বিষাক্ত হ্রদ, ভুতুড়ে বাংলো, উন্মুক্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা! দার্জিলিং নয়, এবার শীতে পাড়ি দিন এই পাহাড়ে

Rinchenpong Travel Guide: রিনচেনপং মনেস্ট্রি থেকে একটু হেঁটে এগিয়ে গেলে দেখতে পাবেন একটি পুরনো ব্রিটিশ আমলের বাংলো। বাংলোর সামনে অল্প নীচে দেখতে পাবেন একটি প্রায় শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়।

বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান শুরু হলেই রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েন? সেই একই চেনাজানা ঘোরার জায়গা। পাহাড় হলে সেই সিমলা, কুলু, মানালি, দার্জিলিং, গ্যাংটক আর সমুদ্র হলেই দিঘা, পুরী, মন্দারমণি। ঐতিহাসিক স্থানের নাম উঠলেই লখনউ, রাজস্থানের নাম উঠে আসে। কিন্তু এগুলি ছাড়াও যে ভারতে এমন অনেক স্থান রয়েছে যার খোঁজ খুব কম লোকই রাখেন। এখন মানুষের আকর্ষণ বরাবরই অফবিটের দিকে। ভিড় থেকে বেরিয়ে ফের ভিড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। বেড়াতে গিয়ে হই হট্টগোল, চেঁচামিচি ভালোই লাগে না। প্রকৃতি হোক বা ঐতিহাসিক স্থান সবই ভালো লাগে নিরিবিলিতে। তাই মাঝে মাঝে একা কিংবা প্রিয় বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন কম জনপ্রিয় সব স্থানে, কম খরচে, অল্প ছুটিতে। আজ এমন কিছু জায়গার হদিশ রইল যেখানে গেলে মন, প্রাণ সব ভালো হবেই।

পাইন, ওক এবং দেওদারের ঘন সামিয়ানা। অনাবিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর জানা-অজানা অসংখ্য রঙ বেরঙয়ের পাখি। ১৭০০ মিটার উচ্চতায় পশ্চিম সিকিমের ছোট্ট গ্রাম রিনচেনপং। শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ১২৫ কিমি দূরে অবস্থিত। পেলিং থেকে দূরত্ব ৪৫ কিমি। সুন্দরী সিকিমের সবুজ নীল হিমালয় ঘেরা এই গ্রাম নির্জনে ২-৩ দিন ছুটি কাটাবার আদর্শ গন্তব্য এটি। এখানে নেই দোকান পাটের ভিড়, নেই ব্যস্ততা, নেই গাড়ির ধোঁয়া, নেই দূষণ। তার বদলে আছে মেঘমুক্ত দিনে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব উপস্থিতি। আছে সবুজের ছায়ায় পাখির ডাক শুনতে শুনতে পাহাড়ি পথে হেঁটে বেড়ানো। পায়ের নিচে সবুজ ঘাসের নরম গালিচা। এদিক ওদিক ফুটে থাকা নাম না জানা বুনো ফুলের উদ্ধত চাহনি। জানা অজানা পাখিদের রঙিন পালকে ভালবাসায় তৈরি রিনচেনপং আসলে এক মায়াবী স্বপ্নের নাম।

আরও পড়ুন- অস্তরঙ্গ, প্রজাপতি, নিভাতি… পুজোয় ঘুরে আসুন দেশের সেরা এই সব অফবিট বিচে

পশ্চিম সিকিমের এক প্রান্তে, গ্যাংটক থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত রিনচেনপং আদ্যোপান্ত একটি ছিমছাম পাহাড়ি গ্রাম। কিন্তু বিগত কিছু দশকে রিনচেনপং হয়ে উঠেছে বাঙালি পর্যটকদের কাছে এক অফবিট হিডেন ট্রেজার। তার মুখ্য কারণ প্রধানত দু’টি, প্রথমত পেলিঙের মতো একটি বড় শহরের সান্নিধ্য। ফলে পর্যটকরা সহজেই শিলিগুড়ি বা দার্জিলিং থেকে এখানে পৌঁছতে পারেন। দ্বিতীয়ত, সমগ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের অসাধারণ ভিউ। কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের ঠিক বিপরীত দিকেই অবস্থিত হওয়ার ফলে আকাশ পরিষ্কার থাকলে সারাদিন ধরে ঘরে বসেই পাওয়া যায় এক অতুলনীয় মাউন্টেন ভিউ, যা হয়তো নিকটবর্তী সবকটি হিল স্টেশনের ভিউ পয়েন্টগুলোকে টেক্কা দিয়ে যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠের ৫৫৭৬ ফিট উপরে অবস্থিত রিনচেনপং পাহাড়ের কোলে বেড়ে ওঠা এমন এক স্বপ্নের দেশ যা আজও অত্যধিক পর্যটকদের ভিড়ে নুয়ে পড়েনি। পশ্চিম সিকিমে ঘোরার সময় হি, বার্মিওক, দেনতাম বা উত্তারেকে পিছনে ফেলে স্বচ্ছন্দে কিছু দিন কাটিয়ে যেতে পারেন এই রিনচেনপং গ্রামটিতে।

রিনচেনপং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে শুরু থেকেই প্রথমের সারিতে। কুয়াশা ঘেরা ঘন সবুজ জঙ্গল দিয়ে ঢাকা থাকে দূরের পর্বতমালা। চারিদিকে ময়না, টেলরবার্ড, বুলবুল, আর নাটক্র্যাকার পাখির কলরব- বার্ড ওয়াচারদের জন্যে সত্যিকারের এক প্যারাডাইস। অর্গানিক ফার্মিংয়ের দিক থেকেও রিনচেনপং এগিয়ে সবার থেকে। গ্রামবাসীদের নিজস্ব ফার্মে দেখতে পাবেন কিউই, কমলালেবু, মুসুম্বি বা চেরির চাষ। শুধু ফল নয়, এই অঞ্চলে পাবেন এলাচ, হলুদ, আদা থেকে শুরু করে নানান কিছুর সন্ধান। স্থানীয় হোম স্টে-তে থাকলে পাবেন এগুলি খেয়ে দেখার সুযোগও। ইচ্ছে হলে কিনেও নিয়ে আসতে পারেন নিজেদের জন্যে। আর পাবেন চারিদিকে ঘন রোডোডেনড্রোনের জঙ্গল, মাঝে মাঝে নাম না জানা কিছু পাহাড়ি অর্কিডের হাতছানি। প্রকৃতির কোলে ফিরে যেতে চাইলে, রিনচেনপং যেন সদা প্রস্তুত আপনার স্বপ্ন সত্যি করার জন্য।

ছোট্ট জায়গা হলেও, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে রিনচেনপং বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আছে দু’টি মনেস্ট্রি। অষ্টাদশ শতকে তৈরি হয়েছিল রিশম গুম্ফা, যার সামনে থেকে সমগ্র উপত্যকার অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়। সূর্যোদয়ের সময়ে এখানে আসতে পারলে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রথম সকালের দুধে আলতা রঙ স্বচক্ষে দেখতে পারবেন। রিশম মনেস্ট্রি থেকে পাহাড়ের দৃশ্যও অসাধারণ। রিনচেনপংয়ে এই জায়গাটি ম্যাগি দাড়া নামে পরিচিত। এখান থেকে ঘুরে আসা যায় পয়সন লেকও। কথিত রয়েছে, এই হ্রদ নাকি ভুতুড়ে। আঠেরোশ শতকে ব্রিটিশদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে স্থানীয়রা ওই হ্রদের জলে বিষ মিশিয়ে দেয়। সেই থেকেই নাকি এই হ্রদের নাম পয়সন লেক।

এই মনেস্ট্রির ঠিক পিছনেই রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির উদ্দেশে তৈরি একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র। রিশম মনেস্ট্রির পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটি ছোট্ট ট্রেক করলে পেয়ে যাবেন আরও উপরে অবস্থিত দ্বিতীয় গুম্ফাটির সন্ধান। মনে করা হয় এই মনেস্ট্রিটি তৈরি হয়েছিল ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে। ভিতরে রয়েছে অতিবুদ্ধ রূপে বুদ্ধের অপরূপ এক মূর্তি। এছাড়াও এখান থেকে পেলিং, প্রেমায়েন্সি মনেস্ট্রি, কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস, রিম্বি ফলস, দরাপ ভিলেজ, চাঙ্গে ওয়াটার ফলস্ সিংসোর ব্রিজ, খেচিপেরি লেক, ছায়াতাল লেক, শ্রীজঙ্ঘা টেম্পল, হি ওয়াটার গার্ডেন সবই ঘুরে আসা যায় একদিনের সফরে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল রাবডেনটসে রুইনস। বর্তমানে পেলিংয়ের স্কাইওয়াক পর্যটকদের মধ্যে আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছে। সেটাও ঘুরে আসতে পারেন রিনচেনপং থেকে। ১৩৭ ফুটের দৈত্যাকার চেনরিজ স্ট্যাচু দেখার সুযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুন- দিঘা-পুরী-দার্জিলিং আর নয়, চেনা ছকের বাইরে সফর সারুন পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা শিমোগায়

বিষপোখরি বা পয়সন লেক

রিনচেনপং মনেস্ট্রি থেকে একটু হেঁটে এগিয়ে গেলে দেখতে পাবেন একটি পুরনো ব্রিটিশ আমলের বাংলো। বাংলোর সামনে অল্প নীচে দেখতে পাবেন একটি প্রায় শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়। জলাশয়টি ছিল ব্রিটিশ শাসক এবং তাঁদের সৈন্যদের জলসঞ্চয়ের প্রধান স্থল। কথিত আছে ১৮৬০ সাল নাগাদ যখন ব্রিটিশ সৈন্যদল এই অঞ্চলে অগ্রসর হতে শুরু করে, তখন স্থানীয় লেপচা জনগোষ্ঠীর মানুষজন এই লেকের জলে বিষ মিশিয়ে দেন। বহু ব্রিটিশ সৈনিকের প্রাণনাশের পরে তারা বাধ্য হয় পিছু হটতে। বিষাক্ত জল না থাকলেও বিষপোখরি বা পয়সন লেকটি আজও তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। আর পরিত্যক্ত ব্রিটিশ বাংলোটিকে বর্তমানে পরিণত করা হয়েছে একটি গেস্ট হাউসে।

পশ্চিম সিকিম টুরিস্ট স্পট

রিনচেনপং থেকে স্থানীয় গাড়ি ভাড়া করে সহজেই ঘুরে আসতে পারেন পশ্চিম সিকিমের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট থেকে। এখান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে ছায়াতাল লেক, যেখান থেকে আপনি পাবেন চারিদিকের পর্বতমালার অসাধারণ ভিউ। লেকের কাছাকাছি রয়েছে সিরিজুঙ্গা মন্দির, যা স্থানীয় লিম্বু জনগোষ্ঠীর মানুষদের এক অন্যতম পীঠস্থান। ঘুরে আসতে পারেন এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম ব্রিজ সিংশোর ব্রিজ থেকে। অল্প এগিয়ে গেলে পাবেন উত্তারে গ্রাম, যেখানে রয়েছে ট্রাউট মাছের ফার্ম। ভোজনরসিক হলে ঘুরে দেখতে পারেন দেনতামের চিজ ফ্যাক্টরি। এরাই সর্বভারতীয় সংস্থা আমূলকে চিজ সরবরাহ করে থাকেন। রিনচেনপং থেকে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে লেগশিপ বাজারের কাছে আছে উষ্ণ প্রস্রবন, অফবিট ট্যুরিস্টদের জন্য বিশ্রামের আদর্শ জায়গা।

হাতে যদি একটু সময় বেশি থাকে তাহলে এখান থেকে ৩ কিমি দূরে কালুকে চলে যাওয়া যায়। রিনচেনপংয়ের তুলনায় দোকানপাট, জনসংখ্যা কিছু বেশি। কিন্তু প্রকৃতির অকৃপণ উজাড় করা ভালবাসার পরিমাণটা এখানে একই রকম। এখানে নেই শহুরে কোলাহল, দূষণ। তাই শহুরে ব্যস্ততার ইঁট কাঠ পাথরের সীমানা ছাপিয়ে এবারের সফরটা তাহলে হয়েই যাক হিমালয়ের নির্জনতা আর পাহাড়ি সারল্যের মাঝখানে।

কীভাবে যাবেন

হাওড়া বা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছনোর জন্য এখন বেশ কয়েকটা ট্রেন রয়েছে। নিজের সময় সুযোগকে সামলে নিয়ে যে কোনও একটাতে চেপে বসতে পারলেই হল। এছাড়া এসি, নন-এসি কলকাতা-শিলিগুড়ি বাসের সংখ্যাও অসংখ্য।

শিলিগুড়ির সিকিম জিপ স্ট্যান্ড থেকে গাড়িতে সেভক হয়ে মেল্লি চেক পোস্ট পেরিয়ে সোজা জোড়বাং। জোড়বাং থেকে জুম, সোরেন হয়ে প্রথমে কালুক। কালুক থেকে তিন কিমি গিয়ে রিনচেনপং। জোড়থাং হয়ে রিনচেনপং পৌঁছতে সময় লাগে কম বেশি ৫ ঘণ্টা। শেয়ার জিপে জোড়থাং হয়ে আবার সেখান থেকেও শেয়ার গাড়িতে এখানে পৌঁছে যাওয়া যায়৷

কোথায় থাকবেন

রিনচেনপংয়ে থাকার জন্য আছে বেশ কিছু হোটেল, রিসর্ট ও হোম স্টে। ভাড়া ৮০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত। প্রয়োজনের তুলনায় থাকার জায়গা খুব বেশি নেই। ভরা সিজনে আগাম বুকিং করে যাওয়াই উচিত। রিনচেনপংয়ে থাকতে পারেন হোটেল রিনচেন, হোটেল নেস্টে।

More Articles