একটা ফ্লাইওভার ও আলোর গল্প: অমৃতা ভট্টাচার্য
Bengali Short Story: এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে মানুষকে নিজের কথা বলতেও তো শুনিনি কোনওদিন। ভাগ্যিস শুনলাম! নাহলে তো জানতাম না মানুষও কত কিছু পারেনা!
একটা নীল গাড়ি এসে দাঁড়াল ঠিক পায়ের কাছে। কালও একটা গাড়ি এসেছিল। সেটা সাদা ছিল। কয়েক সেকেন্ড থেমেছিল। তারপর আবার চলে গেল। আজ নীল। গাড়ির ভিতরের আলো জ্বলল না। চাপা স্বরে হিসহিস করে উঠল পুরুষকণ্ঠ, “এটাই সবথেকে উঁচু জায়গা। বলো..."
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ সব। গভীর রাতে সব শব্দ হয় কমে যায়, অথবা বেড়ে যায়। রাত যত বাড়তে থাকে কোলাহল কমে যায়। সন্ধ্যের পর থেকে অন্ধকার নামতে থাকে, অন্ধকার বাড়তে থাকে ক্রমশ। রাত গভীর হয়। আমি দেখেছি, এক সময় রাত আর বাড়তে পারে না। তখন রাত জমতে থাকে। রাত জমতে জমতে কঠিন হয়। রাত কঠিন হলে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া আসে। কঠিন অন্ধকারে সে হাওয়া ঢুকতে পারে না। অন্ধকারের দেওয়ালে, অলিগলিতে ধাক্কা খায় হাওয়া। কঠিন অন্ধকারে সব চাপা পড়ে থাকে… শব্দ, ধুলো সব। তখন ওড়ানোর মতো কিছু পায় না। হাওয়া খুব হাল্কা তখন। হাল্কা হাওয়া এসে আমার শক্ত শরীরে লাগে। আমার আর দিন কী! অন্ধকার নামলে তবে কাজ শুরু। গভীর রাতে কঠিন অন্ধকারের পাশে দৈত্যাকার সরীসৃপ হয়ে পায়ের নীচে শুয়ে আছে ফ্লাইওভার। দিনে ঘুম। সন্ধে নামলে জেগে উঠি। সারারাত তাকিয়ে থাকি সামনের ওই প্রাসাদের মতো হোটেলের দিকে।
গাড়ির ভিতরে হাতের চুড়ির মৃদু আওয়াজ হল। এমন মৃদু আওয়াজও শোনা যায় এত রাতে। এখন আশেপাশের অনেক শব্দ কমে যায়। মানুষের এখন ঘুমোনোর সময়।
--“তোমার এখনই পদবিটা জানানোর খুব দরকার ছিল? বাবা তো সবে কথা বলতে শুরু করেছিলেন। এখনই সব বলতে হল?" এখন পুরুষকণ্ঠ বেশ জোরালো।
--“সত্যিটা তো বলতেই হত।" মহিলা কণ্ঠস্বর খানিকটা নিঃস্পৃহ। “তাহলে তুমিও বোধহয় মত পরিবর্তন করছো এখন, তাই তো?”
--“মত পরিবর্তনের কী আছে? বিয়েটা হয়ে গেলে তারপর জানলে যা ঝামেলা হত দেখা যেত– এখন সবদিকে বিপদ!”
--“তুমি যখন বাড়িতে বলেছিলে, তখন জানাওনি?” মেয়েটা শান্ত স্বরে বলল।
--“একদম প্রথমে আমি নিজেও জানতাম না। ফেসবুকে তোমার পদবি ছিল না। শ্রেয়া নামটা দেখে তো আর বোঝা যায়না...”
--“যে আমার পদবি ‘খান’।" মেয়েটা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি যে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি সেটা জানেন ওঁরা?”
--“হ্যাঁ সেটা তো প্রথমেই বলেছিলাম।“
--“অনাথ হিন্দু হলে কোনও সমস্যা হত না, বলো?” মেয়েটার গলার স্বর খুব হাল্কা হয়ে গেল হঠাৎ।
বাতাসে ভালই কুয়াশা এখন। রাত হলে আরও বাড়ে। তখন আমার চোখ ঝাপসা হয়। আমি ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকি সামনের আকাশছোঁয়া হোটেলটার দিকে। তেতাল্লিশ তলায় ডানদিকে কাচের বড় জানলার পাশে গোলাকার থামের আড়ালে আছে কৃত্তিকা। কৃত্তিকা আলো। আমাদের সবার পদবি আলো। পদবি নিয়ে আমাদের কোনও ঝামেলা নেই। কিন্তু তাতে কী লাভ! কৃত্তিকা আর আমি প্রায় সমবয়সী। একটা ঘরের এক কোণে পাশাপাশি থাকতাম আমরা। ও আমাকে দেখার আগে আমি ওকে দেখেছিলাম। তাই হিসেব মতো বয়সে আমি একটু বড়। প্রথম অনেকদিন কথা হয়নি সেভাবে। খদ্দেরের সামনে মালিক আমাকে মাঝে মাঝেই জাগিয়ে দিত। আমি জ্বলে উঠতাম। দেখা হয়ে গেলে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিত। এরকমই একবার এক খদ্দেরের সামনে জেগে উঠে তাকিয়ে দেখলাম সামনে উজ্জ্বল হলুদ রঙের অপূর্ব কৃত্তিকা। ডানদিকে ঘর আলো করে জ্বলে আছে। ওর উজ্জ্বল হলুদ দ্যুতির পাশে আমার সাদা রঙ কীরকম ম্যাড়মেড়ে দেখাচ্ছিল। আমি ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম ওর চোখে কৌতূহল। কী যেন জিজ্ঞেস করতে চাইছে আমাকে। আমি যতটা সম্ভব উৎসাহ নিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলাম। ওর চোখে একটা অদ্ভুত জিজ্ঞাসা। আমি মালিক আর খদ্দেরের ভিড় পেরিয়ে কী করে জানতে পারতাম কৃত্তিকার জিজ্ঞাসার কথা! খুব অস্থির লাগছিল নিজেকে। হঠাৎ খট করে আওয়াজ হল সুইচের। চোখদুটো জড়িয়ে এল ঘুমে। ঘুমিয়ে থাকলাম কতক্ষণ, কতদিন জানিনা। আবার একদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে জ্বলে উঠলাম। মাথায় পাগড়ি দেওয়া কয়েকটা লোক মালিকের সঙ্গে হিসেবনিকেশ কষছে। আমি ডানদিকে তাকালাম। কৃত্তিকা ঘুমিয়ে আছে এখন। ঘুমোলে ওর চেহারায় একটা সাদা মায়া থাকে। মনে হয় একটা প্রশ্ন, একটা ভয়, একটা ভয়ের প্রশ্ন মায়ার মতো লেগে আছে ওর বন্ধ চোখে। কিন্তু কী সেটা?
--“এখানে আসতে বললে কেন? এত রাতে ফ্লাইওভারের মাঝখানে– এখানে সারাক্ষণ পুলিশের গাড়ি টহল দেয়। এক্ষুনি একটা ঝামেলা করবে। এখানে থেকে নেমে যাই।" পুরুষটি গাড়ির লুকিং গ্লাসে তাকাল, “পিছনে কি একটা আসছে...”
--“একটু দাড়াও। গভীর রাতে এত উঁচু থেকে শহরটা দেখার খুব ইচ্ছে হয়। অর্ধঘুমন্ত শহর … এই কুয়াশা… একা অন্ধকার… তার মাঝে এত রকম আলো – দ্যাখো নির্বাণ, এত গভীর রাতে আলোগুলো কী জীবন্ত!”
--“পিছনে একটা গাড়ির আলো উঠে আসছে ওপরে। ওটা ঠিক পুলিশের গাড়ি।"
--“পালিয়ে কোথায় যাব নির্বাণ? আজই তো শেষ দেখা। এরপর আর তুমি আসবে আমার কাছে?”
--“খুব টাফ! বাবার এই বয়েসে স্ট্রোক – কেলেঙ্কারি কাণ্ড হল! মা তো কথাই বলছে না আর।"
--“তুমি এখানে নামিয়ে দিতে পারো না আমাকে? আমি একটু দাঁড়াতাম এখানে। এত উঁচু থেকে এত রাতে শহরটা দেখার কতদিনের ইচ্ছে আমার!”
--“পাগলামি করো না। পুলিশ ভাববে তুমি সুইসাইড করতে এসেছ – তুলে নিয়ে যাবে গাড়িতে –”
--“নিজের ইচ্ছেমতো কিছুই করতে পারব না, না? মানুষ বলে?”
মানুষও নিজের ইচ্ছেয় কিছু করতে পারেনা? মানুষ তো কত কিছু পারে! নিজেকে যেখান থেকে যখন খুশি সরিয়ে নিতে পারে। দেখে মনে হয়, কতকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে ওদের। আর, আমি পুনর্বসু আলো। পুনর্বসু নাম, আলো পদবি। ফ্লাইওভারের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় রাস্তার একদিকে লোহার লম্বা স্ট্যান্ডে ধাতুর শরীরে আটকে আছি দিনরাত। আপনাদের, মানুষের আলো পদবি হয় কিনা জানি না। তবে আমাদের হয়। আলোদের পদবি আলোই হয়। আমাদের মধ্যে কারও কারও আলাদা নাম থাকে না। তখন তারা শুধু ‘আলো’ হয়। নাম আর পদবি একটাই। ঝামেলা কম। আবার আমার মতো কারও কারও একটা বাহারি নাম থাকে। ‘আলো’ তাদের পদবি হয়ে যায়। যেমন আমি। পুনর্বসু আলো। এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে খুব বড় একটা বাজারের মোড়ে একটা দোকানে আমার জন্ম। ওখানেই নামকরণ। আমার মতো অনেকের জন্ম ওখানে।
নীল গাড়িটার পাশ দিয়ে একটা সাধারণ সাদা গাড়ি বেরিয়ে গেল। নীল গাড়ির দরজা খুলে নেমে মহিলাটি এগিয়ে গেল অশ্বিনীর দিকে। আমার বাঁদিকে চারটে আলো পরে যে আছে ও অশ্বিনী। অশ্বিনী আলো। আমরা প্রায় সমবয়সী। কয়েকদিন আগে শহর জুড়ে বৃষ্টি শুরু হয়। এক রাতে প্রবল ঝড়ে অশ্বিনীর স্ট্যান্ডটা হেলে যায়। তারপর কী যেন কারণে আজকাল খুব ভালো চোখে দ্যাখেনা অশ্বিনী। প্রতিদিন ওর জ্যোতি কমতে থাকে। এখন তো আমরা জ্বলতে শুরু করার অনেক পরে মাঝে মাঝে অল্প জ্বলে ওঠে অশ্বিনী। কিছু মানুষ সার্ভে করতে এসেছিল গতকাল। বলাবলি করছিল, অশ্বিনীকে ফেলে নতুন আলো লাগাবে। আজ আবার একটু আগে অশ্বিনীর মাথার কাছ থেকে একটা মোটা তার ছিঁড়ে পায়ের কাছে রাস্তার উপর পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে মোটা তারের ভিতর থেকে অসংখ্য ছোট ছোট তার দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে।
অশ্বিনী চলে গেলে আমার মন খারাপ হবে? কে জানে! তবে ও অনেকটা বোঝে আমাকে। ওই তো হারিয়ে যাওয়া কৃত্তিকার খোঁজ দিয়েছিল আমাকে।অশ্বিনীর পাশে আলো একটু কম দেখে মহিলাটি দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে বিস্তৃত শহর বেশ খানিকটা নীচে। এখান থেকে শহরের মেঝে ছড়ানো, অগোছালো আলোময়। মাঝে মাঝে আকাশচুম্বী টাওয়ারে থরে থরে সাজানো আলো। গলা উঁচু করে উপরের দিকে তাকাল মেয়েটা। উপরদিকে আলোর স্তর আবছা হতে হতে ঘোর তৈরি হয়েছে আকাশে। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে মহিলাটি তাকিয়ে থাকল অন্ধকার আর আলোর দিকে।
আমার ইচ্ছে হল একবার ওই মহিলাকে বলি, পদবির সমস্যা না হলেও একসঙ্গে থাকা যায়না। এই যে আমি, পুনর্বসু আলো সেদিন সন্ধেবেলা হঠাৎ করে জ্বলে উঠে চমকে গেলাম। আমি চেনা স্টোররুমের মধ্যে নেই। বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গা। হু হু হাওয়া বইছে। আমার মতোই অসংখ্য আলো জ্বলে আছে চারপাশে। না চারপাশে নয়। আমি তো পিছনে তাকাতে পারিনা। শুধু সামনে আর অল্প কিছুটা পাশে। সামনে উঁচু উঁচু অট্টালিকার মতো বাড়ি। বাড়িদের মাথায় নীল সাদা চাঁদোয়ার মত ছাউনি। ওর নাম আকাশ। পাশে একটু দূরে যে দাঁড়িয়ে আছে সে অচেনা। কিন্তু তার পর অশ্বিনী দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে বুঝেছিলাম, আমিও আটকে আছি লোহার ধাতব স্ট্যান্ডে। নীচে দুটো চওড়া রাস্তা। আলাদা করা আছে অল্প উঁচু একটা লাইন দিয়ে। দু'দিকের রাস্তায় গাড়ির গতি দুটো আলাদা মুখে। অশ্বিনী আমাকে বলল, রাস্তা পেরিয়ে খানিকটা দূরে যে প্রাসাদের মতো বাড়ি, ওটা একটা বড় হোটেল। ওখানে সবকিছু অন্যরকম সাজানো। ওখানে আলো দেখায়, কিন্তু আলোর চেহারা লুকিয়ে রাখে মোটা মোটা গম্বুজের মত থামের আড়ালে। বাইরে থেকে, দূর থেকে মনে হয় আলোর কোনও আলাদা চেহারা, অস্তিত্ব নেই। যেন দেওয়ালগুলো নিজেরাই আলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। অশ্বিনী বলেছিল, “আমরাই ভালো আছি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি। মানুষকে আলো দেখাই। কিন্তু সবাই তো দেখতে পায় আমরা কারা– কী বলিস? যত বড় জায়গায় যাবি দেখবি তোর কাজটা নেবে, অথচ তোকে চিনবেও না, সামনেও আনবে না।"
অশ্বিনীর অনেক অভিজ্ঞতা। ও নাকি আগে বড় রাস্তার মোড়ে পার্টি অফিসের সামনে থাকত। তারপর অফিস উঠে গেলে ওর সঙ্গে আরও কয়েকজনকে দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়। সে যাই হোক, অশ্বিনী বলেছিল, ওই হোটেলের তেতাল্লিশ তলায় ডানদিকে কাচের বড় জানলার পাশে থামের আড়ালে নাকি কৃত্তিকা থাকে এখন। আমি চমকে উঠেছিলাম। আমি দেখেছি, এই ফাঁকা জায়গায় আমি চমকে উঠলে আমার খুব কাছের হাওয়ায় ছোট ছোট ঢেউ আসে। খানিকক্ষণ আমার আলো কাঁপে। তারপর ঢেউ মিলিয়ে যায়। আলোও স্থির।
অশ্বিনী বলেছিল স্টোররুমে ওর পাশেই থাকতো রোহিণী। রোহিণীর আলোর রঙ লাল। রোহিণী একদিন হঠাৎ জ্বলে উঠে দ্যাখে সামনে একটা বড় দেওয়ালের মতো থাম। দু'পাশে এদিক ওদিক দেখা যায় অনেকদূর পর্যন্ত। দু'পাশে যতদূর চোখ যায় অনন্ত অন্ধকার আর মাঝে মাঝে অসংখ্য আলো। পাশের ডানদিকের থামের আড়ালে হলুদ আলোয় জ্বলজ্বল করছে কৃত্তিকা। রোহিণী বোঝে কৃত্তিকা ওকে কিছু বলতে চায়। সন্ধ্যের পর রাত যত বাড়তে থাকে হাওয়ায় অন্ধকার জমতে থাকে। কৃত্তিকার কথা রোহিণীর কাছে পৌঁছনোর আগেই হাওয়ার ফাঁকে অন্ধকারে আটকে যায়। সেই রোহিণী একদিন চোখ খুলে দেখল আবার দোকানের সেই চেনা মেঝে। পাশে অশ্বিনীই ওকে তখন বলেছিল রোহিণীর কিছু যান্ত্রিক সমস্যার জন্য ওকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু রোহিণী আবার কৃত্তিকার পাশে ফেরত এসেছিল কিনা সেটা অশ্বিনী জানেনা। কারণ তার আগেই ওকে এই ফ্লাইওভারের উপরে আনা হয়েছে। সেই অশ্বিনীও আর কতদিন এখানে থাকবে কে জানে!
আঃ! ঠান্ডা হাওয়ার এই ঝলকই গভীর রাতের এক আশ্চর্য পাওনা। কাছে দূরে এত রঙের এত সব আলো। এক আলোর শরীর উপচে পড়ছে অন্য আলোর শরীরবৃত্তে। এত আলোর উপচানো শরীর ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে, হাওয়ায়। যেন কত মিলেমিশে থাকা! অথচ, সবাই কত একা! এই যে আমি তাকিয়ে আছি ওই হোটেলের তেতাল্লিশ তলার ডানদিকে কাচের জানলার নীচে থামের আড়ালে কৃত্তিকার আলোর দিকে। ও তো জানবে না কোনওদিন! ওর প্রশ্নটা ওর কাছেই রয়ে যাবে? কুয়াশা বাড়ছে আমার চোখের চারপাশে। আমার আলোই আমার সামনে আবছা হয়ে আসছে। আচ্ছা, তেতাল্লিশ তলার ওই থামের আড়ালে এখনও কৃত্তিকাই আছে তো? এরকম নয় তো, আমার ঘুমের মাঝে কোন সময় কৃত্তিকা ফুরিয়ে গেছে আর ওরা অন্য কোনও আলো এনে রেখেছে কৃত্তিকার জায়গায়?
--“শ্রেয়া, গাড়িতে উঠে এসে বসো। এখানে এতক্ষণ থাকা যায় না।" গাড়ির কাচ নামিয়ে পুরুষকণ্ঠ বেশ জোরালো।
--“পদবির সমস্যা না হলে আমাদের একসঙ্গে থাকা হত, বলো?” অশ্বিনীর পাশ থেকে বেশ উঁচু গলায় বলে উঠল মহিলা। তারপর গুনগুন সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ধীরে ধীরে গাড়ির কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। “আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায় …”। দোকানে এ গান মাঝেমধ্যে শুনেছি। কিন্তু কাউকে সামনে থেকে গান গাইতে শুনিনি কোনওদিন। এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে মানুষকে নিজের কথা বলতেও তো শুনিনি কোনওদিন। ভাগ্যিস শুনলাম! নাহলে তো জানতাম না মানুষও কত কিছু পারেনা!
একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপট লাগল চোখে। একটা জোর আওয়াজ হল হঠাৎ আর মহিলাটি রাস্তার উপর পড়ে গিয়ে ভয়ঙ্কর কাঁপতে লাগল। পুরুষটি মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে মহিলাটিকে দেখে ‘হেল্প হেল্প’ চিৎকার করতে করতে গাড়ির পিছনের দিক খুলে একটা কাঠের লাঠির মতো বের করল। তারপর লাঠি দিয়ে মহিলাটির পায়ের নীচ থেকে কী যেন একটা বের করে সরিয়ে দিল। অশ্বিনীর সেই ছিঁড়ে যাওয়া তারের একদিকটা, না?
পুরুষটির চিৎকার শুনে দুটো পুলিশের গাড়ি বিচ্ছিরি হর্ন দিতে দিতে এল। মহিলাকে উঠিয়ে একটা গাড়িতে তুলে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে পুরুষটিকে ধরে আরেকটা গাড়ির মধ্যে তুলে পরের গাড়িটাও বেরিয়ে গেল। একজন উর্দিপরা পুলিশ নীল গাড়িটায় উঠে গাড়ীর দরজা বন্ধ করল। চেনা আওয়াজে মসৃণভাবে নীল গাড়িটা এগিয়ে গেল ফ্লাইওভারের রাস্তায়।
মাত্র এই কিছুক্ষণই এত শোরগোল! কিছুক্ষণই কিছু মানুষ! আবার সেই চেনা আলো, আলোর এপাশ ওপাশ জমাট অন্ধকার। আবার মাঝরাতের সেই অদ্ভুত মৃদু ঘূর্ণি হাওয়া আর শিরশিরে ধুলো…
রাত শেষ হতে এখনও কিছুটা বাকি। আমি বাঁদিকে তাকালাম। দপ করে একবার জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল অশ্বিনী।