ঘনিয়ে আসছে 'কালো অধ্যায়'! ফের আচমকা কেন অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ?

Bangladeshi presidential election: ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, আদালতের রায়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে যথাক্রমে ৫ ও ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিগত প্রায় সাত-আট বছর ধরে আপাত শান্তি ও স্থিতিশীলতার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া বিরোধী দল বিএনপি আবার প্রবলভাবে রাজপথের আন্দোলনে ফিরে এসেছে. আর তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করার জন্য শাসক দল আওয়ামি লীগ কোনও চেষ্টাই বাদ দিচ্ছে না। আসলে বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর মাত্র বছরখানেক বাদেই। সেই নির্বাচনেও যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামি লীগ বিজয়ী হয় তাহলে টানা কুড়ি বছর দেশের ক্ষমতায় থাকতে পারবে তারা। আর সেই সম্ভাবনাকে যে কোনও মূল্যে ঠেকাতে বিরোধী বিএনিপি এখন মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপির জন্য এটা প্রায় অস্তিত্ত্ব বাঁচানোর লড়াই। তাদের সেই চেষ্টায় আড়াল থেকে সাহায্য করছে জামায়াতে ইসলামিও, নির্বাচন কমিশনের রায়ে যাদের নিজেদের প্রতীকে ভোটে লড়ার এক্তিয়ার নেই।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশটির পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা করার দুই দিন পর বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি (বিএনপি) যা ১৪ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে, রাজধানী ঢাকার গোলাপবাগে বিশাল বিক্ষোভ করে।

১০ ডিসেম্বর, ঢাকায় সমাবেশের আগে, হিংসা উসকে দেওয়ার অভিযোগে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা-সহ ৫০০ সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়। বেলা ৩ টের দিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং প্রাক্তন মন্ত্রী ও দলের শীর্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থার সদস্য মির্জা আব্বাসকে তাদের বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়।

সমাবেশের আগে ছিল রাজধানীতে তীব্র উত্তেজনা। বিএনপি বলেছিল, সারা দেশ থেকে কয়েক লক্ষ সমর্থক ওই সমাবেশে জমায়েত হবেন। সমাবেশের উপস্থিতি স্থানীয় গণমাধ্যমেও ‘উল্লেখযোগ্য’ বলে জানা গিয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে হাজার হাজার বিরোধী বিক্ষোভকারী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাস্তায় নামে। ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রী হাসিনা অবশ্য বারবারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপির দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, এটি রাষ্ট্রের সংবিধান পরিপন্থী।

আরও পড়ুন- ‘বাংলাদেশি বাবু’ ও ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর! দেশের সবচেয়ে বড় রহস্য আজও অধরা

এদিকে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের মঞ্চ থেকেই বিএনপির সাতজন সাংসদ পদত্যাগের ঘোষণা করেন। কড়া নিরাপত্তা সত্ত্বেও শুক্রবার রাত থেকেই বিক্ষোভকারীরা ঢাকার গোলাপবাগে প্রবেশ করতে থাকে।

“এলাকা নিরাপদ করতে প্রায় ৪ হাজার আনসার সদস্য কাজ করবে। এর আগেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আনসার সদস্য ও পুলিশ কর্মকর্তারা একসঙ্গে কাজ করেছে। এবার অনেক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নিয়োজিত রয়েছে”, এমনটাই সেদিন বলেছিলেন আনসারের জনসংযোগ প্রতিনিধি জাহিদুল ইসলাম।

বিরোধী নেতাকর্মীরা ‘ডাউন উইথ হাসিনা’ এবং ‘আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই’ সহ নানারকম স্লোগান দিতে থাকেন। এর আগে সপ্তাহের শুরুতেও সমাবেশকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টন এলাকায় পুলিশ ও বিএনপি কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে মকবুল হোসেন নামে এক ব্যাক্তি নিহতও হন। বিএনপি আয়োজিত রাজধানীতে এই গণবিক্ষোভে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জ্বালানির মূল্য এবং জীবনযাত্রার ব্যয় মোকাবিলায় হাসিনাকে ব্যর্থ বলে অভিযোগ করে।

১১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী হাসিনার প্রাক্তন জনসংযোগ অধিকর্তা আশরাফ সিদ্দিকী বিটু বাংলা ট্রিবিউনে লেখেন, “বিএনপি কি তাদের অতীত ভুলে গেছে? তাদের মানুষ পুড়িয়ে মারা, বাসে ট্রেনে লঞ্চে আগুন দেওয়া ভুলে গেছে? বিএনপি ভুলে গেলেও রাজনীতি সচেতন কোনও মানুষ এখনও ভোলেনি। রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ, প্রতিবাদকে সহিংসতা বা বর্বরতায় পরিণত করেছিল বিএনপি।”

আসলে ২০০১-০৬ সালের সময়কালকে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই সময়কালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামি-সহ ৪-দলীয় জোট সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বড় আকারের দুর্নীতি বিকাশ লাভ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শাসনামলে তাঁর দুর্নীতিগ্রস্ত পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণেই বাংলাদেশ ৫ বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ভুগছে বলে রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতি উপলব্ধি সূচক (সিপিআই) দ্বারা রিপোর্টে এই সব দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আরাফত রহমান কোকোকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করেছিল জার্মান সংস্থা সিমেন্সও। কোকোকেও ২০১১ সালে বাংলাদেশের একটি আদালত অনুপস্থিতিতে দোষী সাব্যস্ত করে এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের জন্য ৬ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।

২০০৮ সালের ৩ জুলাই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা করা হয় রমনা থানায়। খালেদা জিয়া, তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমান সহ চারজনের বিরুদ্ধে অনাথদের অনুদান হিসেবে বিদেশি ব্যাঙ্ক থেকে অনুদান হিসেবে আসা ২১ মিলিয়ন টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে ২০১০ সালের  ৫ অগাস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, আদালতের রায়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে যথাক্রমে ৫ ও ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন- শেখ হাসিনার ‘হাঁড়িভাঙা আম’ উপহার, কূটনীতি আমোদে দিল্লি-ঢাকা মাতোয়ারা

২০১১ সালের ৮ অগাস্ট তেজগাঁও থানায় হয় আরেকটি মামলা। মামলাটি ছিল খালেদা জিয়ার প্রয়াত স্বামী ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামে একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠনের আড়ালে প্রায় ৩১.৫৫ মিলিয়ন টাকার অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে সম্পর্কিত। তারপর খালেদা জিয়া সহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়।

এই পটভূমিতেই আওয়ামি লীগ দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিরোধী দলের গণবিক্ষোভের পরের দিন বলেন, “কত হাকডাক সরকার পতনের, কত যে দিবা স্বপ্ন… খেল যে অবশেষে খতম, এই খেলা শেষ হয়ে গেছে কোয়ার্টার ফাইনালে... শেখ হাসিনার আওয়ামি লীগ বিজয়ী হয়েছে।”

আবার এর পাল্টা জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বললেন, “এটাকে যদি খেলা বলা হয় তাহলে আমরা জাতীয়তাবাদী দল এই খেলাতে বিশ্বাস করি না, আমরা রাজনীতি করি। জনগণ রায় দিয়েছে এই সরকারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে।”

অন্যদিকে আবার, সাধারণ জনগণের দাবি বেশ অন্য। তারা কোনও এক পক্ষের দিকেই ঝুঁকে নেই। বাংলাদেশের নাগরিক রোকেয়া বেগম বলেন, “আমাদের খাবার দাবারের, ঔষধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকুক। অসহায় জনগণের ক্ষুধার্ত অবস্থার অবসান হোক। বেকার সমস্যার সমাধান হোক। শান্তি-শৃঙ্খলা চাই। অশান্তি চাই না।”

 

More Articles