বিষ্ণুপুরে পটচিত্রে মহামারী দেবীর পুজো, সেই প্রথাই আজও চলেছে

Mahamari Devi Puja in Bishnupur: রাজা এক রাতে ঘুমের মধ্যে দেবীর স্বপ্ন পান। স্বপ্নের বর্ণনা অনুসারে দেবীর একটি পটচিত্র নির্মাণ করা হয়। যা 'মহামারী পট' নামে খ্যাত।

MT

সহস্র বছর ধরে অশুভ শক্তির বিনাশ চেয়ে মাতৃশক্তির আরাধনা হয়েছে। অসুরবিনাশিনী মা জীবের দুর্গতিতে সদয় হয়েছেন। দেবী দুর্গা শক্তির রূপ। পৃথিবীর বুকে সর্বজীবে বিরাজিত। তিনি তো একদিকে বাঙালির কন্যা, অন্যদিকে দশ হাতে অস্ত্র তুলে শত্রুনাশক। দৈত্য, দানব, রোগ, পাপকে তিনি সংহার করেন। আবার কখনও তিনি প্রলয়রূপিণী শ্যামা। সকল শক্তির উৎস। সমাজের অসুরদের বিনাশে নারীরাও আজ ত্রিশূলধারিণী। স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, "লক্ষ লক্ষ ছায়ার শরীর! দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়, নাচে তারা উন্মাদ তান্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়!"

প্রাচীন নগরী মল্লভূম বা বিষ্ণুপুর ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ।  বহু লোককথা, গান, পালায় উঠে আসে বহু শতাব্দী প্রাচীন এক পুজোর ইতিহাস। গ্রামে মহামারীর প্রকোপ। দেবীর আগমনে, পুজোয় শুভ শক্তির আলোয় সে মড়ক থেকে মেলে মুক্তি- মহামারী আজ আর নতুন কিছু নয়। একবিংশ শতাব্দীতেও বাঙালির পরিচয় ঘটেছে। মহামারীর প্রতিক্রিয়া বড় উদ্বেগজনিত। কুসংস্কার নয়, গ্রাম বাংলায় দেবীর মাহাত্ম্য সূচক কাহিনী মানুষের ভক্তি, আচার-অনুষ্ঠান, জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত।

বিষ্ণুপুরে রাজবাড়ীর ভগ্ন দালান

আজ থেকে হাজার বছর আগে প্রাচীন রীতিতে বিষ্ণুপুরে মৃন্ময়ী মাতার পুজোর সঙ্গে জড়িত এক কাহিনী। ইতিহাস বলে, বীর মল্ল রাজবংশ বহু বছর শাসন করেছে। মল্ল বংশে প্রথম দেবী মন্দির ৯৯৭ সালে হয়। মহারাজা জগৎ মল্লের আমলে। সেটাই বিষ্ণুপুরে মৃন্ময়ী মাতার মন্দির। ষোড়শ শতকে বিষ্ণুপুরের রাজারা বিষ্ণুর উপাসক হয়। তবে এর বহু বছর আগে থেকে আদি মল্ল ও জগৎ মল্লর হাত ধরে বাঁকুড়ার জয়পুরের কাছে মল্ল রাজাদের রাজত্ব শুরু। তখন প্রদ্যুম্নপুর ছিল রাজধানী। এরপর রাজা জগৎ মল্ল দেবীর দৈব আদেশে রাজধানী সরিয়ে আনেন বনবিষ্ণুপুরে। অর্থাৎ আজকের বিষ্ণুপুর।

বনবিষ্ণুপুরে রাজা শিকারে এসে গভীর বনের ভেতর দেবীর দর্শন পান। তারপর সেখানেই মন্দির নির্মাণ করে দেন। মন্দিরে আজও আছে প্রাচীন এক বট গাছ। বলা হয়, সেখানেই রাজা দেবীর আদেশ পেয়েছিলেন। প্রাচীন প্রথা মেনে আজও চলছে পুজো। বিষ্ণুপুর রীতিতে নির্মিত দেবী মূর্তি। রাজ পরিবারের এই কূলদেবীর রূপ মহিষাসুরমর্দিনী। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও মা সারদা মৃন্ময়ী মাতাকে দর্শন করতে এসেছিলেন। ঠাকুর দর্শন করে সমাধিস্থ হন।

আরও পড়ুন- ভাঙা নাকের দুর্গা! বোলপুলের দেউলির পুজো যে কারণে অনন্য

কেমন ছিল মল্ল বংশের সেই প্রাচীন রীতি? যা আজও প্রচলিত। মহারাজা দামোদর সিংহের আমলে এক কলেরা মহামারী দেখা দেয়। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যায়। অশুভ এক ছায়া নেমে আসে। রাজা এক রাতে ঘুমের মধ্যে দেবীর স্বপ্ন পান। স্বপ্নের বর্ণনা অনুসারে দেবীর একটি পটচিত্র নির্মাণ করা হয়। যা 'মহামারী পট' নামে খ্যাত। পটচিত্রতে দেবীর আরাধনার পর দেবীর শুভ শক্তির প্রভাবে গ্রামে রোগ ব্যাধি মুক্তি পেয়েছিল। সঙ্গে বিষ্ণুপুরের গৌরব বৃদ্ধি পায়। এমনটাই স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস। তাই প্রতি বছর পুজোর পনেরো দিন আগে থেকেই মৃন্ময়ী মাতার মন্দিরে পুজো শুরু হয়। অষ্টমীতে সন্ধিপুজোর পর এক বিশেষ আচার অনুষ্ঠান প্রাধান্য পায়। যা শারদোৎসবকে সার্থক করে তোলে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ দেখতে আসেন।

টেরাকোটা চিত্রে অসুরবিনাশিনী দেবী, বিষ্ণুপুর

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহু বিদেশি পর্যটক আসেন মৃন্ময়ী মন্দির দেখতে। সন্ধিপুজো শেষ হলে মোর্চা পাহাড়ে তিন বার কামান দাগানো হয়। এরপরেই শুরু হয় 'খচ্চর বাহিনী' বা 'মহামারী দেবীর' পুজো। কামান দাগানোর সময় অসংখ্য মানুষ উপস্থিত হন। তাদের বিশ্বাস যে শুভ সময় আসতে চলেছে। কোনো অশুভ প্রভাব আর থাকবে না। দেবীর স্বপ্নে বর্ণিত রূপ, এক হাতে তলোয়ার নিয়ে তিনি বাহন খচ্চরের পিঠে বসে আছেন। অন্য হাতে বিজয় পতাকা। গলায় মুণ্ডমালা। দেবীর চারটি চোখ। ভীষনা দেবী। এক বিস্ময়কর রূপে পূজিত। তাছাড়াও মৃন্ময়ী মাতার মন্দিরে বড়, মেজো, ছোট ঠাকুরানী নামে তিনটি দুর্গা পটচিত্রকে পুজো করা হয় ষোলো দিন ধরে।

অষ্টমীতে বিশেষ রীতিটি সন্ধিপুজোর পর পালন করা হয়। এরপর গ্রামের মানুষ তাদের বাড়িতে ফিরে যান। পুজোর সময় মন্দিরে কোথাও কেউ উপস্থিত থাকে না। শুধুমাত্র রাজবাড়ির বর্তমান কিছু সদস্য ও পুরোহিত থাকেন। এরপর শুরু হয় পটচিত্র পুজো। পুজোর পর চিত্রটিকে রাজবাড়ীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পুজোর শেষ অবধি সকলে নিষ্ঠা সহকারে অপেক্ষায় থাকেন। তিনি বিনাশকারিণী ও রোগনাশিনী। পুজো ব্যাপী গ্রামজুড়ে চলে নানা অনুষ্ঠান। স্থানীয় প্রচলিত বিশ্বাস মহামারীনাশক পুজোর মাধ্যমে সমাজে সব প্রতিকূলতা কেটে যায়।

More Articles