বাড়ির পাশেই আরশিনগর, কীভাবে যাবেন রডোডেনড্রনের দেশ বার্সেতে
Barsey: পুরুলিয়া-বীরভূমের বসন্তের মধ্যমণি পলাশের মতই এখানে এই দুই তিন-মাস রডোডেনড্রনের দৌলতে বসন্তের আগমন, তাকে দেখতেই এত পর্যটকের উৎসাহ, এত আয়োজন।
‘রডোডেনড্রন’ নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র এই গানটির সৌজন্যে। সেই রডোডেনড্রন ফুল যে আসলে কীরকম, পরে তার প্রচুর ছবি দেখলেও এত কাছ থেকে এত বিপুল সংখ্যায় চাক্ষুষ করার সুযোগ পেলাম এই এপ্রিলে পশ্চিম সিকিমের বার্সে রডোডেনড্রন স্যাঞ্চুয়ারিতে হাইকিং করতে গিয়ে।
আসলে পাহাড়ের জন্য মনকেমন সারাবছরের সঙ্গী। একবছর ঘুরে গিয়েছে হিমালয়ের হাওয়া গায়ে মাখা হয়নি। তাই আর বেশি না ভেবে পাড়ি জমালাম সিকিমের উদ্দেশ্যে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে প্রথমদিন গাড়ি করে ১২৫ কিমি দূরে ওখরে যাওয়া দিয়ে যাত্রা শুরু। সিকিমের জোরথাং হয়ে যে রাস্তা ওখরে গিয়েছে তাতে সেদিন সামান্য জ্যাম ছিল, তবে পাহাড় মানুষকে ধৈর্য শেখায়।সেই জ্যামের মধ্যেই রাস্তার পাশে থাকা দোকান থেকে ধোঁয়া ওঠা মোমো সহযোগে পেটপুজো সেরে ফের যাত্রা শুরু। ৬ ঘন্টা পরে শেষে যখন ওখরে পৌঁছে হোমস্টেতে উঠলাম তখন তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে বেশ কিছুটা। রুকস্যাক থেকে জ্যাকেট, থার্মাল বের করে রাতের ৬ ডিগ্রির হাড়কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যে শীতঘুম দিয়ে সকালে উঠে দেখি উল্টো দিকের আকাশের মুখ ভার।
আরও পড়ুন: ভ্রমণ বিলাসীদের আকর্ষণীয় স্থান পাকিস্তানের বালুচপ্রদেশ
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৃষ্টির সম্ভাবনা আগেই দেখে রেখেছিলাম। সেই মতো রেনওয়ার আর একদিনের মতো কিছু দরকারি জিনিস ডে-প্যাকে গুছিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম হিলের দিকে। হিলে থেকে হাইক করে ৫ কিমি দূরে বার্সে গিয়ে সেদিন আমরা বার্সের গুরাস কুঞ্জেই রাত্রিযাপনের প্ল্যান। নেপালি ভাষায় রডোডেনড্রনের নাম হলো গুরাস। প্রসঙ্গত বলে রাখি বার্সে যাওয়ার তিনটি রাস্তা আছে। সবচেয়ে প্রচলিত রাস্তাটি হিলে থেকে, আরও দুটি রয়েছে ডেনতাম ও সোরেং দিয়ে। ১০৪ বর্গ কিমি অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত এই অভয়ারণ্য উত্তরে কাঞ্চনজঙ্ঘা বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ এবং দক্ষিণে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে কিছুটা স্যান্ডউইচের মতো করে অবস্থিত।
হিলেতে যাবতীয় পারমিটের কাগজ যোগাড় করে যাত্রা শুরু হল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চলে গিয়েছে, চারদিকে ঘন হয়ে এসেছে ওক, ম্যাগনোলিয়া আর অবশ্যই বিভিন্ন রঙের ফুলের ডালি সাজিয়ে রডোডেনড্রন গাছ। পথের ধারে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ছোট ছোট কটেজ রয়েছে। দুই চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে নানারকম পাখির ডাক শুনতে শুনতে এগোচ্ছি, হঠাৎ মেঘদেবী তাঁর গর্ভ উন্মোচন করে একটু ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামিয়ে দিলেন। সঙ্গে করে রেনওয়ার নিয়ে আসার গুরুত্ব টের পাওয়া গেল। যদিও সে বৃষ্টি ক্ষণিকেরই। এরই মধ্যে থেমে থেমে জল আর শুকনো খাবার খাওয়া চলতে থাকল। রাস্তার একদিকে এই অঞ্চলের গাছ, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীদের ছবি ও নাম লেখা বোর্ড রয়েছে। আর রয়েছে গাছ থেকে ফুল না তোলার ও জঙ্গলে প্লাস্টিক না ফেলার সতর্কবার্তা।
বার্সে পৌঁছানোর কিছু আগেই রয়েছে গুরাস তাল। ‘তাল’ শব্দের অর্থ হ্রদ, যদিও জল কম। কিন্তু তার চারপাশে অজস্র রডোডেনড্রন গাছ লাল , সাদা, গোলাপী ফুল সাজিয়ে যেন বলছে “ওগো পথিক,তুমি এসে বসবে বারে বারে”- সেই জন্যই তো প্রকৃতির এত সাজসজ্জা। পাথরের গায়ে স্থানে স্থানে কমলা রঙের লিচেন। গুরাস তালের পাশে কিছুক্ষণ বসে মন ভরে ওঠে। কিছুটা এগোলেই বার্সের প্রবেশদ্বার।মুগ্ধ হৃদয় আর মোবাইল ভর্তি ছবি নিয়ে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই বার্সের দুয়ারে পৌঁছে দেখি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধদেব বসে আছেন। তাঁর পাশে তিব্বতি পতাকা ও ত্রিশূলের উপস্থিতি চোখে পড়ে। ঠিক পাশেই ‘বার্সে ০ কিমি’ লেখা একটা মাইলফলকের মতো দেখতে লম্বা সবুজ রঙের হোর্ডিং পর্যটকদের সেলফি বা ছবি তোলার আকর্ষণ কেন্দ্র কিন্তু বুদ্ধদেব খুব একটা কারও নজর বা ক্যামেরাবন্দি হচ্ছেন না দেখলাম। গুরাসকুঞ্জের দোতলার ডরমিটরিতে রুকস্যাক রেখে বাইরে গরম চা নিয়ে এসে বসলাম।
পুরুলিয়া-বীরভূমের বসন্তের মধ্যমণি পলাশের মতই এখানে এই দুই তিন-মাস রডোডেনড্রনের দৌলতে বসন্তের আগমন, তাকে দেখতেই এত পর্যটকের উৎসাহ, এত আয়োজন। এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই। কাঠের জালে রান্না, রাত্রি ঘন হলে বড় বড় হ্যাজাক-লন্ঠনের আলোতে খাওয়া দাওয়া, কাঠের সিঁড়ির উপর ধুপধাপ করে ওঠানামা, সদা হাস্যময় হোস্ট ফ্যামিলি যারা যেকোনো সময় সবরকম হেল্প করতে রাজি (৩-৪ ডিগ্রি হাড়কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যে সবসময় ফ্লাস্কে গরম জল রেডি) আর চল্লিশজন হোমো স্যাপিয়েন্সের সঙ্গে একত্রে রাত্রিবাস। ডিনার শেষে মোবাইল পাওয়ারব্যাঙ্কে চার্জ বসিয়ে প্রবল শীতকাতুরে আমি দুটো লেয়ার জ্যাকেট-ট্র্যাকসুটের মধ্যে ঢুকে শোয়ার তোড়জোড় করছি। হঠাৎ পাশের গ্রুপের চন্দন কাকুর উদাত্ত কণ্ঠে, “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে” দু’কলি শুনতে পেলাম। রবীন্দ্রনাথ! পশ্চিম সিকিমের এক কোণে এইরকম পাহাড়ি বসন্ত-রাত্রি এর আগে আমার জীবনে কখনও আসেনি।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখি ঘড়িতে ৫টা বাজে। সেদিনই আবার হিলে হয়ে ওখরে নামার কথা।আকাশ ঝকঝকে থাকলে গুরাসকুঞ্জের কিছুটা উপরে একটা ভিউপয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন মিলতে পারে শুনে বেশ লোভ হল। উপরি পাওনার উপর মানুষের বরাবর লোভ থাকে, আমিও সে দোষে দুষ্ট। কিন্তু সে সৌভাগ্য এবার হলো না। আরও কিছুটা এগিয়ে দেখি গাছ থেকে খসে পড়া গোলাপি রডোডেনড্রনের পাপড়িতে ঢেকে যাওয়া জঙ্গলের পাহাড়ি পথ প্রকৃত অর্থেই কুসুমাস্তীর্ণ। গাছেদের গায়ে শ্যাওলার মতো জড়িয়ে থাকা মস দেখে হ্যারি পটার সিরিজের সুখ-চুরি করতে পটু ডিমেনটরের কথা মনে পড়ে গেল। ঘন হয়ে আসা জঙ্গলে ঝুপ করে নেমে আসা নিস্তব্ধতায় নিজের গলার আওয়াজকেই কীরকম যেন অযাচিত মনে হলো। একটা জায়গায় সারি সারি লম্বা বাঁশগাছের রমরমা, এইরকম জায়গায় জঙ্গলে রেড পান্ডার দেখা মিলতেও পারে ভেবে ভারী বুটের শব্দ যতটা সম্ভব লুকিয়ে হাঁটলেও তারা মনে হয় আমাদের দর্শন দেওয়ার যোগ্য মনে করেনি।
আরও পড়ুন:ভারতীয়দের পছন্দের বিদেশভ্রমণের তালিকাতেই নেই মলদ্বীপ! প্রতি রাতের খরচ কত জানেন?
ঘড়ি বলছে এবার ফেরার পালা। নেমে গুরাসকুঞ্জে ব্রেকফাস্ট সেরে রুকস্যাক গুছিয়ে নীচে নেমে দেখি সূর্যদেব বেশ স্তিমিত। বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। যে পথ ধরে আগেরদিন বার্সে এসেছিলাম সেই পথেই অবতরণ। যাত্রাপথে ছোট ছোট পাহাড়ি ঝর্ণার কলতান মাঝে মধ্যেই কানে আসে। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে হিলে নেমে গাড়ি করে আবার ওখরেতে প্রথমদিনের হোমস্টেতে ফিরলাম। প্রথমদিন এসে প্রায় মাইল খানেক উঁচুতে থাকা একটি বৌদ্ধ মনাস্টেরির কথা মনে পড়ে গেলো। লাঞ্চের পর পাথুরে সিঁড়ি ধরে মনাস্টেরির দরজায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেখি কুয়াশার চাদর নেমে এসেছে। ছোট্ট রঙিন মনাস্টেরি। বিকেলের প্রার্থনার অন্তিমলগ্নে মাখন-প্রদীপের আলোয় দেবতারা উদ্ভাসিত। বাইরে এসে দেখি হিমেল বাতাসে শিরশিরানি বেড়েছে। ভিতরের জপ-মন্ত্রের আবেশ বাইরের পৃথিবীকেও যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পশ্চিম প্রান্তে সূর্যের শেষ আভাটুকু আকাশে বিলীন হয়ে আসছে। সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো এইরকম পরিবেশেই কি সুমন “তথাগত তার নিঃসঙ্গতা দিলেন অস্তরাগে” - এই শব্দগুচ্ছ লিখেছেন?
ভাবতে ভাবতে পা বাড়াই হোমস্টের দিকে। সন্ধ্যেয় আগুন জ্বালিয়ে গানের আড্ডা, ডিনারের পরেও গল্পের মৌতাত লেগে থাকল গভীর রাত পর্যন্ত। ট্রেক শেষে মনখারাপের গন্ধ উগ্র হয়ে আসে। বাস্তব সবসময়ই কঠিন হয়, সে একঘেয়ে জীবনে ফেরার কথা মনে পড়িয়ে দিতে থাকে বারবার। সকালে ওখরেকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি করে প্রায় ৭ ঘন্টায় শিলিগুড়ি পৌঁছানোর পর মনে হলো আবার কবে পাহাড় নিমন্ত্রণ পাঠাবে? ততদিন “দূরে কোথায় দূরে দূরে/আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে...