কালীর বেশে ডাকাতদের শায়েস্তা করেছিলেন রঙপুরের অন্নদাদেবী, শিহরণ জাগানো সেই গল্প...
‘হাতে লাঠি মাথায় ঝাঁকড়া চুল,কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল।’ নিছক কাব্যিকথা রবি ঠাকুর লেখেননি। বঙ্গের ভাঁড়ারে সত্যিই এককালে বিবিধ দস্যুরতনের ঝাঁ চকচকে লিস্টি ছিল। কতই না তাদের ধরণ ধারণ । কেউ ডাকাতির আগে বাড়ির মালিককে আগাম বার্তা পাঠাত; কেউ বা আবার অ্যাকশনে গিয়ে বাড়ির সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্যের মাথা নামিয়ে ফেলত,যাতে অন্যান্যদের ত্রস্তাবস্থার সুযোগ নিয়ে চট জলদি কাজ সেরে চম্পট দিতে পারে। এ ছাড়াও, ডাকাতি সেরে গৃহকর্তাকে ঘিয়ে ভেজে পালিয়ে আসা- এসব তো ছিলই। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর সন্ধিলগ্নে আরেক কিসিমের আবির্ভাব ঘটল। পেশাদারি ডাকাতরা আগে থেকেই ছিল, এবার তাদের সাথে এসে যুক্ত হল মুঘল আমলের একদল পাইক বরকন্দাজ। কোম্পানির আগমনের ফলে এদের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়ে, ফলে ডাকাতিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়। তবে ডাকাত স্টিরিওটাইপের পুরুষবিক্রম যেমন ছিল, তেমনি তার বিপরীত মেরুর বীরাঙ্গনা কাহিনিও ছিল অজস্র। এ বাংলার সুধারসেই তো মাইকেল লিখছেন ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, উপন্যাসের কুশীলব হিসেবে বঙ্কিম হাজির করছেন দেবী চৌধুরানীকে। এমনই এক বীর গাথার নায়িকা ছিলেন রঙপুরের অন্নদাদেবী, কেবলমাত্র নিজের উপস্থিত বুদ্ধির জোরে যিনি এক বড়সড় ডাকাতদলের হাত থেকে পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন।
সে বহুযুগ আগের কথা। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখছেন “সত্তর বছর”, অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে, হিন্দুস্থানের খাসজমিনে তখন 'দেবী ব্রিটানিয়া'-র ঘোরতর শাসন। রঙপুর গ্রামের বিখ্যাত জমিদার বৈকুণ্ঠনাথ চট্টোপাধ্যায় পরিবার সমেত এক নিকটাত্মীয়ের বিবাহ উৎসবে পাড়ি দিলেন। বিবাহযাত্রীরা অট্টালিকা ফাঁকা করে মৌজে বিয়ে খেতে রওনা দিলেন বটে, কিন্তু পিছনে ফেলে গেলেন গোটাকয়েক দ্বারবান, চাকরবাকর এবং জ্ঞাতি ভাতৃবধূ অন্নদাদেবীকে। পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব এই স্ত্রীলোকের প্রহরাধীন ছিল আরও বেশ কিছু মহিলা।
নিকষ ঘন রাত, অমাবস্যা। নিশাচর ছাড়া সবাই ঘুমন্ত। এ অবস্থায় কারও খেয়াল করার কথা নয়, যে অদুরের খাল বরাবর তিনটে ছিপ নৌকা জমিদারি প্রাসাদ লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। নৌকার যাত্রীরা শুধুমাত্র সশস্ত্র নয়, তাদের চোখমুখে রয়েছে লাল ও কালো রঙের প্রলেপ। এ দলের সর্দারের নাম গদাধর দাস, যার নামে পরগণা কেঁপে ওঠে অহরহ সন্ত্রাসে। হঠাৎ রাজগৃহের আশেপাশে 'অমানিশার বক্ষ চিরে' শেয়াল কুকুর ডেকে উঠল, এমন সময় ‘হা-রে-রে-রে-রে-রে’ ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে।” বৈকুণ্ঠ জমিদারের গৃহপার্শ্বের বাঁশবনের ধারে নৌকা ভিড়িয়ে, গদাধরের দল পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই দারোয়ান, চাকরদের একহাত নিয়ে সোজা রাজ অন্তঃপুরের দিকে ছুটে গেল। ডাকাতি চলতে লাগল পুরোদমে, থেকে থেকে তার সন্ত্রাসদামামা বেজে উঠল, গ্রামজুড়ে মধ্যরাত্রে সে এক আতঙ্ক। ভেরি, দামামা বাজিয়ে, বাজনার চেয়ে খাজনা বেশি হট্টগোল করে এই আতঙ্ককেই কাজে লাগাত সে যুগের বহু ডাকাত।
অন্নদাদেবী ঘুম ভেঙে দেখেন, বাড়ির দরজা জানালা গুঁড়িয়ে নিরুপদ্রব লুঠতরাজ চলছে। এ অবস্থায় তিনি আর কীই বা করেন, বাড়ির মহিলাদের নির্দেশ দিলেন ছাদে গিয়ে ডাকাত তাক করে ইট মারতে। কথায় বলে, মশা মারতে কামান দাগা, কিন্তু ডাকাত মারতে এ হেন প্রতিরোধের নিদর্শন বড় একটা পাওয়া যায়না। আর গেলেও, তাতে সফল হওয়ার সম্ভবনা কতদূর সে নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে লাভ কিছু হয়েছিল। মশালের আলোয় মহিলাদের লক্ষভ্রষ্ট হওয়ার সুযোগ বিশেষ ছিল না, ফলত ডাকাতদের বুক, পিঠ, মাথায় রাশি রাশি ঢেলা এসে পড়তে লাগল। গদাধরের দলবল সাময়িকভাবে দমে গেল ঠিকই, কিন্তু এভাবে আর তাদের কতক্ষণই বা ঠেকিয়ে রাখা যায়? বৈকুণ্ঠবাবুর তো আর প্রোমোটারীর ব্যবসা নয়, যে অনন্তকাল ধরে তার গৃহললনাদের ইট সাপ্লাই অব্যাহত থাকবে।
এমতাবস্থায় অন্নদাদেবীকে ডাকাতদলকে নিবৃত্ত করার পাকাপাকি ফন্দি আঁটতে হল। বুদ্ধিমতী অন্নদা এক খাবলা ভুষো কালি নিয়ে মুখে মাখলেন, তারপর কপালে সিঁদুরের বিরাট টিপ পরে, পিঠের উপর মুক্তকেশ এলিয়ে দিয়ে কালীরুপ ধারণ করলেন। তাঁর ঘরে ঢুকে ডাকাতরা দেখল, সাক্ষাত করালবদনী, খড়গ হাতে দাঁড়িয়ে, অনড়। ডাকাতদের কালীভক্তির কথা কে না জানে? একটা সময় ছিল, যখন অমাবস্যা তিথিতে মাকে নররক্তের প্রসাদ নিবেদন করে তারা কাজে বের হতো। যাই হোক, অন্নদাদেবীর অমন প্রলয়ঙ্করী রূপ দেখে গদাধরের কলজে শুকিয়ে এলো। অস্ত্রশস্ত্র একপাশে সরিয়ে রেখে সে সোজা কালীচরণে পড়ে মাথা কুটতে লাগল। তার ধারণা হল, মা কালীর ডাকিনী যোগিনীরাই এতক্ষণ ধরে তাদের লক্ষ্য করে ইট পাটকেল মারছিল।
অন্য গল্প পড়ুন-দশটা-পাঁচটার চাকরি থেকে বিশ্বসুন্দরীর মঞ্চে, মানসা বারাণসী যেন চিররহস্যময়ী…
দেবী রুষ্ট হয়েছেন, আর কি ডাকাতি চালানো চলে? গদাধর লুঠের যাবতীয় সামগ্রী ফেলে দল নিয়ে পিঠটান দিল। এদিকে দীর্ঘক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে অন্নদাদেবীর হাত পা অবশ হয়ে এলো, শিগগিরই তিনি মাটিতে পড়ে মুর্ছো গেলেন। এমন রোহমর্ষক ঘটনা বাঙালির অগোচর থাকবে তা কি আর হয়? সেকালের প্রায় সকল নামী সংবাদপত্রে অন্নদাদেবীর বীরত্বের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সরকারের কাছ থেকে পুরস্কৃতও হন তিনি। এ বাংলার আনাচ কানাচ ছেঁচে উপকথা সন্ধানে গেলে, এমন কত বীরাঙ্গনার গল্প যে উঠে আসবে তার ইয়ত্তা নেই। আমরা পাঠককে বারবার সেই গল্প বলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।