হারিয়ে গিয়েছে যে রীতি! কেমন ছিল সেকালের বাঙালি বিয়েবাড়ির পদ্য উপহার?

Bengali Wedding Rhymes: দু'টি চরিত্রের সংলাপের মধ্যে দিয়ে কোনও এক নবযুবকের চিরকৌমার্য ব্রতভঙ্গের কথা উঠে এসেছে। আবার কখনও দেখা যায় যে, পাত্র তার স্ত্রীর মন চুরি করার দোষে সাজা পেয়েছে।

বিবাহ আর উপহারের সম্পর্ক চিরকালই মধুর। গুরুজন, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী সবার থেকেই নবদম্পতি কিছু না কিছু উপহার পেয়েই থাকেন, তা সে ‘আশীর্বাদী’ হিসেবে হোক বা ‘যৌতুক’। কখনও বা তত্ত্বের ডালি থেকেও বিভিন্ন উপহার আসে দ্বিপাক্ষিকভাবেই। তবে উপহারের ধরন কিঞ্চিৎ বদলেছে। এখনও কিছু উপহার এক্কেবারে 'কমন'। তবে, নানা পোশাক, অলংকার, বই, গৃহসজ্জার সামগ্রীর সঙ্গে সেকালে আরও এক ধরনের উপহার প্রায় একপ্রকার বাধ্যতামূলক ছিল। বিবাহের ‘পদ্য’ বা ‘কাব্য’। সময়টা ১৯০০-১৯৮০ অবধি বিস্তৃত বলা যায়। তখন বাড়িতে যে কোনও বিবাহ উপলক্ষ্যেই পদ্য লেখার চল ছিল। চিঠি লেখার প্রবণতা থেকেই এই ছড়া বা কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা এসেছিল বলেই অনুমান করা যেতে পারে। অভিভাবকেরা আশীর্বাদের ভঙ্গিতে নবদম্পতিকে শুভেচ্ছা বার্তা দিতেন। আবার অন্যান্য আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবরা রঙ্গ-রসিকতা বা ব্যঙ্গের সুরে-ছন্দে পদ্য লিখতেন। সেসব পদ্য যে সবসময় সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিরাই লিখতেন এমনটি নয়। পরিবারের কোনও সদস্য বা কোনও প্রতিবেশীর ডাক পড়ত এরকম পদ্য লেখার জন্য। তারাই হয়তো মুখে-মুখে রচনা করে দিতেন বা লিখে দিতেন। সেইসব ছড়া, কবিতা মুদ্রিত হতো কোনও প্রচারপত্রিকায়। আবার কখনও বা একাধিক পদ্য হলে সেগুলি সংকলিত হয়ে একটি পুস্তিকায় প্রকাশিত হতো।

হলুদ, গোলাপি, হালকা সবুজ, সাদা বিভিন্ন রঙিন কাগজে এই পদ্যগুলি ছাপা হতো। তার শিরোনাম থাকত নানারকম; যেমন ‘প্রীতি উপহার’, ‘আনন্দ সংবাদ’, ‘ভক্তি উপহার’, ‘আশীর্ব্বাণী’, ‘মিলনগীতি’, ‘আনন্দোচ্ছ্বাস’ ইত্যাদি। এমনকী তার অলংকরণেও চতুরানন ব্রহ্মা, প্রজাপতি, বিদেশি পরী, বাঙালি গৃহবধূ, সানাইয়ের ছবি থাকত। সেই কাগজের চারদিকে আলপনাও দেওয়া থাকত। তখন ছিল কাঠখোদাই করা ব্লকের যুগ। তাই যে কোনও একটি নকশা দিয়েই আলপনাটি ভরাট করা থাকত। পুস্তিকার প্রচ্ছদের ক্ষেত্রেও ফুলের তোড়ার ছবি দেওয়া থাকত। বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে, 'শখের দাম লাখ টাকা'। তাই সৌখিন বাঙালি শুধু কাগজেই নয়; বাহারি নকশা কাটা নরম ন্যাপকিনের ওপরেও এই ধরনের পদ্য ছাপিয়েছে। এ ছিল বিলাসিতার এক অন্য চাবিকাঠি। চিঠি সাধারণত গোপন বিষয় হলেও এই শুভেচ্ছাবার্তার মধ্যে কোনও পর্দা ছিল না। মুদ্রিত এই বিয়ের পদ্য বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রিত অতিথি, বরযাত্রী, কনেযাত্রীদের বিতরণ করা হতো। বাসরঘরে সেসব পদ্য পাঠ, আবৃত্তি করাও হতো। এই ছিল তখনকার বিনোদন। আবার দু-একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তে দেখা যায় যে, উপহার হিসেবে সংক্ষিপ্ত কাব্যনাট্যও রচিত হয়েছে। দু'টি চরিত্রের সংলাপের মধ্যে দিয়ে কোনও এক নবযুবকের চিরকৌমার্য ব্রতভঙ্গের কথা উঠে এসেছে। আবার কখনও দেখা যায় যে, পাত্র তার স্ত্রীর মন চুরি করার দোষে সাজা পেয়েছে। তার শাস্তি হ’ল ‘সাত পাকে বাঁধা’। আবার কখনও বিজ্ঞাপন আকারেও বিবাহ সংবাদ দেওয়া হয়েছে। কেউ বা বাংলার বদলে ইংরেজিতেও এই পদ্য লিখেছেন।

আরও পড়ুন- নকল গয়না, মোটা চালের ভাত, ট্যালটেলে মুরগির ঝোলের বিয়েবাড়িই বেশি টানে

তবে সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে এই পদ্যের বিষয় এবং ভাষারও পরিবর্তন হয়েছিল। ১৯১০-২০ সালের মধ্যে বাংলা কাব্যে সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্য বা সাধু ভাষার প্রভাব ছিল বেশি। ১৯৫০-এর আশেপাশে দেখা যায় যে বাল্যবিবাহের প্রসঙ্গ এসেছে। পরে জনসচেতনতা ও নারীপ্রগতির সৌজন্যে তার সংখ্যা কমে যায়। এই সংস্কৃতি ছিল সারা বাংলারই। শুধুমাত্র কলকাতার ধনী পরিবারেই যে এটি সীমাবদ্ধ ছিল এমন নয়; বর্ধমান, নদিয়া, হাওড়া সহ বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চলেও এই সংস্কৃতি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। ১৯৭০-এর দশকের সময় থেকেই এই বিয়ের পদ্যে সামান্য হলেও ছেদ পড়তে থাকে। ১৯৮০-র দশকে তা ম্রিয়মান হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ১৯৯০-এর দশকে এর দেখা পাওয়াই বিরল হয়ে যায়। অথচ বাঙালির এই নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যেই ছিল সাহিত্য-অনুরাগের বাসনা। পরবর্তীতে ছড়া বা কবিতা লেখার নানা পত্র-পত্রিকা বা সামাজিক মাধ্যমের অজস্র মঞ্চ তৈরি হয়েছে। ফলে সাবলীলভাবে সৃজনশীলতা প্রকাশের অভাব অনেকখানি দূর হয়েছে। অথচ সেই সময় বাংলার মহিলাদের বা যে কোনও সাধারণ ব্যক্তিদের মধ্যেও যে সুপ্ত কবিপ্রতিভা ছিল তা সাধারণত এই ধরনের সামাজিক, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানেই প্রকাশ পেত। তবে এই ধরনের লিখিত উপহারগুলির যথোপযুক্ত সংরক্ষণ হয়নি। তার ফলে বহু বাংলা ছড়াই আজ বিলুপ্ত।

লোকসাহিত্যের অন্যতম উপাদান এই সমস্ত সহজ, সরল ও সুন্দর ছড়া মৌখিকভাবেই এক থেকে বহু জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিবাহের পদ্য উপহারের ছড়াগুলি সকলের কাছে না পৌঁছলেও অন্তত লিখিত আকারে প্রকাশিত হওয়ার জন্যই তা সংরক্ষণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। বাংলা সাহিত্যের এক অন্যদিক আলোকিত হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল। তবে সেই ‘প্রীতি উপহার’-এর রেশ কিন্তু আজও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। এখনও কারও জন্য উপহার দিলে তার ওপর একটি ছোট চিরকুটে ‘প্রীতি উপহার’ শব্দদু'টি লেখা হয়। তার সঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে নাম ও শুভেচ্ছা বার্তাও লেখা থাকে। একথা ভাবলে ভুল হবে যে, অজস্র উপহারের মধ্যে শুধুমাত্র নিজের নামটিকে চিহ্নিত করার জন্যই এই লেখার প্রচলন হয়েছে। এই লেখার মনোভাবের মধ্যেই বিয়ের পদ্য লেখার সুপ্ত রীতি আমাদের মনে রয়ে গেছে। বর্তমান প্রজন্ম সেই হারানো সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত না হলেও পরম্পরায় উপহারপত্রে নামোল্লেখের মাধ্যমেই সেই বিগত সংস্কৃতির ধারাকে আজও পালন করে চলেছে কিছুটা হলেও।

More Articles