পাশে দাঁড়ানোর আর্তি নয়, নিজের জোরে এপার বা‌ংলাকে টেক্কা দিচ্ছে বাংলাদেশের সিরিজ ও সিনেমা

এই বাংলাতেও ধীরে ধীরে ওপারের সিরিজ নিয়ে তৈরি হচ্ছে আকর্ষণ। 'হইচই'-এর মতো নামজাদা ওটিটি প্ল‍্যাটফর্ম আলাদা করে বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজের জন্য খুলে দিচ্ছে পরিসর।

সাল ১৯৭১, বদলে গিয়েছিল বাংলার সমীকরণ। জন্ম নিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধর অবিরল রক্তক্ষরণ, নারকীয় অত্যাচারের মুখে দাঁড়িয়েও পিছু হটেনি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ, জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। দুই দশকেরও বেশি সময় আগে ভাগ হয়ে যাওয়া বাংলা কিছুদিনের জন্য মিলে গিয়েছিল মননে। এপার বাংলা আশ্রয় দিয়েছিল ওপার বাংলাকে। ধ্বনিত হয়েছিল 'জয় বাংলা' স্লোগান।

আজ পশ্চিমবঙ্গের সা‌ংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের অহংকার। কিন্তু এই অহংকারই আমাদের আমাদের চারপাশে থাকা আরও অনেক মূল্যবান জিনিসকে হেয় করতে শেখায়। আমাদের অনেকেরই বাংলাদেশকে হেয় করার এক প্রছন্ন মানসিকতা আছে, বা বলা ভালো ছিল। কথায় পূর্ব বাংলার টান থাকলে মজার খোরাক হতে হয়েছে অনেককে। কিন্তু ধীরে ধীরে চিত্র বদলাচ্ছে, বদল আসছে এপার আর ওপার বাংলার সমীকরণে। আর এখানেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজ ও সিনেমা।

চলচ্চিত্রের কাজে বাংলা যে এগিয়ে তা প্রায় সবাই জানে। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের নাম বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উজ্জ্বল। আমরা তা নিয়ে গর্বিত হলেও সেই চলচ্চিত্রর মান বজায় রাখতে ব্যার্থ। অন্যদিকে বাংলাদেশ কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়েছে অনেকটাই, আর তার প্রভাব পড়ছে এই পারেও। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের এমন উন্নতি সত্যি চোখে পরার মতো। কিন্তু প্রয়োজন সহযোগিতার, দরকার উপযুক্ত সমর্থনের।

আরও পড়ুন: বাংলা সিরিয়ালের তিন দশক || কী ছিল কী হইল…

এদেশের সিনেমা, সিরিয়াল, ওয়েব সিরিজ দখল করে আছে বাংলাদেশের বাজার, ওইপারের সিনেমাকে তাই সরিয়ে জায়গা দেওয়া হয় এই পারের সিনেমাকে। আজ সত্যি বলতে, আমরা কতজন বাংলাদেশের ক'টা সিনেমার নাম জানি? ক'জন তারকার নাম জানি? জয়া আহসানের মতো কেউ কেউ টলিউডে না এলে কি তাঁকে চিনতাম আমরা?

কিন্তু এই ছবি বদলাচ্ছে। কয়েক বছরে প্রকাশিত বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজ ও সিনেমা সত্যি তাক লাগিয়ে দিয়েছে। মোস্তাফা শারোয়ার ফারুকী-র 'টেলিভিশন', নুর ইমরান মিঠু-র 'কমলা রকেট' বা আবু শাহেদ ইমানের 'জালালের গল্প' ধারণা পাল্টাচ্ছিল ক্রমে। এখন তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে 'হাওয়া'-র মতো ছবি, বা 'মহানগর', 'তাকদীর', 'ষ', 'শাটিকাপ', 'ঊণলৌকিক'-এর মতো ওয়েব সিরিজ। এত নিখুঁত প্লটের বুনন, অভিনয় এককথায় অসাধারণ। আর সবথেকে বড় বিষয় হলো, এই সিনেমা ও ওয়েবসিরিজগুলো পরিচিতি পাচ্ছে। এমনকী, এই বাংলাতেও ধীরে ধীরে ওপারের সিরিজ নিয়ে তৈরি হচ্ছে আকর্ষণ। 'হইচই'-এর মতো নামজাদা ওটিটি প্ল‍্যাটফর্ম আলাদা করে বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজের জন্য খুলে দিচ্ছে পরিসর। নানারকম বিষয় নিয়ে তৈরি হচ্ছে সিনেমা। তৈরি হচ্ছে নানা নতুন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম- বঙ্গ, চরকি ইত্যাদি। ক্ষেত্রবিশেষে এখানকার সিনেমা-সিরিজের মতো হয়তো অত জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশনা নয়, কিন্তু সাধারণভাবে দর্শকদের মন জয় করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখছে এই কাজগুলো।

Unoloukik

'ঊনলৌকিক' সিরিজের পোস্টার

বাংলাদেশের কিছু বিখ্যাত বিখ্যাত ওয়েব সিরিজ সত্যি বলতে এখানকার সিরিজকেও হার মানিয়ে দিতে বাধ্য। হইচই-এর মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে ওয়েব সিরিজ 'তাকদীর', 'ঢাকা মেট্রো', 'বলি' এছাড়াও প্রায় ২০টিরও বেশি ওয়েব সিরিজ পরিচালনা করার কথা আছে। প্রত্যেকটি গল্পেরই আছে স্বতন্ত্রতা। 'ডুব', 'লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান'-এর মতো সিরিজ এককথায় না দেখলে বড় মিস। মুস্তাফা শারোয়ার ফারুকী, মোহাম্মাদ তৌকির ইসলাম, রবিউল আলাম রবির মতো পরিচালকের কাজ ইতিহাস তৈরি করছে।

চরকি, বঙ্গ, সিনেম‍্যাটিক অ্যাপে প্রকাশিত হয় এই ওয়েব সিরিজগুলি। এই প্ল্যাটফর্মগুলির কিছু বিখ্যাত বিখ্যাত কাজ সবার দেখা দরকার, যা বাংলাদেশের সিনেমা আর পরিচালকদের প্রতি অনেকটা বাড়িয়ে দেবে। 'মহানগর', কাইজার', 'সাবরিনা', 'শাটিকাপ', 'অগাস্ট ১৪'-র মতো সিরিজগুলো দেখলে হাঁ হয়ে যেতে হয়, প্লটের বুনন ঘোরানো হলেও দর্শককে হারিয়ে যেতে হবে না, প্রত্যেকটা শটে এত নিখুঁত কাজ, এত ঘোর-প্যাঁচ সত্ত্বেও শেষ অবধি গল্পের খেই হারিয়ে না ফেলার মতো এত দক্ষতা চমকপ্রদ। বাংলাদেশের কাজের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, একটা মাটির গন্ধ সেখানে থাকে, অর্থাৎ, দেশটার মতোই স্নিগ্ধ, কোমল একটি পরিবেশনা- যা মনকে তৃপ্তি দেয়। এই সিরিজগুলো দেখে এই পারের পরিচালকরা কি কিছু শিখবেন? এখানকার সব সিরিজই এখন অতিরিক্ত রঙচঙে, নয়তো যৌনতার ঘেরাটোপে বন্দি, ভালো গল্পের সিরিজ আর কোথায় এখন? কিন্তু বাংলাদেশ সেই দিক থেকে ছক্কা মারছে। আমাদের সামনে তুলে ধরছে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ সব গল্প, তাই বাংলাদেশের সিরিজ নিয়ে তৈরি হছে আশা।

Kaiser poster

'কাইজার'-এর পোস্টার

আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙাল ভাষা এতটা উন্মাদনা কিন্তু চোখে পড়ত না। কিন্তু এখন যে কোনও বাংলা মিম, বাংলা পোস্টে বাঙাল ভাষার এক স্বচ্ছন্দ ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। এইপারের ইউটিউবাররাও আজকাল বাংলাদেশের সিরিজ-সিনেমা নিয়ে রিভিউ দিচ্ছেন, সিরিজ-সিনেমার ছোট ছোট ক্লিপিংস পোস্ট হচ্ছে, ব‍্যবহার হচ্ছে- এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে ধীরে ধীরে কলকাতার বাজার দখল করছে পূর্ব বাংলার চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের তারকাদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে ক্রেজ। তাশান, চঞ্চল চৌধুরী, আরফান নিশো অপূর্ব মন জয় করছেন এপারের বাঙালিদের, কিন্তু তা তাঁদের চেহারার জোরে নয়। বরং তাঁদের অভিনয় নজর কাড়ছে সবার। নায়িকাদের মধ্যে মেহাজ্জাবেইন চৌধুরী, মাহিয়া মাহি এখানকার দর্শকদের পছন্দের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন।

কিন্তু এত ভালো কাজের পরেও বাংলাদেশের সিরিজের জনপ্রিয়তার পথে কিছু বিষয় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হলো বাজেট। যার ফলে অনেক সময়ই প্রযোজনা সেই পর্যায়ে পৌঁছতে পারছে না, ঘাটতি দেখা যাচ্ছে পারদর্শিতায়। ক্যামেরার কাজ বা প্রোডাকশনের কাজে ঘাটতি থাকছে, কিন্তু সেইটুকু যদি অতিক্রম করা যায়, তাহলে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। অল্প বাজেটেও এত সুন্দর কাজ সত্যি কল্পনা করা যায় না। এখানকার খুব কম পরিচালক-প্রযোজকই এত কম বাজেটে এত নিখুঁত কাজ দিতে পারবেন! এত পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ সিরিজই এখন মান বজায় রাখতে পারে না। যারা সত্যি ভালো বাংলা ওয়েব সিরিজ দেখতে চায়, তাদের জন্য বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজ সত্যি অনবদ্য। ওপার বাংলা যদি তাদের কাজের মান ধরে রাখতে পারে, তাহলে এই পারের সিরিজকে টেক্কা দিয়ে মাইলস্টোন রচনা করতে আর বেশি দেরি নেই তাদের।

More Articles