নির্বাচনী বন্ডের নামে কীভাবে তোলাবাজি চক্র চালাচ্ছিল মোদি-শাহের বিজেপি?
Electoral Bond Donation Scam: মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং, সীমান্তে সড়ক এবং পরিকাঠামো তৈরির বরাত পাওয়া এই সংস্থার সঙ্গে আবার টিভি ৯ বলে একটি সংবাদ মাধ্যমের যোগসাজশ রয়েছে।
বার্টোল্ড ব্রেখটের বিখ্যাত নাটকের একটি দৃশ্যের বর্ণনা করা আজ অত্যন্ত জরুরি। ১৯৩৭ সালে ব্রেখট এই নাটকটি লিখেছিলেন- ‘দ্য লাইফ অফ গ্যালিলিও’। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, গ্যালিলিওর ছাত্র আন্দ্রেই বলছেন, ‘আনহ্যাপি দ্য ল্যান্ড, দ্যাট হ্যাজ নো হিরোস’ অর্থাৎ সেই দেশ অত্যন্ত অখুশি হয়, যে দেশের কোনও নায়ক নেই। নাটকের মূল চরিত্র গ্যালিলিও সেই স্থানে ঢোকার সময়ে এই কথাটি শুনতে পান। কিছুক্ষণ চুপ থাকেন তিনি, আরও কিছু কথাবার্তার পরে, গ্যালিলিওর মুখে শোনা যায়, ‘আনহ্যাপি দ্য ল্যান্ড, দ্যাট নিড হিরোস’! যে দেশের নায়কের প্রয়োজন হয়, সেই দেশই সবচেয়ে অখুশি। এই
দু'টি সংলাপের মধ্যে দিয়েই আজকের সময়ের সমস্ত কথা বলে দেওয়া যায়। দুটো ধারণার লড়াই, দুটো চিন্তাভাবনার বিতর্ক। কখনও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বা কখনও অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে আমরা নায়ক খুঁজে চলেছি। আমাদের সমস্ত না পাওয়া, সমস্ত অভিযোগ যেন কোনও একজন নায়কের মাধ্যমে সমাধান হয়ে যাবে। দুর্নীতির প্রশ্নে, নারী নির্যাতনের প্রশ্নে আমরা নিজেদের থেকেও অনেক বেশি আস্থা রাখার কথা ভাবি একজন নায়কের প্রতি। সেই নায়ক যদি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে ব্যবহারও করেন আমরা ভুলে যাই প্রশ্ন করতে, কারণ আমরা নায়কের খোঁজে ব্যস্ত। আমরা মসিহা বা হিরো বানাতে ব্যস্ত। আমরা আশা করে বসে আছি, কবে নায়ক সমস্ত কিছু বদলে দেবেন।
২০১১ সাল। কংগ্রেসের এক একটি দুর্নীতি নিয়ে রোজ গণমাধ্যমে খবর হচ্ছে। রোজ বিরোধী বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর মুখ, দুর্নীতির প্রশ্নে শাসক কংগ্রেসকে বিঁধছেন। আর অন্যদিকে দিল্লিতে আন্না হাজারের মতো তথাকথিত অরাজনৈতিক মুখকে সামনে রেখে নাগরিক সমাজ থেকে আওয়াজ উঠছে, দুর্নীতিমুক্ত ভারতবর্ষ দরকার। দেশজুড়ে ন্যারেটিভ তৈরি করা হলো, এই ধরনের দুর্নীতি থেকে মুক্তি দিতে একমাত্র নরেন্দ্র মোদিই ভরসা। তিনি একাই নতুন ভারতবর্ষ গড়তে পারবেন, দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়তে পারবেন। তারপর নির্বাচন হলো। কংগ্রেসকে পর্যুদস্ত করে, সমস্ত ন্যারেটিভকে সত্য প্রমাণিত করে, বিজেপি ক্ষমতায় এল। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেন, স্লোগান দিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’, তিনি নিজেও দুর্নীতি করবেন না, কাউকে দুর্নীতি করতেও দেবেন না।
আরও পড়ুন- দেশজুড়ে ভয়াবহ দুর্নীতি! বন্ডের বিনিময়ে কাদের কী কী সুবিধা দিয়েছে বিজেপি?
যেমন কথা তেমন কাজ! ২০১৬ সালে হঠাৎ একদিন ঘোষণা করলেন, সমস্ত পুরনো ৫০০, ১০০০ টাকার নোট এক লহমায় বাতিল করা হলো। বললেন, যাঁদের কালো টাকা নেই, তাঁদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। এই কালো টাকা দিয়েই নাকি সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়া হতো। সুতরাং এটা বন্ধ হলে
সন্ত্রাসবাদও বন্ধ হবে। বলা হলো, সাধারণ মানুষ যেন এসব টাকা ব্যাঙ্কে গিয়ে হয় বদল করেন নয় জমা দিয়ে দেন। সবাই ভাবতে শুরু করল, সত্যিই কালো টাকার মালিকদের এবার টাকা জলে ফেলে দিতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সব কালো টাকা এবার বেরিয়ে আসবে। যত চুরি হয়েছে সব এবার ধরা পড়বে! আসলে কী হলো? সমস্ত ছোট ব্যবসা বন্ধ হলো, আর বড় শিল্পপতিরা আরও ধনী হলেন। কিছুকাল পরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব দিলেন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করতে হবে। এতদিন সমস্ত রাজনৈতিক দল নগদ লেনদেনে অভ্যস্ত ছিল। এবার ‘নির্বাচনী বন্ড’ আনা হচ্ছে, যার মধ্যে দিয়ে কেউ জানতে পারবে না, কে ওই রাজনৈতিক দলগুলোকে সহায়তা করছেন। সুতরাং টাকার বিনিময়ে সুবিধা পাওয়ারও প্রশ্ন নেই। বিরোধীরা বলা শুরু করলেন, এতে আরও দুর্নীতি হবে, সুতরাং বন্ধ হোক এই ব্যবস্থা। মামলা হলো দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। কেটে গেল ৬ বছর, আদালত মামলাও শোনে না, বিরোধীদের
আপত্তিও বেড়েই চলে।
তারপরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ সদস্যের একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ সেই মামলা শোনে। বেশ কিছুদিন রায়দান স্থগিত রাখে। তারপরে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই ‘নির্বাচনী বন্ড’-কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে আদালত এবং এসবিআই অর্থাৎ স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, যার মাধ্যমে এই বন্ড কেনাবেচা হয়েছে, তাদের আদেশ দেয় অবিলম্বে কারা এই বন্ড কিনেছেন এবং কারা তার গ্রহীতা, তা প্রকাশ করতে হবে। নানা টালবাহানার পরে অবশেষে এসবিআই সেই নাম দুটো ভিন্ন খামে, আলাদা করে জমা দেয়। নির্বাচন কমিশন আদালতের নির্দেশ মেনে তাদের ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশ করে।
এবার শুরু মজা! নামের তালিকা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নানা বিশ্লেষণে ভয়ঙ্কর কিছু তথ্য প্রকাশ পেতে থাকে। যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে ২০১৮ সালের মার্চ থেকে ২০১৯ এপ্রিল অবধি তথ্য অবশ্য সামনে আসেনি কিন্তু তারপরেও যা তথ্য এসেছে তা দেখে নিশ্চিত বলা যায়, ‘নির্বাচনী বন্ড’ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দুর্নীতি। দেখা যাচ্ছে, বহু সংস্থা এবং বহু ব্যক্তি কোটি কোটি টাকার ‘নির্বাচনী বন্ড’ কিনেছেন।
ফিউচার গেমিং এবং হোটেল সার্ভিসেস নামে একটি সংস্থা, যার মালিক স্যান্টিয়াগো মার্টিন, একাই ১৩৬৮ কোটি টাকার বন্ড কিনেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, এই সংস্থা দৈনিক লটারি সংস্থা। তারা উত্তরপূর্বের বহু রাজ্য এবং দক্ষিণ ভারতের তামিলনাডুতে দৈনিক অনলাইন লটারি বিক্রেতা। ২০১৫ সালে, এই স্যান্টিয়াগো মার্টিনের ছেলে বিজেপিতে যোগ দেন। তার আগে এই সংস্থার সদর দপ্তরে ইডি এবং সিবিআই যায়। তারপরেই দেখা যায়, ফিউচার গেমিং ৭ দিনের মধ্যে ১৩৬৮ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে।
আরেকটি সংস্থার নাম উঠে এসেছে, মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং। সীমান্তে সড়ক এবং পরিকাঠামো তৈরির বরাত পাওয়া এই সংস্থার সঙ্গে আবার টিভি ৯ বলে একটি সংবাদ মাধ্যমের যোগসাজশ রয়েছে। দেখা গেছে তারা ৯৮০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। সামনেই লোকসভা নির্বাচন, সমস্ত গণমাধ্যমেই 'ওপিনিয়ন পোল' চলছে। টিভি ৯-এ স্বাভাবিকভাবেই দেখানো হচ্ছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি নির্বাচনে জিতছে। এই জনমত গঠন করার জন্য মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের টাকা কাজে লাগানো হচ্ছে কি?
তৃতীয় স্থানে আছে বেদান্ত গ্রুপ, যারা ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছে। কীসের জন্য? জল-জমি-জঙ্গল দখল করার জন্য। এছাড়াও আরও বহু সংস্থা আছে যারা ১০০ কোটির ওপরে বন্ড কিনেছে। সুধীর মেহতার টরেন্ট গ্রুপ ১৮৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। ২০১৯ সালে, মহারাষ্ট্রের সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডনবিশ এই সংস্থার ২৮৫ কোটি টাকার সম্পত্তি কর মকুব করেন। বিজেপি তাহলে একটি সৎ দল, তাঁদের নেতারা অত্যন্ত সৎ! মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরের
সরকার ফেলতে যে টাকা একনাথ শিন্ডের বিধায়কদের দিয়েছিল বিজেপি, তা কোথা থেকে এসেছিল, অঙ্ক মেলানো কি কঠিন কোনও কাজ?
আরও পড়ুন- বন্ডে ১,৩৬৮ কোটি টাকার অনুদান কেবল একজনেরই! কী এই ফিউচার গেমিং কোম্পানি?
অনেকে হয়তো আদানি এবং আম্বানির নাম খোঁজার চেষ্টা করেছেন। আদানি কিংবা আম্বানির সংস্থারা কখনই সরাসরি নিজেদের নামে বন্ড কিনবে না। দেখা যাচ্ছে, তাদের সংস্থার সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এই বন্ড কিনেছেন। লক্ষ্মীদাস বল্লভভাই মার্চেন্ট ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ২৫ কোটি টাকা দিয়েছেন নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে। তিনি আবার নিউজ ১৮ সংবাদ সংস্থার মাথা। নিউজ ১৮ রিলায়েন্সের। নিউজ ১৮ চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে, বিজেপি আগামী নির্বাচনে ৪০০ আসন পেতে পারে।
বোঝা যাচ্ছে, দুই ধরনের পদ্ধতিতে টাকা তোলা হয়েছে। এক, টাকা তুলে সরকারি বরাত পাওয়া গেছে। দ্বিতীয়, ইডি এবং সিবিআই পাঠিয়ে, ভয় পাইয়ে তোলাবাজি করে টাকা শুষে নেওয়া হয়েছে। আরও একটি বিষয় এখানে বলা প্রয়োজন। ‘নির্বাচনী বন্ডে’ যে টাকা ভাঙানো হয়নি, সেই টাকা চলে গেছে পিএম
কেয়ারস ফান্ডে, যার কোনও অডিট করা যাবে না বলা আছে। মানে টাকা এদিক দিয়ে না এলেও ওদিক দিয়ে সেই বিজেপিরই তহবিলে জমা পড়েছে। এই সংক্রান্ত খবর খুব দ্রুত প্রকাশ পাবেই। কিন্তু এই আলোচনা কেন বহুল প্রচারিত গণমাধ্যমে হচ্ছে না? কেন ২০১১ সালে কংগ্রেসের দুর্নীতির মতো এই নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতির খবর প্রতিদিনের কাগজে বড় শিরোনাম পাচ্ছে না? সাংবাদিকতার নাম করে বিজেপিকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি?
২০১১ সাল থেকে দুর্নীতি দমনের জন্য, নারী নির্যাতন রোখার জন্য আমরা নিজেরাই একজন ‘মসিহা’ খুঁজেছি। সেই মসিহা অজান্তেই তোলাবাজি চক্রের পাণ্ডা হয়ে উঠেছেন। আমাদের মস্তিষ্কে ডাকাত ঢুকে পড়েছে আসলে। গণমাধ্যমে সারাক্ষণ ঘৃণা ছড়ানো, সারাক্ষণ মিথ্যের বেসাতি দেখতে দেখতে নির্বাচনী বন্ড নামক তোলাবাজি চক্র নিয়ে প্রশ্ন করতে আমরা ভুলে গেছি, বা বলা প্রশ্ন করতে চাইছি না।