জল বয় উলটো দিকে, তালে তালে লাফায় জমি! রহস্যময় এই অফবিট গন্তব্য পর্যটকদের অজানাই

Mainpat Chhattisgarh: রাম নাকি এই জায়গায় গরম তেলের একটি বাটি ফেলে দিয়েছিলেন এবং সেই থেকেই এই জায়গায় উষ্ণ প্রস্রবণ তৈরি হয়েছে।

বাঙালির মন উড়ু উড়ু করলেও ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় খুব কমই। তার বড় কারণ অবশ্য নিঃসন্দেহেই ছুটির অভাব। তার উপরে যদি আবহাওয়া প্রতিকূল থাকে কিংবা সন্তানের স্কুল-টিউশন, তাহলে তো আর কথাই নেই। তাই যখন ক্যালেন্ডারে পরপর কয়েকটা লালদাগ একসঙ্গে দেখা যায়, তখন মনটা কেমন উদাস তো হয়ই। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? দীঘা, পুরি, দার্জিলিং সবই তো ঘোরা। ঠিক করে উঠতে উঠতেই সময় চলে যায়। করোনা অতিমারি পরিস্থিতির পরে শান্ত, নিরিবিলি এবং পর্যটকদের কম ভিড় এমন জায়গার সন্ধান করেছেন অনেকেই। সিমলা, উটি, কেরল কিংবা উত্তরাখণ্ড- এই সমস্ত জনপ্রিয় স্থানগুলোর কথা মাথায় এলেও এইসব জায়গায় ভিড় এবং খরচ দুটোই খুব বেশি। তাই এমন এক জায়গার সন্ধান সকলেই করেন যেখানকার নাম কেউ শোনেননি, যেখানে লোকজনের আনাগোনা খুব কম। এরকমই একটি জায়গা রয়েছে হাতের খুব কাছেই। ছত্তিশগড় রাজ্যের অম্বিকাপুর জেলায় অবস্থিত মেনপাট ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের সবথেকে সুন্দর হিল স্টেশনগুলির মধ্যে এটি একটি। ছত্তিশগড়ের অন্যান্য জায়গা থেকে অনেকটাই আলাদা এই হিল স্টেশন। মেনপাটকে ছত্তিশগড়ের সিমলাও বলা হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং মনোরম পরিবেশ যদি আপনার অগ্রাধিকার হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই একবার ঘুরে যান ছত্তিশগড়ের এই ছোট হিল স্টেশনটিতে। এটি আদতে একটি তিব্বতি কলোনি। ধাকপো মনেস্ট্রি, বৌদ্ধ মন্দির, মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাত এবং গুহা নিয়েই মন ভালো করতে প্রস্তুত মেনপাট।

ধাকপো বৌদ্ধবিহার

মেনপাট এলাকার অন্যতম আকর্ষণ হল এই ধাকপো বৌদ্ধ বিহার। তিব্বতের যুদ্ধের সময় সেখানকার বহু বাসিন্দা রিফিউজি হয়ে ভারতের এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন এবং তারাই তাদের এই ছোট্ট সম্প্রদায় নিয়ে একেবারে মাতিয়ে রেখেছেন মেনপাট অঞ্চলটিকে। যেহেতু বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য এই জায়গায় বেশি, তাই আনাচে-কানাচে বেশ কিছু বৌদ্ধ মন্দির চোখে পড়বে। তারই মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় বৌদ্ধ বিহার হলো ধাকপো সেডুপ্লিং বৌদ্ধ বিহার। আকারে আকৃতিতে অন্যান্য বৌদ্ধ মন্দিরগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা এই ধাকপো। এই বৌদ্ধ বিহারটি একেবারেই কোলাহলহীন। এই বৌদ্ধ বিহারে কিছুক্ষণ সময় কাটালেই মন শান্ত হয়ে আসে, বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি-র সুর মনকে থিতু করে।

তিব্বত রিফিউজি ক্যাম্প

১৯৫৯ সালে চিনের সঙ্গে তিব্বতের যুদ্ধের সময় সেখানকার ধর্মগুরু দলাই লামা ভারতে এসেছিলেন আশ্রয়ের সন্ধানে। তার সঙ্গেই এসেছিলেন দলাই লামার লক্ষ লক্ষ ভক্ত এবং বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শরণার্থী। ভারত সরকারের সাহায্যে হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালা এবং মেনপাটের মতো জায়গায় তাদের বসতি স্থাপন করতে দেওয়া হয়। সেই যুগ থেকে এখনও পর্যন্ত বৌদ্ধদের এই রিফিউজি ক্যাম্পটি হয়ে রয়েছে স্মরণীয়। ২৫ কিলোমিটারের এই এলাকায় মোট ৭টি ক্যাম্প আছে। অবশ্যই এই রিফিউজি ক্যাম্প একবার ঘুরে যাওয়া দরকার।

আরও পড়ুন- সিকিম, সিটং অনেক হল! এই শীতে হাতের নাগালেই রয়েছে ‘ভারতের স্কটল্যান্ড’

টাইগার পয়েন্ট

মেনপাটের মূল কেন্দ্র থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত টাইগার পয়েন্ট এই এলাকার অন্যতম এক আকর্ষণীয় স্থান। আদতে এটি একটি জলপ্রপাত যার উৎপত্তি মহাদেব মুদা নদী থেকে। এই জলপ্রপাতটি সবুজে ঘেরা এবং জলপ্রপাতের চারিদিকের ঘন জঙ্গল এই স্থানটিকে করে তুলেছে আরও মোহময়ী। এই জলপ্রপাতের উচ্চতা প্রায় ৬০ মিটার, ফলে জলপ্রপাতের একেবারে নিচে যাওয়ার অনুমতি মেলে না। তবে জলপ্রপাতের পাশে বসে বেশ খানিকক্ষণ সময় কাটাতে পারেন।

মাচালি পয়েন্ট

এই স্থানটিও আদতে একটি জলপ্রপাত এবং মাচালি পয়েন্ট ছাড়াও, এই জায়গাটির আরও একটি নাম রয়েছে, ফিশ পয়েন্ট। জলপ্রপাত থাকলেও, এই মাচালি পয়েন্টের সব থেকে বড় আকর্ষণ হলো নদীতে ভেসে চলা রঙিন বিভিন্ন মাছ। প্রধান হিল স্টেশন থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জায়গাটি। সবুজ ঘন অরণ্য এবং জলপ্রপাতে ঘেরা এই জায়গায় বসে রঙিন মাছেদের ঘোরাফেরা দেখতে মন্দ লাগবে না। আর যদি মাছ ধরার ইচ্ছে হয়, তারও সুবিধা রয়েছে। তবে এর জন্য আগে থেকে বুকিং করতে হবে।

ডান্সিং ল্যান্ড

কোনও জমির উপর লাফালে আপনার তালে তাল মিলিয়ে জমি কোনওদিন লাফায় কি? অবাস্তব ঠেকলেও এই মেনপাটের জলজলি এলাকায় এমন একটি জমি রয়েছে যেটি কিনা আপনার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে লাফাবে! এই জমিটি অনেকটাই ট্র্যাম্পোলিনের মতোই, তবে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ভাবেই তৈরি এটি। যখন এই জায়গার উপরে দাঁড়িয়ে কেউ লাফাবেন, তার সঙ্গে এই পুরো জমিটাই লাফায়। দলের কচিকাঁচাদের এই জায়গাটি ভালো লাগবেই।

টাটা পানি

এই জায়গাটি আসলে একটি প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবন। মেনপাটের প্রধান হিলস্টেশন থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জায়গাটি। পুরাণমতে, রামায়ণের সময়কালে রাম নাকি এই জায়গায় গরম তেলের একটি বাটি ফেলে দিয়েছিলেন এবং সেই থেকেই এই জায়গায় উষ্ণ প্রস্রবণ তৈরি হয়েছে। বলা হয়, যদি কেউ এই টাটা পানির জলে স্নান করেন তাহলে তার সমস্ত রোগ এবং 'পাপ' ধুয়ে মুছে যাবে। মকর সংক্রান্তির সময়ে এই জায়গাটিতে প্রচণ্ড ভিড় থাকে। তাই স্নান করার ইচ্ছা থাকলে, এই সময়টা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

যোগিমারা গুহা

প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহ থাকলে, অবশ্যই এই যোগিমারা গুহা ভ্রমণ করা উচিত। প্রধান হিলস্টেশনের কাছেই রয়েছে এই গুহাটি। ছত্তিশগড়ের সুরগুজা জেলায় অবস্থিত এই গুহা। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই গুহায় মানুষ বসবাস করত। তার বেশ কিছু নিদর্শন এরই মধ্যেই খুঁজে বের করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। এই গুহায় প্রবেশ করলেই আদিম মানুষের আঁকা ছবি নজর কাড়বে। লাল রঙের আউটলাইন দিয়ে আঁকা মানুষ ও পশুপাখির ছবি বেশ আকর্ষণীয়। এই এলাকার সবথেকে পুরনো কিছু জায়গার মধ্যে অন্যতম এই গুহাটি। ট্রেকিং করার সুযোগও রয়েছে, তবে এই ট্রেক খুব একটা সহজ নয়।

আরও পড়ুন- অস্তরঙ্গ, প্রজাপতি, নিভাতি… পুজোয় ঘুরে আসুন দেশের সেরা এই সব অফবিট বিচে

উল্টা পানি

মেনপাটের সবথেকে নতুন আকর্ষণের মধ্যে একটি হলো এই উল্টা পানি। এই জায়গাটি বর্তমানে সকল পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে কারণ এই জায়গায় নদীর জলের প্রবাহ উল্টোদিকে। সমতল থেকে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যায় জল। পাশাপাশি অনেক সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িকেও পাহাড়ের দিকে উঠে যেতে দেখা গিয়েছে। এই রহস্যের কারণ এখনও পর্যন্ত উন্মোচিত হয়নি। যেহেতু নদীর জলের প্রবাহ উল্টোদিকে, সেই কারণেই এই এলাকার নাম হয়েছে উল্টা পানি।

ঘোরার জন্য কোন সময় সবথেকে ভালো?

মেনপাট যেতে হলে সবথেকে ভালো সময় বর্ষাকাল এবং শীতকাল। তবে যদি মেনপাটের বিখ্যাত বার্ষিক কার্নিভালের আনন্দ পেতে ইচ্ছা হয় তাহলে ফেব্রুয়ারি অথবা মার্চ মাসে যেতে হবে। তবে বর্ষাকালে অথবা শীতকালে যাওয়াই ভালো। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে জলপ্রপাতগুলি দারুণ সেজে উঠবে। পাশাপাশি অনেক সময় শীতকালে এই এলাকায় বরফও পড়ে। তাই যদি শীতের দিকে যান এবং কপাল মন্দ না হয়, তাহলে তুষারপাত দেখার সম্ভাবনাও রয়েছে।

কীভাবে যাবেন?

এই হিলস্টেশনটি ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুর থেকে প্রায় ৫৬২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এলাকাটি ওড়িশর কাছাকাছি। সব থেকে কাছের রেল স্টেশন অম্বিকাপুর হলেও, হাওড়া থেকে অম্বিকাপুর যাওয়ার কোনও সরাসরি ট্রেন নেই। তাই হাওড়া থেকে ওড়িশার ঝারসুগুড়া জংশন (JSG) হয়ে আপনাকে পৌঁছতে হবে মেনপাট। মোটামুটি হাতে ৩ দিনের সময় থাকলে বেরিয়ে পড়তেই পারেন এই অচেনা জায়গায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে।

More Articles