টোকিও না গিয়ে আদিবাসী গ্রামে স্কুল চালাতে চলে গেলেন বারীন সাহা
কলকাতার গড়পাড়ের সচ্ছল পরিবারের ছেলে বারীন সাহা (১৯২৫-১৯৯৩) ছিলেন বামপন্থী আন্দোলনের কর্মী । প্রথাগত শিক্ষা শেষ করে তিনি ভারতের অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল। যখন নিমাই ঘোষের 'ছিন্নমূল' বানানো হয়ে গিয়েছে, ঋত্বিক যখন 'নাগরিক' বানাচ্ছেন, সত্যজিত শুরু করেছেন ‘পথের পাঁচালী’-র শুটিং আর মৃণাল সেন তখনও ‘রাতভোর’-এর কাজ শুরুই করেন নি, সেই ১৯৫২ সালে, বারীন সাহা জেল থেকে বেরিয়ে বিদেশে পাড়ি দেন। প্যারিসের ফিল্ম স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়ে কলকাতা ছাড়লেন। সাত সমুদ্র পেরিয়ে( ফিরে এসে ‘তেরো নদীর পারে’ নামে একটা ফিল্মও করেছিলেন) সেখানে গিয়ে শিখলেন পরিচালনা আর সম্পাদনার কাজ। এতেও মন উঠল না, গেলেন ইতালিতে ক্যামেরার কাজ শিখতে । রোমের “সেন্ত্রো এস্পেরিমেন্তাল” থেকে স্নাতক হলেন সিনেম্যাটোগ্র্যাফিতে। কলকাতায় যখন ফিরলেন, তার মতো প্রশিক্ষিত সিনেম্যাটোগ্রাফার কলকাতায় আর ক’জন ?
চিদানন্দ দাশগুপ্ত কলকাতার উপর যে ডকুমেন্টারি ফিল্মটি করেছিলেন 'পোট্রেট অফ আ সিটি’, সেটি ছিল বারীন সাহার ক্যামেরার কাজ, যাঁরা দেখেছেন, তারা জানেন কী ম্যাজিক বারীন করেছিলেন। কলকাতা শহরে বারীনের দুই গুণগ্রাহী ছিলেন, চিদানন্দ দাশগুপ্ত আর বাদল সরকার। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো রোজগার করতে পারতেন সিনেম্যাটোগ্রাফার হিসেবে। তা না করে নিজের ফিল্ম তৈরির কথা ভাবলেন। গল্প আর চিত্রনাট্য তৈরি হবার পর কোনও প্রোডিউসার রাজি হল না টাকা ঢালতে, শেষে বারীনের দাদা রাজেন প্রযোজনা করলেন ছবিটি (তেরো নদীর পারে), যদিও শোনা যায় প্রযোজক ছিলেন হেমেন গাঙ্গুলি। ১৯৬১ সালে তৈরি ফিল্ম ৯ বছর পর রিলিজ করল ২১ মার্চ ১৯৬৯। রিলিজ আটকে থাকার কারণ বারীন নাকি এক প্রভাবশালী ডিস্ট্রিবিউটরকে চটিয়ে ফেলেছিলেন এবং তিনিই কলকাঠি নেড়ে এতদিন ফিল্মটিকে ঘরবন্দি করে রেখেছিলেন। রিলিজ করল, কিন্তু ফিল্মটি চলল না। ছবিটির বিষয় ছিল শিল্প আর বিনোদন-এর মধ্যে প্রতিযোগিতায় কে জিতবে?
জিতল শিল্প। ফিল্মের মিউজিক করেছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সম্পাদনা করেছিলেন দুলাল দত্ত। প্রধান চরিত্রে ছিলেন জ্ঞানেশ মুখার্জি আর প্রিয়াম হাজারিকা। এই ফিল্মটা আমরা কলকাতায় আশির দশকের মাঝামাঝি দেখতে পেয়েছিলাম গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের [মহীনের ঘোড়াগুলি] উদ্যোগে, যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আমাদের বন্ধু ল্যাডলি মুখোপাধ্যায়ও।
‘তেরো নদীর পারে’, প্রথম একটি বাংলা ছবি যা সম্পূর্ণভাবে আউটডোরে শুটিং করা হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। সেই আউটডোর লোকেশন ছিল মহিষাদল পার হয়ে হলদি নদীর ধারে 'তেরোপেখিয়া' নামের একটি গঞ্জ। আজকের হলদি নদীকেই তখন ‘তেরো নদী’ বলা হতো। মহিষাদলের রাজা তেরোজন পাইক পাঠিয়ে এই গঞ্জ দখল করেছিলেন বলে নাম হয়েছিল তেরোপেখিয়া। সেখানে সিনেমা তৈরি সহজ কাজ ছিল না। শুনেছি জায়গাটি এতটাই দূর্গম ও বসবাসের অযোগ্য ছিল যে, কলকাতার অভিনেতারা সেখানে গিয়ে থাকতে রাজি হননি। ফলে শ্যুটিং শুরু করেও বারীনবাবুকে বারে বারে অভিনেতা বদল করতে হয়। তিনি স্থানীয় লোকজনকে নানা চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন। এ সবই তিনি করেছিলেন নিজের বিশেষ এক চলচ্চিত্র ভাবনার জায়গা থেকে। যার ভিত্তি ছিল আন্দ্রে বাজাঁর ‘ইমপিওর সিনেমা’র তত্ত্ব। মনে করতেন, ফিল্ম করার ক্ষেত্রে স্ক্রিপ্ট তেমন ইমপর্টান্ট নয়। ওটা ফিল্মের একটা খুঁটিবিশেষ, যাতে পরিচালক ফেলে না পালিয়ে যেতে পারে। ওটা একটা স্ট্রাকচারাল ডিসিপ্লিন।
তাঁর মতে, ইনডোর স্টুডিওতে শ্যুট করা ছবির মধ্যে কোনও স্পন্টেনিটি পাওয়া যায় না। স্টুডিওতে যে ধরনের লাইটই করা হোক না কেন তাতে প্রপার ডেপথ পাওয়া যায় না। ঋত্বিকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ খুবই ভালো লেগেছিল, কিন্তু সিম্বলের মধ্যে দিয়ে একটা ফ্রেমকে আর্টি করে তোলার ব্যাপারটা বারীনের ভালোলাগেনি, মানে ঋত্বিকের সিম্বল-প্রীতি বারীনের পছন্দ ছিল না। সে কথা ঋত্বিককে জানাতে দু'জনের মধ্যে বেশ তক্কাতক্কি হয়েছিল। তবে বাংলার গণ আন্দোলনের উপর ঋত্বিক একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই ফিল্মের ক্যামেরা করার কথা ছিল বারীনের, ঋত্বিক তা ঘোষণাও করেছিলেন, যদিও ফিল্মটি আর হয়নি।
১৯৬৯ সালেই ‘শনিবার’ নামে একটি ফিল্ম করেছিলেন বাদল সরকারের একটি নাটক নিয়ে, সেই ছবির বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। চলচ্চিত্র বিষয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধে উনি সাহস করে লিখতে পেরেছিলেন, ‘পথের পাঁচালী’ আমার খুবই ভালো লেগেছে এবং অধিকন্তু এই কারণে যে তা বাংলা চলচ্চিত্রকে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু যে যুক্তি প্রদর্শন করা হচ্ছে তা গ্রাহ্য নয়। কারণ নিমাই ঘোষ তাঁর ‘ছিন্নমূল’ সিনেমাটি ‘পথের পাঁচালী’-র আগে করেছিলেন। তার সবটাই আউটডোর শুটিং আর চরিত্ররা বাস্তব অর্থাৎ উদ্বাস্ত, যা সত্যজিৎ রায় করেননি। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আউটডোর শুটিং প্রগতিশীল সিনেমার কোনও মাপকাঠি নয়’।
সত্যজিৎ রায়ের ফিল্ম সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বারীন বলেছেন, ‘ওঁর ছবি বসে দেখা যায় এইটুকুই, কিন্তু তা থেকে আমার গ্রহণ করার কিছুই নেই’। একবার সত্যজিৎ রায়ের এডিটর দুলালবাবুর অনুরোধে কোকিলের ডাকের শব্দ নিয়ে বারীন হাজির স্টুডিওতে, যে সাউন্ড ফুটেজটা দিয়েছিলেন তাতে কোকিলের সঙ্গে শিয়ালের ডাকও ছিল। মুগ্ধ দুলালের প্রশ্ন ‘এমন সাউন্ড রেকর্ড করেন কী করে’? বারীনের উত্তর, ‘বাংলা মদ না খেলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। মানিকবাবুকে বাংলা খেতে বলুন’ এই বলে পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন স্বয়ং সত্যজিৎ দাঁড়িয়ে। বলা বাহুল্য, দুলালবাবু আর কোনোদিন কিছু চাননি বারীনের কাছে, সত্যজিতের ফিল্মের জন্য।
আর মৃণাল সেনের ফিল্ম মোটে পছন্দ করতেন না বারীন। বামফ্রন্ট সরকার ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন করার পর বারীনকে সেই সংস্থার চেয়ারম্যান হবার প্রস্তাব দেয়, বারীন সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। তবে আলিমুদ্দিনের মিটিংয়ে যে পোশাক পরে গিয়েছিলেন তাতে নেতারা ক্ষুব্ধ। কথাবার্তা এইরকম হয়েছিল:
নেতা: এটা কী পোশাক পরে এসেছেন?
বারীন: দেখতেই পাচ্ছেন, ওপরে একটা ট্র্যাডিশনাল ফতুয়া আর ট্রাউজারটা জিন্স, আমেরিকান কালচার।
নেতা: আপনাকে একদম মানাচ্ছে না।
বারীন: ও তাই! এমন জানলে ধুতি – পাঞ্জাবি পরে আসতাম। বাড়িতে আছে, পরতেও পারি।
মিটিং আর বেশি দূর এগোয়নি। এর আগে মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার বারীনকে বলেন মাছের ভেড়ির উপর ১০ মিনিটের একটা তথ্যচিত্র করতে, বারীন বলেছিলেন, ‘আপনারা ১০ মিনিটে বক্তৃতা দিয়ে একটা জিনিস বোঝাতে পারেন না, আমি ফিল্মে কী করে বোঝাব? অন্তত ২০ মিনিট দিন’। ফিল্মটা হয়েওছিল, কিন্তু তারপর কী হল জানা যায় না।
১টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা, ১টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমা আর দুটি তথ্যচিত্র, এই হল ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বারীনের পরিচালক জীবনের ফসল। বুঝে গিয়েছিলেন, ভুল সময়ে এই শহরে এসে পড়েছেন। বামপন্থীরা ওঁকে গান্ধীবাদী ভাবতো আর দক্ষিণপন্থীরা ভাবতো বামপন্থী। যখন টাকা পয়সার অভাব, কোনো কাজ নেই, তখন তাঁর টোকিওবাসী কিছু বন্ধু প্রস্তাব দেয় ওখানে রুটি – মাংসর দোকান দেবার জন্য। যাবেন প্রায় স্থির করে ফেলেছিলেন, এমন সময় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে প্রস্তাব আসে আদিবাসী গ্রামে শিশুদের শিক্ষা দেবার জন্য। শহর ছেড়ে চলে যান ঝাড়গ্রামে আদিবাসী গ্রামে, গ্রামের নাম নামালডিহা। আদিবাসী শিশুদের জন্য ২ টো স্কুল করেছিলেন, অক্ষর ১ ও অক্ষর ২, নামটা বাদল সরকারের দেওয়া। সেখানে যারা পড়াতো তাদের উনি গাইড করতেন। ছাত্রদের গান শেখানোর জন্য গ্রামেরই হরিসভার এক গায়ককে ঠিক করেছিলেন। স্কুলে একটা তাঁত বসিয়ে ছিলেন, যেখানে ছাত্ররা কাপড় বোনা শিখত। যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে বারীন এই কাজটা করতেন, আশির দশকে তারা তাঁর মাইনে ঠিক ছিল দিনে ২৫ টাকা। বলেছিলেন, যে, একমাত্র সোশ্যাল ওয়ার্ক করলেই মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায়। শহরের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে সেখানেই আমৃত্যু ছিলেন। যেহেতু আমাদের কোনো ইতিহাসবোধ নেই, তাই আমরা এইরকম একটি মানুষের কোনো কিছুই আর্কাইভ করে রাখিনি।