আয়না ভবন : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
Bengali Short Story: কী সুন্দর সামনেটা একটু একটু রক্তের লাল দাগ থাকত, কাটা ছাগলের শরীর থেকে একটু একটু মাংস ঝুলে থাকত, ওই আধখানা ছাগলটা অল্প অল্প দুলত।
আয়না ভবনের নাম যে আয়না ভবন হবে সেটা কেউই জানত না। আর বিশেষ করে বিপিনদার এই নামটা পছন্দও ছিল না। বিপিনদা ভেবেছিল, দোকানের নাম হবে 'দক্ষিণের বারান্দা'। কিন্তু বিপিনদার বাবার আবার সেই নামটা পছন্দ নয়। প্রথমত, দক্ষিণ শব্দে বিপিনদার বাবার তীব্র আপত্তি। দোকানের নামে কেউ দক্ষিণ শব্দ রাখে? খুবই অলক্ষুণে শব্দ এই দক্ষিণ। আর দ্বিতীয়ত, দক্ষিণের বারান্দা বললে লোকে কী করেই বা বুঝবে যে ওটা আয়নার দোকান? লোহার দোকানের নাম কি কখনও ফুলেশ্বর হয়? বা সেলুনের নাম কি 'আবার খাব' হতে পারে?
বিপিনদাও যে খুব একটা ভেবে এমন নাম রাখতে চেয়েছিল সেটা নয়। বেশ অনেকদিন আগে বিপিনদা কোথাও একটা এই শব্দটা পড়েছিল। 'দক্ষিণের বারান্দা'। শব্দটা পড়া মাত্র বিপিনদার খুব মনে ধরেছিল। বিপিনদাদের ওই দুই কামরার বাড়ির কোনটা দক্ষিণ কোনটা উত্তর বিপিনদা মোটেও চিনত না। খুব যে একটা চিনতে চেয়েছিল সেটাও নয়। বিপিনদার মনে হতো পুরো বাড়িটাই আসলে বারান্দা বা বারান্দাটাই বাড়ি। নামের ব্যাপারে বাবাকে অল্প বোঝাতে গিয়ে বিপিনদা টের পেয়ে গেছিল বিষয়টা লম্বা হতে চলেছে। একটা সামান্য নাম নিয়ে অত তর্ক করা বিপিনদার পোষায়নি। বাবার দেওয়া নামটাই একটা নীল বোর্ডে হলুদ কালিতে লিখে বিপিনদা বাইরে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। 'আয়না ভবন'। এই দোকানটা আসলে বুড়োমামার।
যতদূর জানা যায়, বুড়োমামার তিন কুলে কেউ নেই। বুড়োমামা কেন কোনওদিন বিয়ে করেনি এসব নিয়ে মিত্রবাজারে বেশ কয়েকটা গল্প চালু ছিল। কেউ বলত, বুড়োমামার প্রেম ভেঙে গেছিল বলে বুড়োমামা আর বিয়েই করল না, কেউ কেউ বলতো বুড়োমামা লিপিকা মাসির সঙ্গে প্রেম করে এখনও। লিপিকা মাসির বর মারা যাওয়ার পরে বুড়োমামাই লিপিকামাসির সংসার সামলায়। বুড়োমামার বিয়ে বা প্রেম নিয়ে বিপিনদার কোনও আগ্রহ ছিল না। বিয়ে বা প্রেম কেন, বুড়োমামাকে নিয়েও বিপিনদার কোনও আগ্রহ থাকার কথা নয়। কিন্তু যখন বুড়োমামা স্থির করল ওই দোকানটা মাত্র তিরিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেবে, বিপিনদা যেখান থেকে পারল টাকা জোগাড় করে সেদিন বিকেলেই বুড়োমামার কাছে হাজির। পরে বিপিনদা শুনেছে, ওই টাকা নিয়ে, বাড়ি তালা দিয়ে, লিপিকামাসিকে একা রেখে বুড়োমামা নাকি সিউড়ি চলে গেছে। বিপিনদা সেই বিষয়ে আর কথা বাড়ায়নি, কেউ এই নিয়ে কথা বলুক সেটাও চায়নি।
আরও পড়ুন- লুকিয়ে থাকা রুটম্যাপ: সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
বিপিনদার বহুদিনের স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই বিপিনদা নানারকম আয়না দেখতেই ভালোবাসত। লম্বা আয়না, গোল আয়না, চৌকো আয়না। এমনকী কোনও জানলা বন্ধ গাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একবার ঠিক জানলার কাঁচে বিপিনদা দেখে নিত। তবে ওই আয়নাগুলোর দিকে তাকিয়ে বিপিনদা যে শুধু নিজেকেই দেখত সেটা নয়। বরং চারপাশটা ওই আয়নায় কেমন দেখাচ্ছে সেটাই বেশি মন দিয়ে দেখত। কে কে পথে যেতে যেতে আয়নার দিকে তাকিয়ে কী কী করছে সেটাও বিপিনদা খেয়াল করতে ভালোবাসত। থেমে থাকা মোটর সাইকেলের আয়নার দিকেও বিপিনদা তাকাতে ভুলত না। ওই আয়নাগুলোয় কী লেখা থাকে সেটা বলে বিপিনদা তিন চারবার পাড়ার পুজোর ক্যুইজে পেনও পেয়েছিল। এখন আর এই প্রশ্ন শুনে উত্তর দিতে হাত তোলে না। বরং অপেক্ষা করে কে কী ভুল উত্তর দেয় এটা শোনার।
বিপিনদা দুঃখ করে মাঝেমাঝে বলেও, "আজকাল মানুষ মন দিয়ে আয়নাটাও দেখে না? খালি নিজের দিকে তাকিয়ে চুল ঠিক করলেই কি আর আয়না দেখা হয়? আগে আয়নাটা দেখতে হয়, তারপর চারপাশটা আর একেবারে শেষে নিজেকে।" কিন্তু কে কাকে বোঝাবে এই কথা? ছোটবেলায় নিজের জন্য চারটে ছোট ছোট বিভিন্ন রকমের আয়না কিনে বিপিনদা স্কুলের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখত। স্যার ক্লাস থেকে বেরোলেই বিপিনদা আয়না দেখত, আয়নায় রোদ ফেলে খেলত। সেই নেশাই বিপিনদাকে বড়বেলায় আয়নার দোকান খুলিয়ে ছাড়ল। এখন মিত্রবাজারে একমাত্র আয়নার দোকান 'আয়না ভবন'। দোকান সাজাতে একটু সময় লেগেছিল ঠিকই কিন্তু এতদিনে মোটামুটি আয়না ভবন প্রস্তুত। আয়না ভবনের দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন আয়না। বাঁ দিকের দেওয়ালে সাতটা আয়না, সামনের বড় দেওয়ালে দুটো বড় আয়না। তার মধ্যে একটাতে আবার নানারকম ডিজাইন করা। ডানদিকের দেওয়ালে, মানে যেখানে বিপিনদা একটা চেয়ার রেখে বসে, তার উপরেও পাঁচটা আয়না। আয়না ভবনের ডান পাশে খোকনের নার্সারির দোকান আর বাঁ পাশে বিকাশকাকুর মুদির দোকান। ঠিক উল্টো দিকে মনসার মাংসের দোকান। দোকানের সামনে উল্টো করে টাঙানো দুটো কাটা, চামড়া ছাড়ানো ছাগল।
আরও পড়ুন- বড়দিন : অলোকপর্ণা
মনসার দোকানের পাশ দিয়ে মিত্রগলি একটু দূরে ডান দিকে ঘুরে গেছে। দোকানে কাস্টমার না থাকলে বিপিনদা ওই চেয়ারে বসে আয়নার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ওই রাস্তা দিয়ে কে আসছে, কে যাচ্ছে, মনসার দোকানে কে কে এল, কে পাঁজর নিল, কে পা। চেয়ার থেকে উঠে যখন সামনের দেওয়ালের আয়নার সামনে বিপিনদা দাঁড়ায় তখন আয়নায় বিপিনদার মুখের ঠিক বাঁ পাশে মনসার কাটা ছাগল ঝুলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিপিনদা ওই আয়নার দিকে তাকিয়ে রাস্তা দেখে, কাটা ছাগল দেখে, নিজেকে দেখে, আবার রাস্তা দেখে। যখনই কোনও কাস্টমার আসে বিপিনদা আগে তাকে ওই আয়নার সামনেই নিয়ে আসে। বিপিনদা ছোট থেকেই জানে বাকিরা ওই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঝোলানো আধখানা ছাগল বা রাস্তা কিছুই দেখবে না, খালি নিজেকে দেখবে। কিন্তু বিপিনদা তখন আরেক রকম ছবি পায় তার আয়নায়। রাস্তা, ঝোলানো ছাগল, আয়না কিনতে আসা লম্বা চুলের কোনও মেয়ে এবং বিপিনদা। কখনও কখনও কোনও লম্বা চুলের মেয়ের বদলে শম্ভুদাও এসে ওই আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই শিস দিতে দিতে একটু চুল ঠিক করে নেয়। বিপিনদা ইচ্ছা করে একটা চিরুনিও কিনে রেখেছে। শম্ভুদা এলেই ও চিরুনিটা এগিয়ে দেয়। তারপর আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। অদ্ভুত ভালো লাগে বিপিনদার। মনে মনে ভাবে আয়না দেখতে শিখতে হয়। বিপিনদার গর্ব হয়।
সব ঠিকই চলছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন মনসা দোকান বন্ধ করে দিল। বিপিনদার একেবারেই ভালো লাগেনি ব্যাপারটা। মনসাকে বোঝাতেও চেষ্টা করেছিল বার কয়েক। মনসা নাকি দোকান বিক্রি করে টোটো কিনবে। টোটো আর মাংস এক হলো? কিন্তু মনসার ওই এক জেদ। বিপিনদার কাছে অত টাকা নেই যে সে মনসার মাংসের দোকানও কিনে নেয়। রোজ বিপিনদা আসে আর আয়নার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বন্ধ দোকান দেখে। কী সুন্দর সামনেটা একটু একটু রক্তের লাল দাগ থাকত, কাটা ছাগলের শরীর থেকে একটু একটু মাংস ঝুলে থাকত, ওই আধখানা ছাগলটা অল্প অল্প দুলত। এইসব ছবির পাশে কখনও লম্বা চুল মেয়েটা বা কখনও শম্ভুদা আয়নায় তাকিয়ে একটু হাসত। দেখত, হাসলে কেমন লাগে। আর বিপিনদা দেখতো রাস্তা, আধখানা ছাগলের দোলা, হাসি মুখের কাস্টমার এবং বিপিনদা। এর থেকে যদি মনসার মাংসের দোকানটাই বাদ চলে যায় কী মানে থাকে আর! বিপিনদার আর দোকানে যেতে ভালো লাগে না। প্রায় একমাস পেরিয়ে যাবার পর বিপিনদা একদিন দোকানে ফিরেই গেল। ওই আয়না ভবন বোর্ডটা খুলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। আর নতুন বোর্ড টাঙাল এবার। হলুদ বোর্ডে নীল কালিতে লেখা 'দক্ষিণের বারান্দা মিট শপ'। বিপিনদার বাবা তো ততদিনে মারাই গেছেন। সুতরাং আর কারও কোনও আপত্তি নেই।