বাংলাদেশের উপদেষ্টা মাহফুজের মুখে ওয়ান ইলেভেন প্রসঙ্গ! ওয়ান ইলেভেন কী?
Bangladesh : আওয়ামী লীগ-সহ বেশ কিছু দলের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, ১১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে গিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন।
৪ অগাস্ট সন্ধেবেলা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ফেসবুকে একটি এক লাইনের পোস্ট লেখেন। লেখা ছিল, “ওয়ান ইলেভেন-র পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে”। এর কিছুক্ষণ পর আবার সেই পোস্টটি এডিট করে আরও একটি লাইন যুক্ত করেন। সেখানে তিনি লেখেন- “ওয়ান ইলেভেন-র পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে! তবে, জুলাই জয়ী হবে। জনগণের লড়াই পরাজিত হবে না”। যদিও পরে তিনি পোস্টটি ডিলিট করে দেন। প্রশ্ন হল, ওয়ান ইলেভেন কী? কেন ওয়ান ইলেভেন-র প্রসঙ্গ টানলেন মাহফুজ?
২০০৭ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন- এই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বহু দিন ধরেই সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছিল। শেষে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে 'ওয়ান ইলেভেন' নামে পরিচিতি। তবে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি, ঠিক কী ঘটেছিল এই নিয়ে জল্পনা রয়েই গেছে।
আওয়ামী লীগ-সহ বেশ কিছু দলের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, ১১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে গিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। পাশাপাশি সে বছরের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনও বাতিল করেছিলেন। এরপর ক্ষমতায় এসেছিলো সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রধান হয়েছিলেন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ। আর তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ।
আরও পড়ুন- ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি! গত বছর ৫ অগাস্ট কী হয়েছিল বাংলাদেশে?
কী ঘটেছিল সেই দিন? ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, বাংলাদেশে সারাদিনই জল্পনা-কল্পনার মধ্যে কেটেছিল। একদিকে রাস্তায় আওয়ামীলীগের আন্দোলন এবং অন্যদিকে বঙ্গভবনে সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা। আর বিএনপি তখন ২২ জানুয়ারির নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিল।
তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ এবং নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী-সহ একদল সেনা কর্মকর্তা ১১ জানুয়ারি দুপুরে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনা নিয়ে তৎকালীন জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ একটি বই লিখেছেন- 'শান্তির স্বপ্নে: সময়ের স্মৃতিচারণ'। বইটিতে তিনি বর্ণনা করেছেন- তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ইয়াজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠকে কীভাবে জরুরী অবস্থা জারির প্রসঙ্গটি এসেছিল।
বইতে মঈন ইউ আহমেদ বর্ণনা করেন, "আমি প্রেসিডেন্টকে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি, নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের আল্টিমেটাম এবং বিদেশী রাষ্ট্র সমূহের অবস্থান, বিশেষ করে নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানালাম। জাতিসংঘ মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করা হলে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে তা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রেসিডেন্টকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে সচেষ্ট হল।"
জেনারেল মইন ইউ আহমেদ তাঁর বইতে জরুরী অবস্থা জারির পেছনে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেছেন। বইটিতে লেখা হয়েছে - "একসময় ক্ষমতাধর কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি আমার সঙ্গে দেখা করে জানান, সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেখে নির্বাচনে সেনাবাহিনী সহায়তা করলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহারের জন্য তাঁরা জাতিসংঘকে অনুরোধ করবে। প্রচ্ছন্ন এ হুমকির পরিণতি অনুধাবন করতে আমার অসুবিধা হল না। জাতিসংঘের কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক এসব দেশের অনুরোধ ও মতামত যে জাতিসংঘ অগ্রাহ্য করতে পারবে না তা বলাই বাহুল্য। আমি এর পরিণাম চিন্তা করে শিউরে উঠলাম। তারপরেও আমার একমাত্র চিন্তা ছিল কীভাবে সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্র যন্ত্রের কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা যায়।"
আরও পড়ুন- কেন বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানকে ‘আয়-উপার্জনের উৎস’ বলছেন আন্দোলনের মুখপাত্র নিজেই?
ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ড: সোয়েব আহমেদ বিবিসি-কে বলেছিলেন, সব উপদেষ্টাদের বঙ্গভবনে আসার অনুরোধ পাঠান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তিনি বলেন, আগে কিছুই জানানো হয়নি, বঙ্গভবনে গিয়ে জানতে পারেন তিন বাহিনীর প্রধান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক হবে। তখনই উপদেষ্টা পরিষদের সবাই জানতে পারেন রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করবেন। কিন্তু বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তখনও উপদেষ্টাদের জানানো হয়নি। সোয়েব আহমেদ-এর কথায়, "একটা সময় রাষ্ট্রপতি আমাদের সঙ্গে চা খেতে মিলিত হন। সেখানে তিনি জানান পরিস্থিতির জটিলতার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিতে হচ্ছে। আমরা সবাই রেজিগনেশন দিয়ে চলে গিয়েছি।"
তাঁর দাবি, সেই রাতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল আরেকটি সরকার গঠনের প্রক্রিয়া। প্রথমে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসকে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। তখন ড: ফখরুদ্দিন আহমদ প্রস্তাব পেয়ে এগিয়ে আসেন। সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ-সহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে বিএনপি-র পাশাপাশি শেখ হাসিনা-সহ আওয়ামীলীগের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অভিযোগ ওঠে, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী তথা বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি-র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া-কে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল এই সরকার। শুধু তাই নয় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি শীর্ষস্থানীয় অনেক ব্যবসায়ীকেও আটক করা হয়েছিল। এমনকি সংবাদমাধ্যমের উপরও কড়া নজর রাখা হত।
পরবর্তী সময়ে সাধারণ নির্বাচনের বিষয়ে সেনা সমর্থিত সরকারের উপর চাপ বাড়তে থাকে।অবশেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সকল দলের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন হয়।
কেন ওয়ান ইলেভেন-র প্রসঙ্গ টানলেন মাহফুজ? সেই উত্তর এখনও অধরা।

Whatsapp
