নানা সময়ে বিশ্বজুড়ে যে রাজনৈতিক দলগুলি নিষিদ্ধ হয়েছে

Banned political parties: দেখা গেছে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পরও উক্ত সংগঠনগুলিকে তাদের নির্দিষ্ট ভাবাদর্শ বা রাজনীতি থেকে দূরে রাখা দুরুহ হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পরও দলগুলি প্রকাশ্যে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে।

অপরিসীম জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক শক্তি, শাসনক্ষমতা পাওয়ার পরও বিশ্বে বহু রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। অনেক দলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ রয়েছে- চরমপন্থা, সহিংসতা, রাষ্ট্রবিরোধীতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের। তবে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পরও অনেক দলই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। সংগঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে সংগঠকেরা নিজেদের রক্ষা করতে অনেক সময়ই আত্মগোপন করেন। ফলে তাদের উপর নজর রাখা কঠিন হয়ে যায়। অনেক সময় এতে চরমপন্থারও জন্ম হয়। দেখা যাক, বিশ্বে কোন কোন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। 

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)

২০০৯ সালে ভারতের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বলে রাখা ভালো, কংগ্রেসের সময় থেকেই ২১ বছর পুরনো এই দলকে ভারতের প্রধান 'অভ্যন্তরীণ শত্রু বলে' উল্লেখ করা হত। দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারও একই পথে হেঁটেছে। এই দল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫,৫০০ কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তবে অনেক রাজ্যেই এই দল এখনও সক্রিয়। বলে রাখা ভালো, বিনা বিচারে এনকাউন্টার করা নিয়ে বারংবার প্রশ্ন তুলেছেন সমাজকর্মীরা।

আওয়ামী লীগ

২০২৪ সালের ৫ অগস্ট, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। এই রাজনৈতিক দলের নেত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমন করতে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। এতে প্রাণ হারান কয়েকশো মানুষ। বর্তমানে ইউনূস নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রেখেছে।

টিএলপি বা তেহরিক-ই-লাব্বাইক

২০২১ সালে পাকিস্তান সরকার পঞ্জাবের টিএলপি বা তেহরিক-ই-লাব্বাইক-কে নিষিদ্ধ করে। এই দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে হত্যা করার প্রমাণ ছিল। তবে ২০২২ সালে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হয়। কারণ স্থানীয়ভাবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার চাপ বাড়ছিল, তাই প্রকাশ্যে তাদের কার্যক্রম না চালাতে দিয়ে উপায় ছিল না। বলে রাখা ভালো, পাকিস্তানের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে এই দলই ৩০ লক্ষ ভোট পায়। এই নির্বাচনে টিএলপি বা তেহরিক-ই-লাব্বাইক চতুর্থ প্রধান দলের মর্যাদা পেয়েছে।

জার্মানির নাৎসি পার্টি

১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে ক্ষমতায় ছিল অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি পার্টি। এই দলই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। হলোকাস্টে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে এই দলের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মিত্র বাহিনী নাৎসি পার্টিকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৫ সালে জার্মানির আইনে এই দলের প্রতীক, স্লোগান ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়।

কেপিডি (KPD) বা জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি

কেপিডি বা জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি ছিল ওই দেশের একটি প্রভাবশালী মার্কসবাদী দল। জানানো হয়েছিল, দলটির আদর্শ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত।

ফ্যাসিস্ট পার্টি ইতালি (PNF)

এটি বিশ্বের প্রথম ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল। এই পার্টির আদর্শ ছিল কট্টর জাতীয়তাবাদ। ফ্যাসিস্ট পার্টির মুসোলিনি শাসনকালে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও গণহত্যা চালানো হয়। ১৯৪৩ সালে মুসোলিনির পতন হয় এবং ইতালির নতুন সরকার ফ্যাসিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

মুসলিম ব্রাদার হুড

২০১২ সালে মিশরের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এই দলটির প্রার্থী মোহাম্মদ মোরসি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর দলটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়াতে এবং ২০২৫ সালে জর্ডানে এই দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বার্থ পার্টি ইরাক

এটি ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন আরব জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী একটি দল। ইরাকে বহু বছর এই দল ক্ষমতায় ছিল। দলটির বিরুদ্ধে কুর্দি ও শিয়া জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক নিপীড়ন ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। ২০২৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের পর দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

রেফাহ পার্টি তুরস্ক

এটি ওয়েলফেয়ার পার্টি নামেও পরিচিত একটি ইসলামপন্থী দল। ১৯৯০-এর দশকে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই পার্টি। প্রথমে দলের প্রধান ছিলেন নেজমেত্তিন এরবাকান। ১৯৯৮ সালে আদালত থেকে এই দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। ধর্মীয় আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে হুমকির মুখে ফেলার অভিযোগ এই দলের বিরুদ্ধে।

গোল্ডেন ডন

এটি গ্রিসের একটি উগ্র-ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল। অভিযোগ এই দল শরণার্থী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়েছিল। যদিও ২০১২ সালে গ্রিক পার্লামেন্টে জায়গা পেয়েছিল এই পার্টি। পরে এই দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও খুনের অভিযোগ ওঠে। ২০২০ সালে নিষিদ্ধ করা হয় এই দলকে।

আরএসএস

২০২৫ সালে আরএসএস-এর ৯৯ বছর পূর্ণ হল। এই দলের ওপর চারবার নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৪৮ সালে গান্ধীকে হত্যা করার কারণে আরএসএস-এর কর্মীদের ওপর প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। তারপর ১৯৯২ সালে ফের এই সংগঠন বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেয়। বারংবার নিষেধাজ্ঞার পরও এই সংগঠন নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে। এখন ভারতের ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে তাদের সহযোগী দল বিজেপি ক্ষমতায়। কেন্দ্রেও এখন বিজেপি সরকার পরপর তিনবার ক্ষমতায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, একের পর এক অপরাধমূলক কাজের পরও রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি সমর্থনের কারণে সংগঠনকে নিষিদ্ধ রাখা কঠিন হয়ে গিয়েছে।

উল্লেখ্য, দেখা গেছে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পরও উক্ত সংগঠনগুলিকে তাদের নির্দিষ্ট ভাবাদর্শ বা রাজনীতি থেকে দূরে রাখা দুরুহ হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পরও দলগুলি প্রকাশ্যে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে। একের পর এক গণহত্যা, গণঅত্যাচরের প্রমাণ থাকার পরও দলগুলির কার্যক্রম থামানো যায়নি। আরএসএস, টিএলপি-সহ উল্লেখিত সব দলগুলি ফৌজদারি অন্যায়ের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরও কীভাবে তারা জনসমর্থন পেল তা প্রকৃতই গবেষণার বিষয়।

More Articles