মায়াজাল : সোমক রায়চৌধুরী

Bengali Short Story: একটা প্রমাণ সাইজের সিডনির ছবি সে তার ছোট্ট ঘরের দেওয়ালে সেঁটে রেখেছে। মাঝে মাঝে বিভোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে… সিডনি তার স্বপ্নের মেয়ে!

ওয়ান-টু-থ্রি… ট্রেনিং শেষের মুখে স্টেপিং-চেক করছিল রিমঝিম। শান্তদার মতে এটা কুল-ডাউন এক্সারসাইজ। হাতের স্টপওয়াচটা দেখতে দেখতে শান্তদা সরে গেল রুদ্রপলাশ গাছটার পাশে। গাছের নীচে একটা ম্যাট পাতা রয়েছে। “উঠে আয়”- রিমঝিম জানত শান্তদা এবার তাকে ডাকবে। “আজ টাইম একই আছে; অ্যাভারেজ। এখন এটাই থাক। অ্যাক্সিলারেশন পয়েন্টগুলো ঠিক করতে হবে, সময় এলে বলব”, শান্তদা একটা তোয়ালে ছুঁড়ে দেয় তার দিকে।

রিমঝিমের মুখ-হাত-গলা হয়ে পেটেও ঘাম চুঁইয়ে পড়ছে।

“থাই-এর টানটা কেমন আছে, আজ ভুগিয়েছে?”

“নাঃ, একদমই না।” সে প্রায় উড়িয়ে দেয়।

“হুম”, দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্তদা। “মাসাজটা কাজে দিচ্ছে তাহলে; আজ আরও কিছুক্ষণ করে দেব।”

“শান্তদা, আমি তো বিকেলেই একবার জিমে যাব ফিজিওর কাছে...” রিমঝিমের কথা শেষ হয় না! “থাম, জিম আর ফিজিও যদি চ্যাম্পিয়ন তৈরি করতে পারত, তাহলে ন্যাশনাল কোচদের দরকারই হতো না।” শান্তদা তোয়ালে তার হাত থেকে নিয়ে নেয়, তারপর তা আলতো করে বোলাতে থাকে রিমঝিমের শরীরের ঘামে ভেজা অনাবৃত অংশগুলোয়। তার ছোট করে ট্রিম করা চুলের উপর।

দশটা বেজে পনেরো মিনিট। মাঠ এখন প্রায় ফাঁকা; অফিস, কলেজ-ইস্কুলের ঠেলায় প্রায় সবাই পালিয়েছে। সূর্যের তেজ বাড়ছে মাঘ মাসের পড়ন্ত শীতে। দূরে কোথাও দু'একজন নিরাপত্তা রক্ষীকে পাওয়া যাবে শুধু। এটাই লোকটার সমস্যা, রিমঝিম জানে। বড্ড বেশি ফিজিকাল। বছর দুয়েক তার শরীরের উপর শান্তদার পজেসিভনেস দেখে সে নিজেও হতবাক হয়েছে। গত আট-দশ মাস আর বিষয়টা নিয়ে রাখঢাকও করেন না বছর বিয়াল্লিশের জাতীয় কোচ শান্তসবুজ বিশ্বাস। মাথার ঘাম মুছে, তার ঘন চুলে বিলি কাটতে শুরু করল শান্ত দা। “তোকে তৈরি করার মজাই আলাদা রে! আমি ছাড়া আর কেউ তা বুঝবে না,” বলে তার কপাল থেকে নাক, ঠোঁট হয়ে চিবুক অবধি আঙুল বোলাতে থাকে লোকটা। “নে শুয়ে পড়, গেট রেডি ফর দ্য মাসাজ।” রিমঝিমের গলায় আর গালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলে শান্ত। রিমঝিম জানে, এখন কিছুক্ষণ সাবমিট করতে হবে। প্রায়দিনই যেমন করতে হয়। মনে মনে সে বলে ওঠে, “এটা কি তোমার ওয়ার্ম-আপ না কুল-ডাউন এক্সারসাইজ?” কিন্তু সামলে নিয়ে নির্লিপ্ত থাকে। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে এই কোচকে তার প্রয়োজন। তার এই স্বাভাবিক নির্লিপ্ততা শান্তদা আজও ধরতে পারে না। লোকটা শারীরবিজ্ঞান নিয়ে যতটা লেকচার ঝাড়ে, ততটা ঠিক বোঝে না। অ্যাথলিটদের মনঃস্তত্ত্ব বিষয়টাও না, রিমঝিমের মন তো না-ই!

রিমঝিম শরীরটা ম্যাটের উপর এলিয়ে দেয়। তার কাফ মাসল আর গোড়ালিতে মাসাজ প্রয়োজন, অথচ এখন তার উরু, পেট ও হাঁটুতে যে মাসাজ শান্তদা করবে, তার বড়জোর পঁচিশ শতাংশ রিমঝিমের জন্য, বাকি পঁচাত্তর শতাংশ নিজের প্রবৃত্তির বশে। শান্তদা তার থাই নিয়ে পড়েছে, তারপর তার পেটের উপর ঝুঁকবে। অথচ তার পেটে কোনও টান লাগেনি, পিঠেও না! এসব বলে কোনও লাভ নেই, রিমঝিম জানে। তারপর তাকে উপুড় হয় শুতে বলে যা করবে তা কোনও…

এভাবেই চলছে গত একমাস। রিমঝিম মুখ বুঁজে থাকে, ঘাঁটায় না কোচকে। জাতীয় মিটের পরই রয়েছে জাতীয় ক্যাম্প, তারপর এশিয়াড… ঠাসা ক্রীড়াসূচির মধ্যে সে কোনও বিতর্ক চায় না যাতে তার ফোকাস নড়ে যায়। সামনের মাসে ত্রিবান্দ্রমে ন্যাশনাল মিটে অন্তত দুটো সোনা সে জিততে বদ্ধপরিকর। তারপর এশিয়ান গেমসের লক্ষ্যে দৌড়।

“অফিস যাবি?” কোমর ও পিঠে হাত চালাতে চালতে জিজ্ঞেস করে শান্তদা। “হ্যাঁ, একবার যেতে তো হবেই,” উপুড় হয়ে শুয়েই উত্তর দেয় রিমঝিম।

“হুম, লাঞ্চের পরই বেরিয়ে আসবি কিন্তু! ওই হারামির হাতবাক্সটা এসে যদি এদিক-ওদিক যেতে বলে, স্রেফ বলে দিবি টায়ার্ড।” 'হারামির হাতবাক্স' বলে শান্তদা যাকে সম্বোধন করল, তিনি রাজ্য অ্যাথেলেটিক্স সংস্থার সচিব নিখিল সেন। সে মনে মনে ভাবে, এই ময়দানে কে যে কী তা নিয়ে ভাবার এখন সময় নেই তার! সবারই কিছু না কিছু উদ্দেশ্য আছে, তেমন তার আছে নিজের লক্ষ্য! তাই রিমঝিম চুপ করে থাকে, বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করে না তার।

তবে নিখিল সেনকে নিয়ে তারও কম সংশয় নেই। লোকটা তার কেরিয়ারকে বিপাকে ফেলে দিয়েছিল গত বছর রাজ্য মিটের সময়। প্রথম দিন হিটে নামার পরই রিমঝিম ফোন পায় রাজ্য সংস্থার এক উদ্যোক্তার কাছ থেকে। “তোর সেক্স নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কাল তোর জেন্ডার টেস্ট হবে। রিপোর্ট ক্লিয়ার হলে তবেই আবার ট্র্যাকে নামতে পারবি তুই!” অপর প্রান্ত ফোন কেটে দেয় এই বার্তা দিয়েই।

রিমঝিমের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। সে ছুটে যায় রাজ্য দপ্তরে সচিবের ঘরে।

“কী ব্যাপার নিখিল দা। একটা ফোন পেলাম সংস্থা থেকে। কীসব টেস্ট-ফেস্ট হবে বলছে!” নিখিল সেন ফোনে কার সঙ্গে আলোচনা করছিলেন, ফাইনালের চিফ গেস্ট কে হবেন তা নিয়ে। তাকে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে, চশমার কাঁচের মধ্যে দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখে নেন। তারপর আবার ফোনের আলোচনায় মন দেন। রিমঝিম তার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে পড়ে।

প্রায় মিনিট চারেক পর ফোন রেখে, টেবিলের উপর রাখা কাঁচের গ্লাসের ঢাকনা তুলে জল খান নিখিল সেন। তারপর তার দিকে তাকান, “ইয়েস রিমঝিম, বল কী বলছিলিস?”

“একটা ফোন পেলাম। কীসব টেস্ট দিতে হবে নাকি কাল!”

“হ্যাঁ, দিতে হবে বৈকি।” নিজের কথার তালে তালে মাথা ঝাঁকান নিখিল। “দেখ তোকে নিয়ে, অন্য মেয়েদের সঙ্গে তোর ট্যুরে ব্যবহার নিয়ে, ইতিমধ্যেই অনেক প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। রিপোর্টও জমা পড়েছে। অন্য কোচরা, অ্যাথলিটরা সন্দিহান… আর ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, সংস্থার একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে। উই ওয়ান্ট ক্ল্যারিফিকেশন। টেস্টে তুই উত্তীর্ণ হলে তো মিটেই গেল।” তারপর একটু হেসে বলেন, "আর তোর জন্যও এটা সব দিক দিয়ে ভাল। পরিষ্কার হয়ে যাবে সব,” বলে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসেছিলেন নিখিল সেন।

আরও পড়ুন- লুকিয়ে থাকা রুটম্যাপ: সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

রিমঝিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার পরীক্ষা তখন থেকেই শুরু হয়ে যায়। রাজ্য সংস্থার অফিস থেকে বেরিয়ে, স্কুটিতে স্টার্ট দেওয়ার আগেই সে ফোন করে শান্তদাকে। “শুনেছি। টেস্টটা তোকে দিতে হবে। তুই যে ক্লিয়ার করবি সে বিষয় আমি নিশ্চিত। রিপোর্টে যাতে কোনও গণ্ডগোল না করতে পারে, সেটা আমি দেখছি।” একটু থেমে শান্ত যোগ করে, “এখন মাথা ঠান্ডা রাখ, মানসিক প্রস্তুতি নে। পারলে আমার ফ্ল্যাটে চলে আয়।”

রিমঝিম রুদ্ধশ্বাসে শান্তদার ফ্ল্যাটে ছুটে যায়। ওই সময় তার মানসিকভাবে প্রয়োজন ছিল কোচকে। তার সমস্ত বিশ্বাস তখন টলে গিয়েছে। তার মা ছাড়া একমাত্র শান্তদা জানে যে সে নারী। আরেকজন জানত বলে সে মনে করে, কিন্তু সেই ব্যক্তিই অম্লান বদনে তাকে আজ জেন্ডার টেস্টের দিকে ঠেলে দিল!

শান্তর বাড়ি পৌঁছে, বাইরের ঘরের সোফায় বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে রিমঝিম। এতক্ষণ বুকে জমে থাকা বাষ্প বিস্ফারিত হয়ে বেরিয়ে আসে। শান্ত দু কাপ কফি নিয়ে ঘরে ঢোকে। রিমঝিমের হাতে একটা কাপ দিয়ে, নিজেরটায় চুমুক দিয়ে বলে “ঠান্ডা মাথায় শোন। টেনশনের কিছু নেই রে বোকা এখন আর। এখন হরমোন টেস্ট হয়, তাতে সমস্যার কিছুই নেই। কফিটা খা আসতে আসতে।” রিমিঝিমের কাঁধে একটা হাত রাখে শান্ত। সেই অসময়ে কোচের ওই আশ্বাসের হাত তার কাছে বিরাট ভরসা ছিল, নিঃসন্দেহে।

“হরমোন টেস্টে চিন্তার কিছু নেই; তোর টেস্টোস্টেরন লেভেল একটা ক্রিটিকাল পয়েন্টের নীচে থাকলেই তুই উত্তীর্ণ। কোনও মেয়ের তার বেশি হতে পারে না। তোর ক্ষেত্রে সেটা না হওয়াটা নিশ্চিত। আর একবার রিপোর্ট নেগেটিভ হলে, এ নিয়ে আর তোকে ভাবতে হবে না,” এতটা বলে থেমেছিল শান্তদা; বাইফোকাল লেন্সের চশমার আড়ালে তার চোখদুটো সামান্য চিন্তিত দেখিয়েছিল। “নে, কফিটা খেয়ে, চোখদুটো মুছে ফেল এবার।”

রিমঝিম কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। না বলে পারে না, “কিন্তু নিখিলদা তো জানে শান্তদা, স-অ-ব; তাও….”; নিখিলের নাম শুনতেই শান্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠে। “ও এক নম্বরের ঘোড়েল মাল; বছর বছর সচিবের চেয়ার ধরে রেখেছে। সবাইকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। আমার তোকে আগেই অ্যালার্ট করে দেওয়া উচিত ছিল।” রিমঝিমের চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিখিল সেনের মানিকতলার বাড়ির একতলার একটা ঘর। যেখানে নিখিল তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল যেদিন রেলে তার চাকরিটা পার্মানেন্ট হয়। তার একুশতম জন্মদিনের কয়েকদিন পর। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থায় স্থায়ী পদ পাওয়াটা তার কাছে ছিল বিরাট প্রাপ্তি। এতদিনে তার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে কিছুটা। নিকিলদা তাকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে একটা ট্র্যাকস্যুট আর একটা স্প্রিন্ট কস্টিউম উপহার দেন। “পাশের ঘরে গিয়ে দেখ কস্টিউমটার ফিটিংস ঠিক আছে কিনা। নাহলে আবার….”

“বাড়ি গিয়ে দেখব নয়,” রিমঝিম তৎক্ষণাৎ বলে উঠেছিল।

“আরে যা।” ডানহাত পাশের ঘরের দিকে বাড়িয়ে নির্দেশের সুরে বলে নিখিলদা। অগত্যা রিমঝিমকে পাশের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই হয়। আধা-অন্ধকার মাঝারি ঘর, রিমঝিম ঢুকে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। মিনিট তিনেক পর, সবে পোশাক খুলে সে কস্টিউমটা চাপিয়েছে গায়ে, তার পেছনের দিকের একটা ছোট দরজা খুলে যায়। ঘরের মধ্যে ঢুকে আসে নিখিল সেন এবং আচমকা রিমঝিমকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, তার কাঁধ, গলা ও পিঠের উপরের অংশে মুখ ঘষতে থাকেন। রিমিঝিমের কাছে এ স্বপ্নাতীত। “এ তো কিছুই না রে। তোকে আমি টপ-টায়ারে নিয়ে যেতে পারি; শুধু আমার কথা শুনে যা।” রিমঝিম প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, “এটা কী করছেন নিখিল দা, বৌদি আছে বাড়িতে!”

“আরে ধ্যার! ও সাতসকালে শালির মেয়ের বিয়েতে চলে গেছে,” বলে আরও জোরে তাকে চেপে ধরেন। কাতর স্বরে “ছাড়ুন আমায়” বলে রিমঝিম শরীরের ঝটকায় নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে।

“আরে, রিল্যাক্স ডার্লিং!” লোকটার একদিনের না কামানো দাড়ি রিমিঝিমের গালে সুঁচের মতো বিঁধছে। তার হাতদুটো রিমঝিমের মেদহীন নিটোল পেট খামচে ধরতে চাইছে। “তোর প্রতি আমার বরাবরই বাড়তি টান! কেন বল তো? রিমঝিম, তুই একটা মায়ার মতো…..” বলে তার গলার নীচের অংশে একটা গাঢ় চুম্বন করে নিখিল। রিমঝিম এবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে কিছুটা মুক্ত করে। “ভাল লাগছে না নিখিল দা। পাশের ঘরে চলুন। আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।”

“রাগ করিস না সোনা; আমার দরজা তোর জন্য সব সময় খোলা। মাই ডোর ইজ অলওয়েজ ওপেন ফর ইউ,” বলে তার গাল টিপে সামান্য ঝাঁকিয়ে দেন নিখিল সেন। কোনওক্রমে সেদিন নিজেকে বাঁচিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল রিমঝিম। নিখিলদার আনানো চায়ের কাপ, কেকের ট্রে টেবিলেই পড়ে থাকে। ফিরতে ফিরতে তার মনে হয়েছিল, লোকটা এক বালতি দুধে চোনা ফেলে দিল! সুখের দিনটা প্রায় ভেস্তে যাচ্ছিল। এসব কথা সে আজও কাউকে বলেনি; না শান্তদাকে, না তার মা-কে।

 

লেকক্যাম্পের বাড়িতে ফিরেই সে মাকে বলেছিল, “এবার ওই টেলরিং দোকানের কাজটা ছেড়ে দিতে পারো, তোমার যদি না পোষায়। আর ভাইকে বলো একটা কম্পিউটারের দরদাম করতে। ও যদি চায়, সায়েন্সে ভর্তি হতে পারে; আমার কোনও সমস্যা নেই।” সংসারের একটা ভরকেন্দ্র পেয়ে সে এতটাই হালকা বোধ করেছিল যে, অন্য কোনও বিষয়কে আমল দিতে চায়নি।

“একসময় অ্যাথলিটদের ন্যুডওয়াক করতে হতো ডাক্তারদের সামনে, নারীত্ব প্রমাণ করতে। এ যুগে এসব ঝামেলা নেই, এখন টেস্ট অনেক উন্নত, তাই…”; রিমঝিম যেন নিজের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল, ঘোর কেটেছিল শান্তদার কথায়। কিছুটা আত্মবিশ্বাসও পায়। এই আত্মবিশ্বাস জোগানোর কাজটা শান্ত তাকে বহু কঠিন সময়েই করে গিয়েছে।

রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার পর রিমঝিম সেবার দুটো সোনা আর একটা রুপো জিতেছিল। ৮০০ মিটার আর ৪x৪০০ মিটারে সোনা, আর ৪০০ মিটার হার্ডলে রুপো। নিখিলদা ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছিল, রিমঝিম যায়নি। “রিল্যাক্স, মাই গার্ল,” পিঠে হাত রেখে বলেছিল শান্ত দা। “এই টেস্টিং বিতর্কটা না হলে ৪০০ মিটার হার্ডলের সোনাটা তোর বাধা ছিল।” রিণিতা আর শাল্মলী আড়চোখে তার দিকে তাকিয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। রিলে টিমে রিণিতা তার সঙ্গে ছিল, তার হাত থেকেই ব্যাটন নিয়ে দৌড় শুরু করে রিমঝিম। পুণেতে তার আগের বছরের জাতীয় মিটের সময় এই দু'জনই রিমঝিমের নামে বারবার অভিযোগ করতে থাকে ট্যুর ম্যানেজার গৌর সেনগুপ্তের কাছে। “রিমঝিমের সঙ্গে রুম শেয়ার করা যায় না; ও সারারাত উত্যক্ত করে, ঘুমোতে দেয় না” ইত্যাদি। রিমঝিম ৮০০ মিটারে সোনা সহ আরও দু'টি পদক জেতে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন নির্বিরোধী গৌর এই নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য না করলেও ফিরে তার রিপোর্টে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেন। ওইখানেই রিমঝিম বিতর্কের সূত্রপাত।

শান্তদা বিষয়টা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল। “এসবে কান দেওয়ার সময় কোথায়? ট্রেনিং আর পারফরমেন্সে ফোকাস কর; সামনে অনেক মিট।” এথিং মু বলে এক কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান মেয়ের ছবি তাকে দিয়েছিল শান্তদা। টোকিও অলিম্পিকে ৮০০ মিটারে সোনাজয়ী। “তোর থেকেও কয়েকমাস কম বয়স ওর। কিন্তু কী ছন্দ! টাইমিংটা লিখে রাখিস ছবির উপর, ১:৫৬:৩০ মিনিট!”

মু’র সময় রিমঝিমকে বিস্মিত করেছিল। কিন্তু তার আরও আকর্ষক লাগে ৪০০ মিটার হার্ডলে সোনাজয়ী ব্রিটেনের সিডনি ম্যাকলফলিনকে। বাদামী চামড়ার এই মেয়েটির শরীর যেন মায়াবী কারুকার্যে নির্মিত; সে দৌড় শুরু করলে শত তরঙ্গ খেলে যায়। একটা প্রমাণ সাইজের সিডনির ছবি সে তার ছোট্ট ঘরের দেওয়ালে সেঁটে রেখেছে। মাঝে মাঝে বিভোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে… সিডনি তার স্বপ্নের মেয়ে! ট্রেনিংয়ের পর এক কিলোমিটার পথ সে আলতো পায়ে হেঁটে ফেরে। এই মিনিট পনেরো সময় তার একান্ত নিজের। এই অলস হাঁটার মধ্যে সে নিজের মনটাকে ঝালিয়ে নেয়। ট্রেনিংয়ের অতিরিক্ত পরিশ্রম তার শরীরের আগুনকেও উসকে দেয়।

বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছেই তার মনটা আনচান করে। তাদের কলোনির দ্বিতীয় ঘরটার কাছে এসে সে উঁকি মারে। আধা অন্ধকার ঘর, আধ-ভেজানো দরজার পাল্লার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়। কোথায় গেল সে? ইস্কুল কি খুলে গেছে? সে আসতে আসতে এগোতে থাকে। একটু দূরেই ফুটপাথের উপর একটা বটগাছ, গুঁড়িটা বাঁধানো। দু’জন বয়স্ক ব্যক্তি সেখানে বসে কাগজ পড়ছিল। কাঁধে কিটব্যাগ সহ রিমঝিমকে দেখে তারা চোখ তুলে তাকায় একবার, তারপর আবার কাগজে মন দেয়। গাছের আড়াল থেকে হাসি হাসি মুখ করে বেরিয়ে আসে লালি। পরনে তারই দেওয়া একটা প্রিন্টেড স্কার্ট আর পুরনো একটা সাদা টি-শার্ট। “ওই বাড়ির বৌদি এই সময়টা একবার ডাকে গো; রান্না আর দোকানপাট করায় সাহায্য করার জন্য!”

আরও পড়ুন- চক্রব্যূহ : সোমক রায়চৌধুরী

রিমিঝিম কোনও কথা না বলে হাঁটতে থাকে। তাঁতের মাকুর মতো বছর পনেরোর লালিও তাকে অনুসরণ করে। “তোকে একটা মোবাইল ফোন দেব। চার্জ করে সব সময় পকেটে রেখে দিবি।” লালি চুপ করে থাকে।

“ইস্কুল কবে খুলছে?”

“সোমবার”, বলে লালী। রিমঝিম তাদের ঘরের সামনে এসে পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খোলে। ভাই ইস্কুলে চলে গিয়েছে, মা-ও রান্নাবান্না করে কাজে বেরিয়ে গিয়েছে। তার সেদিন আর অফিস যেতে ইচ্ছে করে না। অফিস এখন ঢালাও ছাড় দিচ্ছে অ্যাথলিটদের, সামনে অনেক টুর্নামেন্ট বলে। এসব কথা সে শান্তদাকে বলেনি। শান্তদা, নিখিল সেনদের সঙ্গে মাঠের সম্পর্ক সে মাঠেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।

রিমঝিম ঘরে ঢুকেই চায়ের জল বসায়। তারপর একে একে ট্র্যাকস্যুটের আপার ও লোয়ারটি খুলে ফেলে। এবার লালির দিকে তাকায়। “হাঁ করে দেখছিস কী? জলটা গরম হলে, চা-টা কর। আর ওই টি-শার্টটা খোল। নাহলে আয়, আমি খুলে দিচ্ছি।” লালি একটু কুঁকড়ে থাকে। “চা-টা নিয়ে ঘরে আয়,” বলে রিমঝিম তার সাত-বাই-পাঁচ ফুট ঘরে ঢুকে যায়। লালি চা ছাঁকতে যায় গ্যাসের কাছে। তারপর চা নিয়ে আস্তে আস্তে ঘরে ঢোকে। ছোট টেবিলের উপর চায়ের কাপ দুটো নামিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করে। তারপর পিঠে জুনিয়র ন্যাশনাল লেখা সাদা গেঞ্জিটা খুলে ফেলে; দরজাটা ভেজিয়ে আগল তুলে দেয়।

“জানো, ওই বাড়ির বৌদি জিজ্ঞেস করছিল, ওই ছেলে-ছেলে দেখতে মেয়েটা, যে দৌড়য়-টৌড়য়, তোর কে হয় রে?”

চায়ে চুমুক দিয়ে, লালির শরীরের ওম নিতে নিতে রিমঝিম বলে, “তাতে ওর শ্বশুরের কী? তুই কী বললি?”

“বললুম, আমার দিদি। আমাকে খুব ভালবাসে।”

“লক্ষ্মী-সোনা আমার। আজ তোকে চান করিয়ে দেব?”

“না গো দিদি। ঠান্ডা লেগেছে।”

“তোর ন্যাকামি বড্ড বাড়ছে দিনদিন,” রিমঝিম মৃদু ধমক দেয়।

“ও দিদি, তুমি এত ভাল। এমন কেন কর গো?” বলে ওঠে লালি।

রিমঝিম লালির গালে আলতো করে একটা চড় মারে। “তোকে না পেলে আমার চলে না জানিস না?” বলে লালিকে আদর করতে থাকে রিমঝিম। একটানে তার স্কার্টটা খুলে দেয়…লালিকে নিয়ে তার এই জগতটা বড়ই মায়াময়!

মিনিট পনেরো পর সম্বিত ফেরে রিমঝিমের। “হ্যাঁরে, তোর ওই বদ মামা, না কে লোকটা, আর কিছু জিজ্ঞেস করছিল?”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লালি উত্তর দেয় “না”।

“আমাকে যদি আর একটা এসএমএস পাঠায় তো… টিকটিকিগিরি ঘুচিয়ে দেব...”; রিমঝিমের কথা শেষ হয় না। দরজায় আলতো টোকা পড়ে। রিমঝিম উঠে একটা টি-শার্ট গলিয়ে নেয়। লালির দিকে আর একটা ছুঁড়ে দেয়। দরজায় এবার বেশ কয়েকবার ধাক্কা মারার শব্দ হয়। “এখন আবার কে জ্বালাতে এল?” বলে রিমঝিম লালির দিকে ফেরে, “তুই জামাটা ঠিক করে পর, আমি দেখছি।” কিঞ্চিৎ সন্দিগ্ধভাবেই আস্তে আস্তেই দরজা খোলে সে। আর হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে দু’জন পুরুষ, একজন মহিলা।

প্রথম পুরুষটি জিজ্ঞেস করে, “আপনি রিমঝিম দাস?”

“হ্যাঁ, বলুন...”

“লালবাজার থেকে আসছি। একটু থানায় যেতে হবে। আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে। সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট টু মাইনর।”

“মানে, আমি...” রিমঝিম বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

“বাকি কথা কোর্টে বলবেন। এখন থানায় চলুন। এই দেখ তো, ভেতরে মেয়েটা আছে কিনা!” পুরুষটির কথায় মহিলা কনস্টেবল রিমঝিমের ঘরের দিকে এগোয়। দু’জন পুরুষ প্রায় তাকে জাপটে ধরে বাইরে নিয়ে যায়। সরু গলিতে অপেক্ষারত একটা পুলিশ ভ্যান।

লালির মা ওই 'বদ' লোকটির সঙ্গে ছক কষছিল কয়েকদিন ধরেই। রিমঝিম শুধু অ্যাথলিটই নয়, সরকারি চাকুরে, কাগজে তার ছবি দেখা গেছে বার দু'য়েক; ব্ল্যাকমেল করে তার কাছ থেকে লাখ-খানেক যদি বের করা যায়! হাতে অস্ত্র তো ছিলই। তার মেয়ে কি মিনি-মাগনা না ফাউ? লালি এই ষড়যন্ত্রের সামান্যই টের পেয়েছিল। একদিকে রিমঝিম, অন্যদিকে তার মা, সে ভয় তটস্থ হয়ে থাকত।

“আপনি পুরুষ, নাকি মেয়ে, খোলসা করে বলবেন চলুন থানায়!” অফিসার গোছের লোকটি প্রায় তার স্তনের কাছে হাত দিয়ে প্রশ্ন করে। রিমঝিমের চারিদিক ঝাপসা হয়ে আসে। অস্ফুটে একবার বলে ওঠে 'লালি'! কর্তব্যরত দুই পুরুষ পুলিশের মুখে শ্লেষাত্মক হাসি। জিপ ছেড়ে দেয়, চলতে থাকে শহরের বড় রাস্তা ধরে।

রিমঝিমের কানে বারবার বাজতে থাকে প্রশ্নটা, “আপনি পুরুষ, নাকি মেয়ে...?”

More Articles