসেছে, অনেক কিছুই লেখা যাচ্ছে না। আমি তা মনে করি না। এখানে যে ঘটনাটি আমাদের মনে রাখতে হবে তা হলো, শেখ হাসিনার শাসনামলে আমাদের মধ্যে যে সেলফ সেন্সরশিপের প্রবণতা তৈরি হয়েছিল, আমার মনে হয়, তা থেকে আমাদের সংবাদপত্র এখনও মুক্ত হতে পারেনি। ফলে আমারা এখনও হয়তো এমন করে ভাবছি যে এটা লিখলে যদি সমস্যা হয়! শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট মানুষজনও কিন্তু ভয়ংকর ট্রমার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে সাংবাদিকতা করতে হয়েছে আমাদের। ফলে বিষয়টি আমাদের আমল দেওয়া জরুরি। তারই সঙ্গে সরকার নির্ধারিত ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী সংবাদিকদের বেতন কাঠামো ঠিক হলে এবং সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট যথার্থভাবে কাজ করলে সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক সমস্যার কিছুটা সুরাহা হবে।"
আরও পড়ুন- প্রশ্ন করার সংস্কৃতি সাংবাদিকতা থেকে যে ভাবে হারাল…
এ'প্রসঙ্গে বাংলাদেশের আরেক সাংবাদিক আপন তারিক বলেন, "বিভুরঞ্জন সরকারকে নিয়ে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। মনটা জমে গেছে শূন্যতায়! এই অগ্রজ সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে- এটা আত্মহত্যা, নাকি তিনি কাঠামোগত হত্যার শিকার? চলে যাওয়ার আগে তিনি একটা খোলা চিঠি লিখেছিলেন, এই চিঠি শুধু বিভুদার নয়। এটা হাজারো সৎ, আপসহীন সাংবাদিকের অস্ফুট চিৎকার, একান্ত আত্মকথা। সেই আত্মহননের নোটে নামটা শুধু পাল্টাবে, গল্পটা হয়ে যাবে আপনার-আমার পরিচিত কোনো সৎ মানুষের। কারণ এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা একইভাবে সবাইকে ভেঙে ফেলে!"
বাংলাদেশের প্রবীণ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মর্মান্তিক পরিণতি প্রশ্ন তুলে দেয়, সংবাদকর্মীদের জীবনযাপন নিয়ে। তাঁর জীবনের শেষ লেখা, সেই খোলা চিঠি মিডিয়ার বাইরের চাকচিক্যময় রূপের ভেতরের অন্ধকার দিক উন্মুক্ত করে দেয়।

Whatsapp
