ছড়ার দুনিয়ায় নিভল আলো, আর শোনা যাবে না 'বাংলাটা ঠিক আসে না'
Bhabani Prasad Majumdar: পুজাবার্ষিকী বা শারদীয়ার পাতা মানেই একসময় ভবাণীপ্রসাদের মিঠেকড়া সব ছড়ার ছড়াছড়ি। শুধু কি ছড়া, গল্পেও তিনি আসর মাতিয়েছেন বিস্তর।
বাংলা সাহিত্যের ধারায় ছড়া লিখেছেন অনেকেই। কিন্তু ছড়ার প্রতি তেমন ভাবে একনিষ্ঠতা দেখিয়েছেন হাতে গোনা মানুষ। সুকুমার রায়ের শ্রেষ্ঠ উত্তরসূরি ছিলেন তিনি। ছোটদের মলাটের মধ্যেও যে বড়দের কথাটি গুছিয়ে বলে দেওয়া যায়, সেটাই দক্ষতার সঙ্গে আজীবন দেখিয়ে এসেছেন। আর তার মাধ্যমেই আট থেকে আশির হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। বুধবার থামল সেই পথচলা। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে বুধবার ভোরে প্রয়াত হন কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
১৯৫০ সালের ৯ এপ্রিল, শিবপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত হাওড়ার সানপুরেতে জন্ম ভবানীপ্রসাদের। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট থেকেই কবিতাচর্চার শুরু। তবে কবিতার চেয়ে ছড়ার দিকেই বরাবর বেশি ঝুঁকে ছিলেন তিনি। সানপুর কালীতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীকালে সেই স্কুলের অধ্যক্ষও হন ভবানীণীপ্রসাদ। ‘ভবানী স্যার’ নামে গোটা তল্লাটে দারুণ সুনাম ছিল তাঁর। পুজাবার্ষিকী বা শারদীয়ার পাতা মানেই একসময় ভবানীপ্রসাদের মিঠেকড়া সব ছড়ার ছড়াছড়ি। শুধু কি ছড়া, গল্পেও তিনি আসর মাতিয়েছেন বিস্তর। তাঁর লেখা বহু ছড়া, গল্প পড়ে বড় হয়েছে একসময়ের ছোটরা। ছোটদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বেশি হলেও বড়দের জন্যেও যে একেবারে লেখেননি তিনি, এমনটা নয়। ছাগলের কাণ্ড, রঙ বদলের ব্যাপার স্যাপার, বাংলাটা ঠিক আসে না— এ রকম তাঁর লেখা বহু ছড়া ও কবিতা জনপ্রিয়তা লাভ করে।
আরও পড়ুন: থামল ‘অন্ধ স্কুলের ঘণ্টা’, প্রয়াত কবি দেবারতি মিত্র
ছড়া লেখাকে যতই সহজ মনে করুক লোকে, আসলে কিন্তু তা বেদম শক্ত কাজ। ছড়ার মধ্যে থাকতে হয় যথাযথ কৌতূকবোধ, হাস্যরস এবং বুদ্ধিদীপ্ত ভাব। নাহলে গোটা চেষ্টাটাই বিফলে যায়। তবে ভবানীপ্রসাদের ক্ষেত্রে যে সেই কলম যথেষ্ট জোরালো, তার প্রমাণ তাঁর জনপ্রিয়তা। তাঁকে অনেকেই মনে করতেন সুকুমার রায়ের উত্তরসূরি। সুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার প্রাপক হিসেবেও নির্বাচিত হন ভবাণীপ্রসাদ। সেই পুরস্কার তাঁর হাকে তুলে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় খোদ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে পেয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পুরস্কার। এ ছাড়াও আরও বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন সারা জীবনে। শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সুকান্ত পুরস্কার, অমৃতকমল পুরস্কারের মতো একাধিক সম্মান ছিল তাঁর ঝুলিতে।
তাঁর লেখা শিশুদের জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকা সন্দেশে নিয়মিত প্রকাশিত হত। আনন্দবাজার পত্রিকা-সহ বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রেও তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বিখ্যাত বই ‘ছন্দে গড়া আবৃত্তি ছড়া’, ‘মিঠে কড়া আবৃত্তি ছড়া’, ‘রক্তে ভাসা বাংলা ভাষা’, ‘মিঠে কড়া মজার ছড়া’, ‘মিঠে কড়া পশুর ছড়া’, ‘ছন্দে গড়া মহান যারা’। 'বাংলাটা ঠিক আসে না' তার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা। আজও বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর তাগিদে যারা লড়েন, তাদের মুখে স্লোগানের মতোই শোনা যায় এই কবিতা। বরাবরই ভাষার প্রতি এক অদম্য টান পরতে পরতে মিশে থেকেছে তাঁর লেখায়।
বাংলা ভাষা নিয়েই নাকি এংলা-প্যাংলা সবাই মুগ্ধ
বাংলা যাদের মাতৃভাষা, বাংলা যাদের মাতৃদুগ্ধ
মায়ের দুধের বড়ই অভাব
কৌটোর দুধ খাওয়াই স্বভাব
ওই দুধে তেজ-তাকত হয় না, বাংলাও তাই হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা।বাংলাটা ঠিক আসে না!
সারা জীবনে লিখেছেন কুড়ি হাজারের বেশি ছড়া। করেছেন নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ‘মজার ছড়া’, ‘সোনালী ছড়া’, ‘কোলকাতা তোর খোল খাতা’, ‘হাওড়া-ভরা হরেক ছড়া’, ‘ডাইনোছড়া’র মতো একাধিক বই লিখেছেন তিনি। সত্যজিৎ রায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লিখেছেন ‘ছড়ায় ছড়ায় সত্যজিৎ’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ নইলে অনাথ’। একই সঙ্গে নানা বিষয়, নানা প্রেক্ষিতকে ছুঁয়ে গিয়েছে তাঁর কবিতাকে। যা কোনওদিনই ছোটদের হয়েও আর আটকে থাকেনি ছোটতে, বরং সেই গণ্ডি পেরিয়ে তা যে কখন সমকালীন হয়ে উঠেছে, তা বলা কঠিন।
যে ছেলেরা রাস্তা ঘাটে করছে পালিশ পরের জুতো
যে ছেলেরা ট্রেনের হকার , খাচ্ছে রোজই লোকের গুঁতো ,
লজেন্স খাওয়ার বয়স যাদের , করছে তারাই লজেন্স ফেরি
যাদের বুকে সূর্য ওঠার , গোলাপ ফোটার অনেক দেরি !
ওদের কাছে প্রশ্ন কোরো , ওরা কি কেউ সত্যি জানে
"স্বাধীনতা" জিনিসটা কি ? স্বাধীনতার সঠিক মানে?স্বাধীনতার মানে
আরও পড়ুন: থামল মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে যে, গত পাঁচ বছর ধরেই নানা ধরনের বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন কবি। শেষের দিকে শরীরে হানা দেয় ডিমেনশিয়ার সমস্যাও। দিন কয়েক আগে তাঁর নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। সঙ্গে দেখা দেয় শ্বাসকষ্টের সমস্যাও। পারিবারিক চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী গত সোমবার হাসপাতালে ভর্তি হন ভবাণীপ্রসাদ। আইসিইউ-তে রাখা হয় তাঁকে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ভবানীপ্রসাদ চলে গেলেন। থেকে গেল তাঁর অজস্র ছড়া, যা বাঙালির আবেগে, মননে রয়ে গেল আজীবন। শিশুপাঠ্য সাহিত্যের এই আকালের যুগে যা কোথাও গিয়ে ভরসা দেবে আগামী যুগের ছেলেপুলেদের তো বটেই, একই ভাবে আগামী দিনের ছড়াকারদেরও।