ভয় দেখানো হিন্দুস্তানি পুরুষোত্তম নয়, বাংলার ছিল শূদ্রপ্রিয় এক রাম...

Sri Sri Ram Thakur Kaibalyanath: ১৮৬০ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম রাম ঠাকুর ওরফে রামচন্দ্র চক্রবর্তীর। ছোটবেলা থেকেই আধ্যাত্মিক ভাবের মধ্যে ডুবেছিলেন।

হিন্দুত্বের মহা আস্ফালন দেখা গেল আবার। ভারতব্যাপী উদযাপিত হলো রামনবমী। এবছর নাকি এই রামনবমী থেকেই হিন্দুত্ববাদীদের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছে রাম মহোৎসব। দেখা যাচ্ছে, বাংলা ক্রমশ ভয় পাওয়ানো হনুমানের মুখাবয়বশোভিত গেরুয়া পতাকা আর হিন্দি স্লোগান ও গান এবং খোলা অস্ত্র সহযগে রামনবমী পালনে পুরোপুরি মেতে উঠেছে। আর তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের গণচৈতন্য তার স্মৃতিবিপর্যয়কে সম্পূর্ণ করে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। আর তাই এই বিস্মৃতির মহাসমারোহে কিছু কথা লিখে রাখা জরুরত। দরকার, আমাদের মাটির সাংস্কৃতিক পরম্পরা, বর্ণবাদী ও পিতৃতান্ত্রিক বৈদিক উত্তর ভারতের সমান্তরালে বঙ্গের ভাব ও বস্তুর যুগল লীলাভূমের রঙ, রূপ ও মোলাকাতের প্রসঙ্গগুলিকে বারবার কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের গিনিপিগ বাঙালিদের সামনে তুলে আনা। এইহেতু এই লেখা। কেননা, মনে করানো দরকার, হিন্দুত্বের এই পৌরাণিক ও রাজনৈতিকভাবে নির্মিত রামের সমান্তরালে বাংলার লীলাভূমে রাম নাম্নী আলোকপুরুষ ছিলেন অনেক। এমনকী সেই সকল রামের মধ্যে ছিলেন শূদ্র ও মজলুমের আপনজন হয়ে থাকা এক রাম।

রামনবমীর পেশিবহুল রাজনৈতিক রাম 

বঙ্গের রামেরা কেউ পৌরাণিক নন, বরং ঐতিহাসিক। আবার একইসঙ্গে তাঁরা ঐতিহাসিক কিংবদন্তিও বটে। তিনি উচ্চবর্ণের চৌহদ্দির গণ্ডিতে আটকা পড়ে থাকেননি, তাঁদের কাউকে কাউকে বাবুসমাজ গণ্ডিবদ্ধ করতে চেয়েছে বটে, কিন্তু পারে নাই। আবার তাঁদের মধ্যে একজন বিশেষভাবে মিশে গিয়েছিলেন নিম্নবর্গের সঙ্গেই। ভয় পাওয়ানো রামের সমান্তরালে বাংলার লীলাপরম্পরার রামের কথা স্মরণ করার আগে প্রসঙ্গক্রমে এ লেখার শুরুতে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রামনবমীর দিন আমরা যা দেখলাম, তার সারাংশটুকু।

আমরা দেখলাম, আমাদের রাজ্যে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে রামনবমীর মিছিল। এমনকী প্রশাসনের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্রমিছিলও হয়েছে। হাওড়া সদরে কাজীপাড়া অঞ্চলে রামনবমীর মিছিল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে অশান্তি। কাজীপাড়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আমরা সকলেই জানি, এখন রমজান মাস চলছে। রোজাদার মুসলিমরা সারাদিন নির্জলা রোজা রাখছেন। এহেন পরিস্থিতিতে ওই অঞ্চল দিয়ে কীভাবে মিছিল গেল প্রশ্ন উঠেছে। হ্যাঁ, ওখানকার মিছিলের অনুমতি দিয়েছিল পুলিশ-প্রশাসন, কিন্তু কীভাবে এটা তারা পারল, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশাসনিক বা সরকারি মহলে এমন প্রশ্ন উঠছে আর কই! ওদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের হিন্দিভাষী নেতা অর্জুন সিং যথারীতি তাঁর পেয়ারের ভাইবাদ্রারদের সঙ্গে ব্যারাকপুর অঞ্চলে রামনবমীর জুলুশে হাঁটলেন! সেই মিছিলে অর্জুন সিংয়ের এই সেদিনকার দল বিজেপির নেতারাও ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই। যাদবপুরের মতো তথাকথিত প্রগতিশীল এলাকাতেও রামনবমীর আস্ফালন ছিল চোখে পড়ার মতো।

আরও পড়ুন-উগ্র ক্ষত্রিয় রাম নয়, হাওড়ায় পূজিত হয় বাঙালির আদি সবুজ রাম 

এমনকী সামাজিক মাধ্যমেও দেখা গেল, মগজ ধোলাই হওয়া বঙ্গীয় জনতার বড় একটা অংশকে রামনবমীর আস্ফালন চালাতে! অর্থাৎ, ২০১৪ সালে প্রথমবার বিজেপি ভারতের ইউনিয়ন সরকার গঠন করার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি-হিন্দু-সংস্কৃতির সম্পূর্ণ প্যাকেজ সেই যে আমদানি শুরু হলো, ২০১৬, ২০১৯ ও ২০২১-এর বিধানসভা, লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে এবং এখানকার সকল রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের রাজনৈতিক বিচারশূন্যতার কারণে আজ সেই প্যাকেজে জনমগজের বড় অংশই ধোলাই হয়ে গেছে। ফলত, অতিদক্ষিণপন্থী ও হিন্দি-হিন্দুত্বের আধিপত্যকামী, আগ্রাসী আরএসএস-বিজেপি বাংলায় একটা কাজ খুব গুছিয়ে করে ফেলতে পেরেছে বলেই মনে হচ্ছে। সেটা হলো, উত্তরভারতীয় বর্ণবাদী ও হিন্দু জাতিবাদী সংস্কৃতির আধার হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের গণমনস্তত্ত্বের দক্ষিণপন্থী পুনর্নির্মাণ। এ কাজে তারা অনেকাংশেই সফল।

বাংলার চালচিত্রের মাঝে আমাদের যতেক প্রাণরাম

উত্তর ভারত থেকে আমরা বর্ণবাদী, পিতৃতান্ত্রিক রামকে আমদানি করেছি, কৃত্তিবাসী রামের কথা বিস্মৃত হয়ে। যদিও সেসবই হয় পুরাণ ও কাব্য। কাব্য হারিয়ে গেছে, পুরাণের ভিতর ঢুকে পড়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিরাষ্ট্রের রাজনীতি। পুরাণকে পাশ কাটিয়ে অপরাজনীতির নির্মাণে আমরা তলোয়ার, লাঠি, এমনকী রিভালবারের আস্ফালনকে সামনে আনতে দিয়েছি ওদের। যারা গুজরাতে মুসলিম মহিলার যোনি ফুঁড়ে সেই তলোয়ার জরায়ু থেকে সেই যে সেবার বের করে এনেছিল জন্মের অপেক্ষায় থাকা ভ্রুণ, সেই না-জন্মানো ভ্রুণের ভয় আর সেই মায়ের আর্তনাদ করতে করতে মারা পড়ার রাজনৈতিক স্মৃতিকে আমাদের সামনে এনে ওয়ার অ্যান্ড টেররের উপমহাদেশীয় মডেল তৈরির প্রক্রিয়া জারি রয়েছে খণ্ডিত এই বঙ্গে। এর ভিতর দিয়ে আমাদের এই পশ্চিম বাংলাকে ওরা দখলে নিতে চাইছে! আমরাও ওদের সেই চাওয়াকে পূর্ণ করছি, আমরা রামজাদাদের ইশারায় নাচছি।

অথচ আমাদের এই মাটিতে 'পুরুষোত্তম' রামের বর্ণবাদ, পিতৃতান্ত্রিক আস্ফালন ছিল না কখনও। এখানে ছিলেন নিরাকারের ভাবে, এক ও অদ্বিতীয় পরম ব্রহ্মের প্রতি শক্ত ইমানওয়ালা এক পণ্ডিত। আরবি-ফার্সি-সহ বহু ভাষা জানা বঙ্গের বিশ্বজানালা রামমোহন রায়। এখানে শাক্তভাবের ভিতর দিয়ে প্রাণ ও পরমের এবাদতে বুঁদ হয়ে গিয়েছিলেন মহাকবি রামপ্রসাদ সেন। কালী নামে বেড়া বাঁধার দাওয়াত রেখেছিলেন গানে গানে, আর সেই গানে মজেছিলেন বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লা। রামপ্রসাদ আমাদের চিন্তাচেতনে আবাদ করে গেছিলেন প্রেম, ভক্তি, মায়া ও লীলার কাব্যিক অভিসন্দর্ভ। ইতিহাসের মায়ার সেই কালিক নৌকায় চড়ে হুগলি জেলা ক্রমে গঙ্গা পার করে নমঃশূদ্র পরিবারের বিধবা নারীর মন্দিরে পৌরহিত্য করতে এসেছিলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়। ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন পরমহংস। পুরুষোত্তম রাম নয় বরং প্রাণের ভিতরে যে প্রাণরামের বাস, হৃদয়ের অন্তঃস্থলে যে কৃষ্ণকানাইয়ে বাস, সেই পরমের হদিশ কালীনামের ভিতর দিয়েই পেয়েছিলেন পরমহংস রামকৃষ্ণ। যিনি মন্দির থেকে মসজিদ, মসজিদ থেকে মাজার— সর্বত্রই নানা নামের আড়ালে খুঁজতে চেয়েছিলেন কালের আদিকে। যে পরমশূন্য আদি থেকে জন্ম নিয়েছে সময়। সময়ের সেই আদি একই সঙ্গে হাজির ও গায়েব (অদৃশ্য), এই রূপ-অরূপের লীলার ভিতরে আলোকসন্ধান তিনি চালালেন, তার জন্যেই অতি সহজে বলতে পারলেন, ‘যত মত তথ পথ’। এই নানা পথ ও মতের বৈচিত্র্য ও তার ঐক্যের সন্ধানে তিনি একদা পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে শরিয়ত অনুসরণ করেছেন যেমন, তেমনই পীর-আওলিয়াদের মারেফতেও মজেছিলেন।

আরও এক রাম আছিল বৃহৎ বঙ্গের আধ্যত্মে, কৈবল্যনাথ রাম ঠাকুর। যিনি ছিলেন শূদ্র আর মজলুমের আপনজন। যিনি নিজের জীবন দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদকে স্পিরিচুয়ালি ও কালচারালি প্রতিহত করতে পেরেছিলেন। আর মেটাফিজিক্যাল ভগবানের বিকল্পে যিনি সেই পারম্পরিক বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছিলেন, যিনি সত্যপীরের ভাবে একদা ভেসে গিয়েছিল শূদ্র-মজলুম-অনার্যের বঙ্গদেশ, সেই সত্যপীরকেই আধুনিক ও ঔপনিবেশিক সময়কালে সত্যনারায়ণ হিসাবে 'হিন্দু' সমাজের সামনে এনে বর্ণ ও ধর্মের বিভাজন ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। পুরুষ ও প্রকৃতি সম্মিলনের সাংখ্য দর্শনকে আধ্যত্মিক মার্গে নিয়ে যাওয়া কৈবল্যনাথ রাম ঠাকুর সনাতনী বাঙালির ঘরে সত্যপীরের ভজনাকে লৌকিক ব্রত হিসেবে পত্তন করেছিলেন সত্যনারায়ণ রূপে৷ কে এই সত্যপীর বা সত্যনারায়ণ? তিনি হলেন মনসুর হল্লাজ৷ যিনি বলেছিলেন, 'আন-অল-হক' অর্থাৎ আমিই সত্য৷ এই 'আমি' আমিত্বের আমি নয়৷ এই 'আমি' হলেন তিনি যিনি সকল প্রাণসত্তার নিগূঢ়ে বসে থাকেন পরম এক 'আমি' হয়ে৷ যে 'আমি'র কথা যেমন কোরআনে আছে, তেমনই আছে সকল সনাতনী কাব্যে ও ধর্মশাস্ত্রে৷

জীবনভর জাতপাত, বর্ণবাদ ও ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে নিজের মতো করে লড়াই চালিয়েছিলেন যিনি, আমরা সেই রাম ঠাকুরকেও ওরফে রামচন্দ্র চক্রবর্তীকেও ভুলে গেলাম। যেভাবে আমরা আমাদের ভাষাকে ভুলে যাচ্ছি, ভুলে যাচ্ছি ইতিহাস, ভুলে যাচ্ছি স্মৃতি ও সত্তা আর ভবিষ্যতকে সমর্পণ করছি রামজাদাদের হাতে, যাদের হাতে এবং পুংলিঙ্গের আস্ফালনে আর্তনাদ করতে করতে শহিদ হয়েছিলেন গুজরাতের শত শত মুসলিম নারী ও শিশু।

রাম ঠাকুর

কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল তাঁর 'শাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ' কাব্যগ্রন্থে ‘রাম ঠাকুর’ শীর্ষক কবিতায় লিখছেন, ‘বাল্য থেকে অনবরত ভ্রমণশীল এই ঠাকুর’। কোথায় ভ্রমণ করেছেন? মানুষের উঠোন থেকে উঠোনে, উঠোনে। মানুষের আলয়ে। কখনও বা রাঁধুনির কাজ করেছেন। কখনও বা সমাজ যাদের প্রান্তে সরিয়ে রাখে আর শুধুই যাদের মাংসপিণ্ড আর রূপলাবণ্যটুকু টাকা দিয়ে কিনে মৌজমস্তি করে, সেইসব বারবণিতার সেবা করেছেন, নিজের হাতে রান্না করে তাদের মুখে অন্ন তুলে দিয়ে। ১৮৬০ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম রাম ঠাকুর ওরফে রামচন্দ্র চক্রবর্তীর। ছোটবেলা থেকেই আধ্যাত্মিক ভাবের মধ্যে ডুবেছিলেন। আধ্যাত্মিক অন্বেষণে ঘুরে বেরিয়েছেন বিভিন্ন জায়গায়। সাংখ্য, পাতঞ্জল, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি অবৈদিক দার্শনিক ঘরগুলোতে যাপন করেছেন এবং মানুষ ভজনার যে পরম্পরা এই বৃহৎ বঙ্গে, নিজের আধ্যাত্মিক অবস্থানকে সেই মানুষের মাঝেই স্থিত করেছেন।

বিভ্রমবাদী শঙ্করাচার্যীয় দর্শন বা ‘জগত মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য’-র বয়ানে তিনি মাতেন নাই। বরং পুরুষ ও প্রকৃতির দ্বৈতাদ্বৈতের সাংখ্য কিংবা সেই সাংখ্যক্রমে শ্রীচৈতন্যের অচিন্ত্যভেদাভেদ চিন্তা ও চর্চার আলো আর শূদ্র-মজলুম-হরিজনে প্রাণের মানুষ মহাপ্রভু নিত্যানন্দের সমাজ নির্মাণের প্রেরণাও রাম ঠাকুরের কাজের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তাঁর কৈবল্যপ্রাপ্তি হয়েছিল, তিনি কৈবল্যনাথ। আবার একই সঙ্গে তিনি মানুষের হৃদয়ে যে ঈশ্বর/ আল্লাহ/ সাঁই রয়েছেন সেই সত্যের এবাদতের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে মানুষ ভজনার ধারাকে রিচুয়ালে পরিণত করতে পেরেছিলেন। ঔপনিবেশিক বঙ্গে, সত্যপীরের বন্দনাকে জাতিদাঙ্গা পীড়িত সত্যনারায়ণ ব্রত চালু করার মধ্য দিয়ে।

অবিভক্ত বাংলাদেশের অবিভক্ত নোয়াখালি জেলার ফেনী সদরে বহুকাল বাস করেছেন রাম ঠাকুর। ১৯৪৬-এ হিন্দু মহাসভা, কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশ এবং মুসলিম লীগের অবাঙালি অংশটুকুর পারস্পরিক পরিচয়বাদী ও ক্ষমতালোভী বিবাদ থেকে জন্ম নেওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কলকাতা থেকে ছড়াতে ছড়াতে নোয়াখালিতে পৌঁছে গেছিল। সেই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার বিরুদ্ধে রাম ঠাকুর চেষ্টা চালিয়েছেন সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করার। বর্ণবাদ ও ধর্মীয় অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। মূলত সাম্প্রদায়িকতা থেকে ‘হিন্দু’ সমাজকে মুক্ত করার জন্যেই সুলতানি আমলের সত্যপীরের ব্রতকে সত্যনারায়ণ পূজা রূপে সামনে এনেছেন। আর ভক্তদের মাঝে এই ঠাকুর বলে গিয়েছিলেন, অকর্তা হতে। হৃদয়ে যে পরম কর্তাসত্ত্বা রয়েছেন, তাঁর লগে মহাব্বত সম্ভব, যদি উপরের কর্ত্তাভাব বা উপরের আমিত্ব বা ইগো-র প্রভুত্ব থেকে বের হয়ে আসা যায়। লালন সাঁই বলছেন, ‘আমি কথার অর্থ ভারী, আমি সে তো আমার নয়/ আমি কে তাই জানিলে সাধন সিদ্ধ হয়/”। এই পরম ‘আমি'র সান্নিধ্য পেতে হলে উপরের ‘আমিত্ব’ বর্জন ছাড়া গতি নাই। এটাই অকর্তা হওয়া।

আর ঠিক এ কারণেই ভক্তকে নিজের দরবারে না নিয়ে এসে রাম ঠাকুর ঘুরে বেরিয়েছেন ভক্তের দুয়ারে দুয়ারে। যেভাবে, চল্লিশ ঘর ভিক্ষে করে তবেই ফকিরির খেলাফত পাওয়া যায় বৃহত নদিয়ার ফকিরি ঘরগুলোতে, অনেকটা সেভাবেই আধুনিক সময়কালের সনাতনী সংস্কৃতির এক ফকির রাম ঠাকুর। বিত্ত থেকে, ইগো থেকে, প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে নিজেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করেছেন। ক্রমাগত হয়েছেন ডিক্লাসড। নিজের দরবারে ভক্ত সমাগম ঘটলে পাছে আবার এক প্রাতিষ্ঠানিকতা তৈরি হয়, স্পিরিচুয়ালিটির নামে পাছে তৈরি হয় কালচারাল ইগো, তাই এসবের ধার ধারেন নাই তিনি। বরং ছুটে গেছেন ভক্তের গৃহে। রাম ঠাকুরের বাসনা যেন অনেকটা রবি ঠাকুরের সেই গানটার মতোই।

“বসব তোমার পথের ধুলার 'পরে/ এড়িয়ে আমায় চলবে কেমন করে/ তোমার তরে যে জন গাঁথে মালা/ গানের কুসুম জুগিয়ে দেব তারে”...

রাম ঠাকুরের প্রয়াণ হয় ১৯৪৯ সালে, নোয়াখালির চৌমোহানী গ্রামে। মৃত্যুর পরে তাঁর জনপ্রিয়তা অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু তাঁর ভক্তকূলের প্রজন্মান্তর তাঁর ভাব ও ভাবনাকে কতটা লালন করতে পেরেছেন, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। অবৈদিক বাংলার ভাবপরম্পরায় শূদ্র ও মজলুমের কাছের মানুষ রাম ঠাকুর, অথচ তাঁর অবর্তমানে ক্রমে ভক্ত পরম্পরার অনেকেই কিন্তু আর গুরুর ভাব ও ভাবনার ধারকাছ দিয়েও যেতে পারেন নাই। সেই একই বৈদিক বর্ণাশ্রমের ভিতরেই তারা নিমজ্জিত হয়েছে। কলকাতার যাদবপুরে রাম ঠাকুরের আশ্রমই তার উদাহরণ। এই আশ্রম একভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পন করেছে বলে ঠাকুরের পরম্পরার একাংশের ভক্তকূলের অভিযোগ।  তার মানে, সেই আবারও বিস্মৃতির প্রসঙ্গ। হ্যাঁ আমরা আমাদের চৈতন্য থেকে ক্রমেই বিস্মৃত হচ্ছি।

আরও পড়ুন- অযোধ্যার রামমন্দিরে ৬ কোটি বছরের পুরনো শালগ্রাম! ইতিহাস নাকি মিথ?

এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন

বাংলায় রামায়ণের রামচন্দ্রকে ঘিরে মাতামতি সে অর্থে কোনওদিনই ছিল না। এমনকী বাল্মিকীর রামায়ণ আর কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ এক নয়। উত্তর ভারতের রাম অনার্য শম্বুকের মুণ্ডচ্ছেদ করেছিল, কী ছিল শম্বুকের অপরাধ? তাঁর ‘দোষ’, তিনি শূদ্র হয়েও ঈশ্বরের এবাদত করার স্পর্দ্ধা দেখিয়েছেন। এদিকে বঙ্গীয় কৃত্তিবাসী রাম কিন্তু অনেকটাই কোমল। তাঁর প্রেয়সী সীতার বিহনে বিলাপ করেন। বাংলার এ মাটিতে রাক্ষস কূলপতি রাবণ ও তাঁর পুত্র সন্তান ইন্দ্রজিৎকে বীরত্বের সম্মান জানিয়ে কাব্য রচনা করেন মধুসূদন নামের এক মহাকবি। এখানে আরাধ্যা কালীর সঙ্গে বাহাসে মাতেন ভক্ত রামপ্রসাদ। এখানে রামনন্দকে তর্কে হারিয়ে দেন মহাপ্রভূ চৈতন্য। দাবি তোলেন, ভগবান যদি থেকে থাকেন তাঁকে আমি এখনই পেতে চাই, তাঁকে হাজির করা হোক। এখানে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও শঙ্করাচার্যীয় মতবাদের বিরুদ্ধে জেহাদে মাতেন চৈতন্য-নিত্যানন্দ। এখানে বহুত্বের ভিতর দিয়ে একের সন্ধান চালান রামমোহন, বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবি-ফার্সি-তুর্কি উপাদান মিশে ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এখানে খণ্ড খণ্ড রূপবৈচিত্র্যের ভিতর দিয়ে অখণ্ড নিরাকার পরমেশ্বর আল্লাহতালাকে বুঝে নিতে চান মহাকবি সৈয়দ সুলতান। এখানে সকল মত ও পথকে স্বীকার করে বহুত্বকে কালীনামের ভিতর দিয়ে ধারণ করেন পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ। এখানে ধর্মবোধের পরম্পরা মেটাফিজিক্যাল ও পরিচয়বাদী নয়। হরিজন, শূদ্র, মজলুমের এই বঙ্গদেশে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরমের সম্মিলন পরম্পরাতে ‘বহিরঙ্গে রাধা আর অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ’ কিংবা ‘হৃদয়ে খোদার আরশ’ থাকার বিশ্বাসে ধর্মজিজ্ঞাসা চালিত হয়। আর এহেন পরম্পরা জুড়ে এখানে নাযেল হয় কাব্য, চারুকলা, সঙ্গীত, মেলামোচ্ছব-পার্বণ। এখানে ইতিহাসের কালপর্বে কখনও হাজির হন হরিচাঁদ, কখনও বা কৈবল্যনাথ রাম ঠাকুর। বাংলার প্রাণের মাঝে এমনই তো সুধা। অথচ আমরা ক্রমশই অমৃতভাণ্ডখানি হারায়ে ফেলছি, আমদানি করছি গরল। কিন্তু কণ্ঠে গরল ধারণ করে আমাদের উদ্ধার করবেন এমন কোনও ভোলানাথের দৃষ্টান্ত আজ আমাদের মাঝে আর নাই। তাই এখন জরুরি এই বেলা ঘরের খবর নেওয়া। আত্মভুবনকে চিনে নেওয়া। নইলে আমাদের ইতিহাস, পরম্পরা-সহ আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের ইতিবৃত্ত— সব উজাড় হয়ে যাবে।

এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন।
কেবা জাগে কেবা ঘুমায় কে কারে দেখায় স্বপন।।
শব্দের ঘরে কে বারাম দেয়
নিঃশব্দে কে আছে সদাই
যেদিন হবে মহাপ্রলয়


কে কার করে দমন।।

 - ফকির লালন শাহ

 

 

More Articles