লক্ষ লক্ষ ভক্ত, ভিডিও করে কোটিপতি! বাংলার ইউটিউবাররা যে নতুন পথ দেখাচ্ছেন
বিশাল অঙ্কের টাকার পরিমাণ দেখে নিশ্চিত বোঝা যায় যে এই পেশা হেলাফেলার নয়। বাংলাতেও বর্তমানে এমন বেশ কিছু ইউটিউবার রয়েছেন। আসুন আজ পশ্চিমবাংলার কয়েক জন বিখ্যাত ইউটিউবারদের চিনে নিই এক নজরে।
'ইউটিউবার' শব্দটি এই শতাব্দীর নতুন সংযোজন। উদারনীতিবাদের হাত ধরে আন্তর্জালের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গেই ইউটিউব এসেছিল ২০০৬ নাগাদ, সঙ্গে এসেছিল 'ইউটিউবার' শব্দটিও। কিন্তু বাংলার পটভূমিতে এই শব্দের বাড়বাড়ন্ত গত পাঁচ-ছয় বছরে। সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন পেশা। নানা ধরনের ভিডিও তৈরি করেও যে রোজগার করা যায়, তা গ্রহণ করতে বাংলার মানুষের সময় লেগেছে বেশ কয়েক বছর। ইউটিউবাররা নানাভাবে মানুষকে বিনোদনের জোগান দিতে পারে, শিক্ষাদান করতে পারে, তুলে ধরতে পারে নিজের আঁকাআঁকি, শিল্প— এককথায় সম্ভাবনা অনন্ত। শুধু তাই নয়, মানুষের কাছে এইসব ভিডিও পৌঁছে দিয়ে তাঁরা রোজগারও করতে পারেন। তাদের ভিডিও কতজন দেখছেন, কতজন তাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করছেন–এর ওপরেই টাকা রোজগার নির্ভর করে।
মূলত গুগল অ্যাডসেন্স থেকে টাকা পান ইউটিউবারেরা। এছাড়া জিনিসপত্র কেনার লিঙ্ক ইত্যাদি শেয়ার করার মাধ্যমেও টাকা পাওয়া যায়। কোনও বিশেষ সংস্থাকে পৃষ্ঠপোষক হিসাবে পেলেও রোজগার হয় ভালোই, একই সংস্থা সমস্ত ভিডিওর পৃষ্ঠপোষক নাও হতে পারে। প্রতিটি ভিডিও আলাদা আলাদা সংস্থা প্রযোজনাও করতে পারে। তবে এসবই নির্ভর করে দর্শক সংখ্যা এবং সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যার ওপর। বর্তমানে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করা বা উপহার দেওয়ার উপায়ও করেছে ইউটিউব। ফলে বেড়েছে উপার্জনও। গত বছরেই সর্বোচ্চ ৩০০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন এক ইউটিউবার। বছরের নিরিখে এই বিশাল অঙ্কের টাকার পরিমাণ দেখে নিশ্চিত বোঝা যায় যে এই পেশা হেলাফেলার নয়। বাংলাতেও বর্তমানে এমন বেশ কিছু ইউটিউবার রয়েছেন। আসুন আজ পশ্চিমবাংলার কয়েক জন বিখ্যাত ইউটিউবারদের চিনে নিই এক নজরে।
দ্য বং গাই
এপার বাংলার জনপ্রিয় ইউটিউবারদের প্রসঙ্গ উঠলে সবার আগে যাঁর নাম উঠবে, তিনি কিরণ দত্ত। ‘দ্য বং গাই’ নামেই যাঁকে বেশি চেনে লোকজন। স্কুলের সফল ছাত্ররা হয় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন নয় ডাক্তারি। সেই ছাত্র যদি আবার নিজের ব্লক থেকে মাধ্যমিকে প্রথম এবং উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় র্যাঙ্ক করেন–।তাঁর কাছে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়, সমাজের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। এবং সেই প্রত্যাশার চাপেই সাধারণত তলিয়ে যান প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ছাত্র। সেই চাপের বিরোধিতা করার ক্ষমতা থাকে খুব কম মানুষেরই। কিরণ এমনই একজন মানুষ।
আরও পড়ুন: আসলে কে এই রোদ্দুর রায়, কেন এই ভূমিকায়! পরিচয় জানলে চমকে উঠতে হবে
সবার মতোই ঝোঁকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলেন কিরণ। তাঁর ভাষ্যে, “বাবা-মায়ের চাপে যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করি তা নয়, নিজেই চেয়েছিলাম পড়তে। কিন্তু পড়া শুরুর পরে বুঝলাম এই পথ আমার জন্য নয়। মাধ্যমিকে ব্লকের সেরা হয়েও তখন অঙ্কে ফেল করি। আমি কোনওদিনই সফল ইঞ্জিনিয়ার হতে পারব না।"
শুরুটা খুব সহজ ছিল না। নিজে লিখতে ভালবাসতেন, সেই লেখা নিয়ে কিছু করার ইচ্ছে ছিল। ফিল্ম বা ওয়েব সিরিজ। কিন্তু প্রযোজকরা পাত্তা দেননি। সেই সময়ই ইউটিউবকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন কিরণ। প্রথম দিকে ভিডিওতে লাইক-কমেন্ট পড়ত না। সাবস্ক্রাইবারও খুব বেশি ছিল না। কিরণকে জনপ্রিয়তা এনে দেয় ‘এ কেমন সিনেমা’ নামক সিরিজটি। হিন্দিতে ততদিনে ইউটিউবারদের রমরমা, কিন্তু বাংলায় তেমন কেউ নেই। ফলে আট, নয়ের দশকের বাংলা কিম্ভূতকিমাকার সব সিনেমা নিয়ে ট্রোলিং ভিডিও বানাতে শুরু করেন কিরণ। এইসব সিনেমা আমরা সকলেই অল্পবিস্তর দেখেছি। কিরণও দেখেছেন ছোটবেলায়। খাতা-পেন নিয়ে বসে সেগুলিকেই কাটাছেঁড়া করা শুরু হল। তৈরি হল এই জনপ্রিয় সিরিজ। বর্তমানে তাঁর সাবস্ক্রাইবার দু'টি চ্যানেল মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষেরও ওপরে। বাংলায় ইউটিউবারের পেশাকে জনপ্রিয় করে তোলায় কিরণের অবদান অসামান্য। ইতিমধ্যে ‘দাদাগিরি’-তেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। মাসে ১ থেকে তিন লাখ টাকা আয় তাঁর। বর্তমানে এক কোটি টাকার মালিক কিরণ।
ওয়ান্ডার মুন্না
তিনি বাংলার প্রথম মহিলা ইউটিউবারদের মধ্যে একজন। তাঁর আসল নাম ইন্দ্রাণী বিশ্বাস। তাঁর বাড়ি কলকাতাতেই। কলকাতাতেই বেড়ে ওঠা। ২০১৭-র মে মাসে ইউটিউবে ভিডিও তৈরি করতে শুরু করেন ইন্দ্রাণী। বাংলার ইউটিউবারদের অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। জন্ম ১৭ এপ্রিল, ১৯৯৯, বারাসাতে থাকত তখন তাঁর পরিবার। পরে সল্টলেক সেক্টর ফাইভে উঠে আসেন। জিডি গোয়েঙ্কা স্কুলে পড়াশোনা করেছেন ইন্দ্রাণী। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। বাবা প্রকাশ বিশ্বাস ও মা টুম্পা বিশ্বাসের একমাত্র কন্যা তিনি। শখ বলতে অভিনয় এবং ভ্রমণ। খেতে ভালবাসেন রাধাবল্লভী এবং ফিস ফিঙ্গার। মূলত কৌতুক-জাতীয় ভিডিও তৈরি করেন। বর্তমানে তাঁর মোট সাবস্ক্রাইবার ১৩ লক্ষ। ওয়ান্ডার মুন্না, মুন্না আনপ্লাগড এবং ওয়ান্ডার মুন্না শর্টস— তিনখানি চ্যানেল রয়েছে তাঁর ইউটিউবে। ২০১৭-র ২১ মে ‘হাউ মাই বেঙ্গলি মম রিয়্যাক্টস ইন সালোঁ’ নামে তাঁর প্রথম ভিডিও বেরোয়, মুহূর্তেই তা ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। প্রায় ৪ লাখ মানুষ সেই ভিডিও দেখেছিলেন। ‘দাদাগিরি’ থেকে ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’ –রিয়্যালিটি শোতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। যদিও দীর্ঘদিন আর বাংলা চ্যানেলটিতে দেখা যায় না তাঁকে। তবে ইংরেজি ‘ওয়ান্ডার মুন্না শর্টস’ চ্যানেলটিতে একের পর এক শর্ট ভিডিও বানিয়ে চলেছেন তিনি। বর্তমানে তাঁর মাসিক রোজগার প্রায় লাখখানেক।
সিনেবাপ
সিনেবাপের আসল নাম মৃন্ময় দাস। মৃন্ময়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কোচবিহারে। এখন তাঁর বয়স ৩১। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেক কমার্সে স্নাতক। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান মৃন্ময়। তিনিও মূলত কৌতুকাশ্রয়ী ভিডিও বানান। বর্তমানে তাঁর মাসিক রোজগার ১ লাখ, মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা।
ডিজে বাপন
অনিন্দ্য চক্রবর্তী পেশায় ব্যাঙ্ক-কর্মী, নেশায় গায়ক। 'রোড রোলার' নামক একটি ব্যান্ড ছিল তাঁর। কিন্তু অল্পদিনের জন্য ইউটিউবে 'ডিজে বাপন' হিসেবে অবতীর্ণ হয়ে একপ্রকার ঝড় তুলে দিয়েছিলেন তিনি। ডিজে বাপন ছিলেন প্রকৃতপক্ষে বং গাই-দেরও পূর্বসূরি। সহজ পাঠ-এর কিছু অংশের সঙ্গে বাংলা সিনেমার কোলাজ বানিয়ে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়েছিলেন ডিজে বাপন। এছাড়াও কখনও চন্দ্রিল ভট্টাচার্যর কথার সঙ্গে, কখনও কোনও নায়কের ডায়লগের কোলাজ করে তাঁর ভিডিওগুলি সকলের মনোযোগ কেড়েছিল। সম্ভবত সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ভিডিও তিনিই বানিয়েছেন ইউটিউবার হিসেবে।
এছাড়া চ্যানেল হিসাবে জীবন সমস্যার সমাধান, গেমিং সুব্রত লাইভ, হঠাৎ যদি উঠল কথা– ইত্যাদি যথেষ্ট নাম করেছে। ঝিলম গুপ্তরও খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু তাঁর সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা খুব বেশি না। রয়েছেন বিতর্কিত চরিত্র রোদ্দুর রায়। তাঁর সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের কাছাকছি। এছাড়া রয়েছেন অরিত্র, যিনি নিজেকে চলচ্চিত্র সমালোচক বলে পরিচয় দেন। সব দিক দিয়ে বিচার করলে ইউটিউব এক নতুন পেশার পথ খুলে দিয়েছে মানুষের কাছে।