ফেলানি খাতুন থেকে স্বর্ণা দাস! যেভাবে সীমান্তে বারবার প্রাণ যায় সাধারণ বাংলাদেশিদের...
Bangladesh Border Killings: চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে অন্তত ১৮ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৮, ২০২২ সালে ২৩ এবং ২০২১ সালে ১৬।
সীমান্তের রাত। ১ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের ১৪ বছর বয়সের ছাত্রী স্বর্ণা দাস অপেক্ষা করছিল সীমান্ত পেরনোর। বাংলাদেশ আর ভারতের ওই কাঁটাতার পেরিয়ে ত্রিপুরা ঢুকবে সে। একা নয়। স্বর্ণার সঙ্গে ছিলেন তাঁর মা। কাঁটাতার পেরোতে টাকা দিয়েছেন তারা। কড়কড়ে ৫০০০টাকা দিয়েছেন এজেন্টদের। এই এজেন্টরাই সাহায্য করবেন তাঁদের দেশ পেরোতে। ত্রিপুরার ধর্মনগর শহরে মামার বাড়ি স্বর্ণার। স্বর্ণাদের বাড়ি ত্রিপুরা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের মৌলবীবাজার জেলার কালনিগড় গ্রামে। স্বর্ণার মা রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরোতে চাননি। এজেন্টরা অবশ্য এই বেআইনি কাজ রাতেই করেন। কাঁটাতারের বেড়ার কাছে পৌঁছে স্বর্ণা আর তাঁর মা চিৎকার করে ওপারের নিরাপত্তারক্ষীদের বলেছিলেন গুলি না চালাতে। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যরা মা মেয়ের ভাষা বুঝতে পারেনি। বিএসএফ গুলি চালিয়ে দেয়।
গুলি খায় স্বর্ণা। তাঁর দেহটি নিয়ে যায় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। স্ক্রোল ডট ইন-এর এক প্রতিবেদন বলছে, স্বর্ণার ভাই পিন্টু দাস জানিয়েছে, তাঁদের মাকে এজেন্টরাই উদ্ধার করেছিল। কীভাবে তাঁর মা বেঁচে গেলেন প্রাণে, তা তাঁর মনেও নেই। অনেক প্রতিবেদনেই বলা হচ্ছে যে, বছর ১৪-র স্বর্ণা বৈধ নথিপত্র ছাড়াই ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন। সেই সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশই গুলি চালিয়ে তাঁদের হত্যা করেছে। তবে স্বর্ণা দাসের পরিবারের সদস্যদের দাবি, ভারতের দিক থেকে চলা গুলিতেই প্রাণ গিয়েছে স্বর্ণার। পিন্টু বলছে, “মা আমাকে বলেছিল যে সীমান্তের ওপার থেকে গুলি চলতে দেখেছে। বিএসএফ কোনও সতর্কবার্তা দেয়নি। সম্পূর্ণ অন্ধকার ছিল তখন।”
এই ঘটনার আট দিন পরে, আরেক ১৪ বছর বয়সি জয়ন্ত কুমার সিং, বাবার সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করলে বিএসএফ-এর গুলিতে প্রাণ হারান। ঢাকার এক মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে অন্তত ১৮ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৮, ২০২২ সালে ২৩ এবং ২০২১ সালে ১৬।
আরও পড়ুন- ১০০ দিনে পূরণ কোন কোন প্রতিশ্রুতি? জনতার প্রত্যাশা মেটাতে পারল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার?
ফেলানি খাতুনকে মনে আছে? ২০১১ সালে সীমান্তে দশ বছরের এই মেয়ের লাশ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছিল সীমান্ত নিরাপত্তাকর্মীরা যাতে ভয়ে কোনও বাংলাদেশি আর সীমান্ত ডিঙোতে না আসেন। গত অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ভারতে প্রবেশ করতে গিয়ে সীমান্তে আটজন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলো। নিহতদের মধ্যে দু'জন হিন্দুও রয়েছেন। যদিও তাদের কেউই বাংলাদেশের হিংসাকালীন নিপীড়ন থেকে প্রাণে বাঁচতে পালাচ্ছিলেন বলে জানা যায়নি। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সমর্থকসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক ঢাকা থেকে ভারতে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলেও জানা গেছে।
সমাজকর্মীরা বলছেন, সীমান্তের পরিস্থিতি ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ-এর বাড়াবাড়ির অভিযোগ বিষয়ে তদন্তকারী কলকাতার এক সংস্থার সম্পাদক কিরীটি রায় বলছেন, "যদি কেউ সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করে, তাদের গুলি করা হয়। যদি তারা লুঙ্গি (সাধারণত মুসলিম পুরুষের পরিধেয়) পরে থকেন তাহলে গুলি খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।”
সীমান্তে একের পর এক হত্যার প্রতিবাদে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। অথচ ভারত বাংলাদেশ সরকারকে সংখ্যালঘু এবং তাদের উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। স্বর্ণা দাসের হত্যার পর ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে প্রথম প্রতিবাদ উঠে আসে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠানো প্রতিবাদ পত্রে বাংলাদেশ এই ধরনের ‘নির্মম কর্মকাণ্ডের’ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সীমান্তের হত্যাকাণ্ডগুলি সীমান্ত কর্তৃপক্ষের জন্য যৌথ ভারত-বাংলাদেশ নির্দেশিকা, ১৯৭৫-এর বিধি লঙ্ঘন করছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "যেকোনও দেশের নাগরিকই বৈধ কাগজপত্র ছাড়া একে অপরের ভূখণ্ডে প্রবেশ করলে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাদের নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত নয়।" এর পাঁচ দিন পর, ঢাকা ভারতীয় হাইকমিশনে আরেকটি চিঠি পাঠায় যাতে ভারতকে সীমান্ত সংক্রান্ত সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে, দায়ীদের চিহ্নিত করতে এবং তাদের বিচার করতে আহ্বান জানায়।
সীমান্তে কুমিল্লার এক বাসিন্দাকে হত্যার পর গত ৯ অক্টোবর তৃতীয় চিঠি পাঠানো হয়। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স দাবি করে, ওই ব্যক্তি একজন সশস্ত্র 'মাদক চোরাচালানকারী' ছিলেন। নিষিদ্ধ পণ্য ভারতে পাচারের চেষ্টার সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক গত ৫ অগাস্ট থেকেই উত্তাল। বাংলাদেশ মনে করে, ভারত ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘদিনের সমর্থক। বাংলদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হয়েই ঢাকা থেকে নয়াদিল্লিতে পালিয়ে যান প্রথম। শেখ হাসিনাকে সমর্থন করার জন্য ভারতীয়দের দিকে আঙুল তোলা হয়েছে বারেবারেই। সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ভারতও বারেবারেই বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে যে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। বিএসএফকে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ভারত তবে ঘটনা কমেনি।
এমন কিছু ঘটনা আগেও ঘটেছে যখন চোরাচালানকারীরা বিএসএফকে মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করেছে। সেই মুহূর্তে আত্মরক্ষার্থে গুলি চলেছে। কিন্তু স্বর্ণা বা বাকিদের মতো কমবয়সি সাধারণ মানুষের খুন কি ন্যায্য? বিএসএফ আধিকারিকদের দাবি, তাঁরা "শুধুমাত্র আত্মরক্ষার্থেই" গুলি চালান। স্ক্রোলের ওই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক রবি গান্ধি বলেছেন, "গুলি তখনই চলে যখন বিপুল সংখ্যক লোক এজেন্টদের সঙ্গে আসে এবং সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে, কখনও কখনও আমাদের কর্মীদের আক্রমণও করে। সেই সময়, আত্মরক্ষায় আমাদের কর্মীরা গুলি চালায়।"
আরও পড়ুন- বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা কি সত্যিই নির্যাতিত? প্রকৃত চিত্রটি আসলে যেমন
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বিশ্বের দীর্ঘতম সীমান্তগুলির মধ্যে একটি। ভারতের পাঁচটি রাজ্য - অসম, পশ্চিমবঙ্গ, মিজোরাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা রয়েছে। সীমান্তের দুই পারেই বাসিন্দাদের একই ভাষা, সাংস্কৃতিক ধারাও বেশ এক এবং পারিবারিক সংযোগও আছে বিপুল। এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকেই কিন্তু দুই পক্ষে বৈধ এবং অবৈধ দুই বাণিজ্যই সহজতর হয়েছে। বহু দশক ধরেই সীমান্তে চোরাচালান চলছে। গরু, জাল নোট, এমনকী কাশির সিরাপও পাচার হয়। সঙ্গে চলে অবৈধ অভিবাসন, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন।
২০১৯ সালে, বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে ৮১ পাতার একটি প্রতিবেদন প্রকাশে সাহায্য করেছিল। ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বিএসএফের হাতে ৯০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই গবাদি পশু বা অন্যান্য চোরাচালানের জন্য ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল। সীমান্তের দুই পাশের কর্মীরাই অভিযোগ করেছেন, বিএসএফ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আসলে 'দুর্নীতিগ্রস্ত বাহিনী'। এই দুই পক্ষের লোকজনই চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। দল নির্বিশেষ রাজনৈতিক নেতারা, রাজ্য পুলিশ, বিএসএফ এবং আবগারি আধিকারিক ও চোরাচালানকারীরা সকলেই একটি জোটের অংশ।
বাংলাদেশের সমাজকর্মীদের একাংশ বলছেন, বছরের পর বছর ধরে যারা সীমান্তে নিহত হয়েছেন তারা সকলেই প্রায় দরিদ্র ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষ। এরা অস্ত্রসহ ধরাও পড়ে না এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার মতো মানুষও নন কারণ তারা প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যের জন্যই ভারতে প্রবেশ করেন। অথচ প্রাণ যায় তাঁদেরই। পাচার নিরাপদে চলতে থাকে কারণ তাতে বড় বড় মাথারা যুক্ত আছে বলে অভিযোগ, যে মাথাদের বিশ্বের কোনও সীমান্তেই কোনও বিপদ নেই।