৪০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে জীবন কাটল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের, সততার সহজপাঠ ছিল হাতের কাছেই

Buddhadeb Bhattacharjee: পশ্চিমবঙ্গের আদ্যন্ত `ভদ্রলোক মুখ্যমন্ত্রী’র কথা কি বেশি করে মনে পড়ছে না রাজ্যবাসীর?

আজকে মন্ত্রিত্বের ডেফিনেশন কী? শিশুরাও বলবেন, রাজ্যের নানা প্রান্তে ইমারত, গ্যারেজে বিলাসবহুল গাড়ির লাইন, বছরে নিয়ম করে বিদেশ ভ্রমণ এবং অবশ্যই কালো টাকা। সঙ্গে গুছিয়ে নেওয়া। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারের পর এই কথাগুলো আরও বেশি করে মাথাচাড়া দিচ্ছে। রাজ্যের নানা প্রান্তে পার্থর বিলাসবহুল সব বাড়ির সন্ধান পেয়েছে ইডি। আর সেই সব ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছে কুবেরের ধন। এমন সময়ে  পশ্চিমবঙ্গের আদ্যন্ত `ভদ্রলোক মুখ্যমন্ত্রী’র কথা কি বেশি করে মনে পড়ছে না রাজ্যবাসীর? মনে পড়ছে না বিমান বসুর কথা, বৈভবশালী পরিবারের ছেলে হয়েও সারাটা জীবন কাটিয়েছেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের চিলেকোঠার ঘরে? তাঁদের অনাড়ম্বর জীবন আজকের মন্ত্রীদের জন্য অবশ্যই হয়ে উঠতে পারে সততার সহজপাঠ।

উদ্ধত, অহংকারী (নিন্দুকেরা কী না বলে), সাহিত্য-সিনেমায় বেশি উৎসাহী, শিল্পপতিদের দু’চোখে দেখতে না পারা বুদ্ধদেব ভট্টচার্য সম্পর্কে জ্যোতি বসুর মন্তব্য ছিল, "ও পারবে। ও বদলেছে, ও পারবে।" পেরেছেন কি না, তা নিয়ে সময়ের আবর্তে তর্ক চলতে পারে। তবে একটা কথা পরিষ্কার করে বলা যায়, তাঁর জীবনযাত্রা ঈর্ষনীয় ভাবে সৎ। সারাটা জীবন পাম অ্যাভিনিউয়ের ছোট ফ্ল্যাটটায় কাটিয়ে দিলেন। যাঁদের ওই বাড়ির অন্দরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, তাঁরা বলেন, বইয়ের পাহাড়ে কার্যত ডুবে থাকেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। ঘরটি বইয়ের ঐশ্বর্যে পূর্ণ। তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কোনও বিশেষ সুবিধা নিতেন না বলে শোনা যায়। এমনও শোনা যায়, তাঁর মেয়ে সুচেতনা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির জন্য অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ফর্ম তুলেছিলেন। বিশেষ কোনও সুবিধা নিতেন না তাঁর পরিবারের সদস্যরাও।

আরও পড়ুন-বৃদ্ধ বিমানেই কেন বারবার ভরসা রাখছে বামেরা?

রাজ্যে শিল্প আনতে গেলে শিল্পপতিদের ব্যাপারে যে নাক সিঁটকোলে হবে না, এটা বুঝতে বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু শোনা যায়, রবীন্দ্রসদন-নন্দন চত্বর ছেড়ে বনিকসভার অনুষ্ঠানে যেতে তাঁর খানিক আপত্তি ছিল। এমনকী তিনি নাকি পাঁচতারা হোটেলের মহার্ঘ ভোজসভা এড়িয়ে যেতেন। 

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একজন বাঙালি বামপন্থী রাজনীতিবিদ, যিনি পশ্চিমবঙ্গের সপ্তম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২৪ বছর যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন। ১৯৪৪ সালের ১ মার্চ কলকাতায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্ম হয়। প্রখ্যাত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর কাকা ছিলেন। বুদ্ধদেব শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় থেকে স্কুল জীবন শেষ করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা সাহিত্যে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পাশ করে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন তৎকালীন সিপিআই এর সঙ্গে খাদ্য আন্দোলনে। এভাবেই সক্রিয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি বুদ্ধদেবের।

তাঁর সাহিত্য প্রেমের কথা কে না জানেন! তিনি বহু বিদেশি লেখকের লেখা যেমন – পাবলো নেরুদা এবং গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তাছাড়া তিনি নিজেও বামপন্থা সম্পর্কে বেশ কিছু বই লিখেছেন। বই যাঁর সহায় ও সম্পদ- তাঁর জীবনযাত্রা যে এরকম আড়ম্বরহীন হবে, তা বলাই বাহুল্য।

২০১১ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েছিল নির্বাচনের পরাজয়ের ফলে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, দোষ যে একতরফা বুদ্ধদেবের ছিল এমনটা নয়, তবে নিন্দুকেরা তাঁর দূরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ৩৪ বছরে যে ঘুণ ধরেছিল, তার বহিঃপ্রকাশ বাম জমানার পতন। তবে দোষ, গুণ, কৃষি-শিল্প নিয়ে যতই তর্ক বিতর্ক থাক না কেন, বাঙালি নিঃসন্দেহে একজন `ভদ্রলোক মুখ্যমন্ত্রী’ পেয়েছিল। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে, মনে রাখবে `ব্র্যান্ড বুদ্ধ’র ঊর্ধ্বে থাকা এক রাজনীতিককে, যাঁর মেজাজটাই আসল রাজা, আদর্শে মোড়া, আড়ম্বরহীন এক মানুষ।

আরও পড়ুন : বাংলাকে তথ্য প্রযুক্তির দুয়ারে এনেছিলেন তিনিই! মানব মুখোপাধ্যায়কে কেন ভুলবে না রাজ্য

বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আরও অনেক নেতার এরকম জীবন যাপনের নজির রয়েছে। বিমান বসু আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ছাদে থাকেন একটা ছোট্ট ঘর। সারাটা জীবন সেখানেই কাটিয়ে দিলেন। তাঁকে যেসব সাংবাদিক খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা বলেন, তিনি সন্ন্যাসীর মতো জীবন যাপন করতেন। আলিমুদ্দিনের ছাদে যত্ন করে গাছের পরিচর্যা করতেন। সেগুলি ফুলের টব নয়, প্রচুর শাক সবজি হতো। কখনও কখনও সেই সব সবজি দিতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং নিরুপম সেনকে। দিল্লিতে যখন যেতেন, থাকতেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পার্টি মিটিংয়ে যাওয়ার আগে নিজে ব্রেক ফাস্ট বানাতেন। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে তাঁর অনুরাগের কথা অনেকের অজানা। বিমান বসু রান্না করতে খুব ভালোবাসেন। করোনাকালে কসবায় আয়োজিত ছাত্র যুবদের জনতার রান্নাঘরে হাজির হয়েছিলেন তিনি। সেখানে রান্না ঘরে ঢুকে নিজে হাতা খুন্তি নিয়ে রান্না করতে শুরু করে দেন। অবাক হন সেখানে উপস্থিত সকলে।

সম্পন্ন পরিবারের সন্তান বিমান বসু কমিউনিস্ট আন্দোলনের তাগিদে ঘর ছেড়েছিলেন, সেই কবে, তা আজ বিস্মৃতির অতলে। একসময় পার্টি কমিউনে থেকেছেন। নিজে রেঁধে খয়েছেন। এই সেদিন পর্যন্ত নিজের জামাকাপড় নিজে হাতে কাচতেন। পরে সিপিএমের পার্টি অফিস আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের এক চিলতে ঘরে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন। আলিমুদ্দিনের ছাদে বাগান করেছেন। খুপড়ি হাতে সেই বাগানের পরিচর্চায় তাঁর অনেকটা সময় কাটে। স্মৃতি রোমন্থন করলে ছাত্র জীবনের সেই ঝোড়ো দিনগুলির কথা মনে পড়ে। প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন থেকে স্টুডেন্ট ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া। ১৯৮৫ সালে রাজ্য সম্পাদক হওয়া, আরও কত কী! হারিয়েছেন জ্য়োতি বসুর মতো পথপ্রদর্শককে, কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তীর মতো সতীর্থরা চলে গেছেন। প্রমোদ দাশগুপ্তর মতো অভিভাবক আজ স্মৃতির আড়ালে। কত যুদ্ধ, কত পথে নেমে লড়া।

আরও পড়ুন : সেদিন সন্তানতুল্য বুদ্ধদেবের কটাক্ষে আহত হয়েছিলেন গীতা মুখোপাধ্যায়

একেবারে সাদামাটা জীবন-যাপন ছিল প্রাক্তন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান প্রয়াত প্রমোদ দাশগুপ্তের। শোনা যায়, তিনিও নিজের কাজ নিজে করতেন। দিনের শেষে রোজ নিজের ধুতি, পাঞ্জাবি কেচে ধুয়ে মেলে দিতেন। নিজের হাতে সেগুলি ইস্ত্রি করতেন। অল্প দামের সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন। শখ বলতে ছিল চুরুট।

আজকে যখন আলোচনায় আসছে, বামপন্থী নেতাদের আড়ম্বহীন জীবন যাপনের কথা, তখন পাশাপাশি উঠে আসছে পার্থর জীবন ধারাও। বিমান বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তরা নিজের কাজ নিজে করতেন, আর পার্থকে নাকি স্নান করিয়ে দিতে হয়। কারণ স্থূলতা বা বিলাসিতা যাই হোক, মোদ্দা কথা হল, একদিনের নিরলস সংগ্রামের বিছানো ফসল আজ কি নিশ্চিন্তে মাড়িয়ে চলছেন না নেতা মন্ত্রীরা?

More Articles