মানুষের ভিতরের রাক্ষসকে মারেন যে দেবী

এতদিন জানতাম মা দুর্গা মর্ত্য থেকে কৈলাসে ফিরে যাওয়ার পর আবার মর্ত্যে ফেরেন দেবী জগদ্ধাত্রী রূপে। তিনি সিংহবাহিনী, দশ হাতের বদলে মাত্র চারটি হাত, পায়ের নিচে বধ করে রেখেছেন হাতিরূপী এক অসুরকে। যার নাম কারিন্দ্রাসুর। কিন্তু কে এই কারিন্দ্রাসুর? ইনি কি আদেও কোনও অসুর? মা জগদ্ধাত্রী কি আদেও মা দুর্গার রূপ? তিনি কি আদেও কোনও অসুরকে বধ করেছিলেন? উত্তর শুনলে তাজ্জব হয়ে যাবেন। উত্তর হলো, 'না, দেবী জগদ্ধাত্রী আদেও কোনও অসুর বধ করেননি।'। তবে? কে এই অসুর যিনি মায়ের পায়ের নিচে লুটিয়ে আছেন? 

জানতে গেলে জানতে হবে পৌরাণিক ইতিহাস। জগদ্ধাত্রী দেবী আসলে কোনও বিশেষ দেবী নন, ইনি পরম ব্রহ্মের জাগতিক রূপমাত্র! একটু বিশদে বুঝিয়ে বলা যাক। মা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার পর শান্তি নেমে আসে জগৎকুলে। দেবতা থেকে মানবজাতি সব্বাই শান্তির নিঃশ্বাস নেয়। তবে সব থেকে বেশি শান্তি পান দেবতারাই। কারণ মহিষাসুরের আতঙ্কে তারাই সবথেকে বেশি আতঙ্কিত ছিলেন। মা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার পর দেবতারা আবার নিজেদের পুরানো গর্বে অভিভূত অবতারে ফিরে যান। নিজেদের ক্ষমতার অহংয়ে তারা আবার অন্ধ হয়ে পড়েন। যেন তাঁরাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তাঁরা ছাড়া আর কারও কোনও শক্তিই নেই আর কী! এই দেখে ভারী ক্রুদ্ধ হয়ে যান ব্রহ্মা। তিনি যক্ষরূপ ধারণ করে দেবতাদের একে একে ডেকে পাঠান। একটি সামান্য ঘাসকে রেখে তিনি পবনদেবকে বলেন তা নিজ ক্ষমতায় সরিয়ে দেখাতে। পবনদেব হাজারো চেষ্টার পরেও বিফল হন। এরপর বরুনদেবকে ডেকে পাঠানো হয় এবং বলা হয় ঘাসটিকে ভিজিয়ে দেখাতে। তিনিও অসফল হন। তারপরে ডাক পরে অগ্নিদেব, তিনিও ঘাসটিকে জ্বালাতে সক্ষম হন না। অথচ এঁরা প্রত্যেকেই ঘাসটিকে সরাতে হবে, ভেজাতে হবে বা পোড়াতে হবে শুনে অট্টহাসি হাসেন প্রথমে। প্রত্যেকে অসফল হওয়ার পর নিজরূপে হাজির হন ব্রহ্মা। এবং তিনি দেবতাদের বোঝান যে সবার ওপরে ব্রহ্মাই সত্যি। তাহার ওপর কেহ না। তিনি আরও বলেন, দেবতাই হোক কিংবা মানব অথবা দৈত্য, এই জগতে সবচেয়ে বড় একটি অসুরের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই করতে হবে আর সেটি হল তাঁদের মানসিক অহংয়ের অসুর। আর এই অসুরকে বধ করতেই পরম ব্রহ্ম যে দেবীর রূপ নেন, তিনিই জগদ্ধাত্রী। 

জগদ্ধাত্রী দেবীর চার হাত, চার হাতে আছে শঙ্খ, চক্র, তির-ধনুক। দেবী বধ করছেন হস্তীরূপী করিন্দ্রাসুরকে, যা আসলে আমাদের ভিতরে বসবাসকারী অহংয়ের মূর্ত রূপমাত্র। তাই মা আমাদের সকলের মধ্যেই থাকেন, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমায় তাঁকে পূজা করা হয় মাত্র। দেবীকে নিয়ে একটিই মাত্র শ্লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়, শ্রী ললিতা সহস্রনাম-এর ১৭৩তম শ্লোকে দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীকেই জগদ্ধাত্রী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই শ্লোকটি হল, বিশ্বমাতা জগদ্ধাত্রী, বিশালাক্ষী, বিরাগিণী/প্রগলভা পরমোদরা, পরামোদা মানময়ী…

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী দেবীর খুব ধুমধাম করে পুজো করা হয়। অথচ চন্দননগরের সাথে জগদ্ধাত্রী পুজোর কোনও যোগই নেই বিশেষ। কোনও যোগ যদি থেকে থাকে তবে তা কৃষ্ণনগরের সাথে। এই যোগাযোগের পিছনে আছে এক ঐতিহাসিক কাহিনী। ১৭৫৪ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগে বন্দি হতে হয়েছিল কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর ছেলে কুমার শিবচন্দ্রকে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন আজীবন দুর্গাভক্ত। চতুর নবাব জানতেন যে, মনেপ্রাণে দুর্গাভক্ত কৃষ্ণচন্দ্রকে যদি তিনি দুর্গাপুজোর সময়ে বন্দি বানিয়ে রাখতে পারেন, তা হলেই রাজা নিজের রাজ্যটি অর্পণ করে দেবেন নবাবের কাছে। সেই পরিকল্পনা মতো তাঁকে বহুমাস কারাগারে বন্দি বানিয়ে রেখে অবশেষে ছেড়ে দেওয়া হয় দুর্গাপুজোর নবমীর দিন। রাজা ব্যাকুল হয়ে মায়ের পুজো করতে খালি পায়ে ছুট লাগালেন তাঁর রাজ্যের দিকে। যদি সময়ে পৌঁছে দেবীর আরাধনা করা যায়...

কিন্তু ততক্ষনে তার শরীর রণক্লান্ত, পেট ক্ষুধার্ত। দীর্ঘ দিনকাল যাবৎ জেলে বন্দি থাকায় শরীর ভীষণ দুর্বল। রাজা কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে পথে রুকুনপুর বলে একটি জায়গায় পৌঁছে অজ্ঞান হয়ে যান। নিজের ভক্তের এই করুণ অবস্থা দেখে দেবী দুর্গা তাঁকে স্বয়ং স্বপ্নে দেখা দেন জগদ্ধাত্রী রূপে এবং বলেন যে, তাঁর পুজো সঠিক সময় অর্থাৎ শরত মাসে করতে না পারার দুঃখ রাজা ভুলতে পারবেন আগামী কার্তিক মাসের শুক্লা অষ্টমীতে জগদ্ধাত্রী রূপে দেবীর পুজো করলে। জ্ঞান ফেরার পর রাজা হন্তদন্ত হয়ে নিজ রাজ্যে পৌঁছান। সেখানে সমস্ত পণ্ডিতদের ডেকে তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা খুলে বলেন এবং জানতে চান তাঁর স্বপ্নে দেখা সেই দেবী আসলে কে? পণ্ডিতেরা তাঁর কথা শুনে বলেন যে, তিনি দেবী জগদ্ধাত্রীকে দেখেছেন, যাঁকে এককালে পুজো করতেন দ্রাবিড়েরা। সেই মতো ১৭৫৪ সালে কৃষ্ণনগরে বাংলার প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন তিনি, যা এখনও চলে আসছে। সে'সময় রাজার খুব কাছের বন্ধু ইন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী তাঁকে দেখে নিজ বাসস্থান চন্দননগরে শুরু করেন জগদ্ধাত্রী পুজোর, ১৭৫৫ সালে! সেই থেকেই চন্দননগরে এই পুজোর শুরু। যা আজকের দিনে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সব থেকে ধুমধাম করে করা হয়ে থাকে।

More Articles