আরএসএস, বিজেপি নেতা, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর হাতে ৬২% সৈনিক স্কুল তুলে দিল বিজেপি!

Sainik School Now Run by RSS-BJP Leaders: অন্তত ৬২% সৈনিক স্কুল আরএসএস এবং এর সহযোগী সংগঠন, ভারতীয় জনতা পার্টি ও বিজেপির রাজনৈতিক মিত্রশক্তি, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যুক্ত।

বৃন্দাবনে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শী সাধ্বী ঋতম্ভরা মেয়েদের জন্য একটি স্কুল পরিচালনা করেন, সম্ভিদ গুরুকুলম গার্লস সৈনিক স্কুল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মহিলা শাখা দুর্গা বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা সাধ্বী ঋতম্ভরা রাম মন্দির আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ ছিলেন। গত বছরই এই স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে ষাটোর্ধ্ব গেরুয়া বসন পরিহিতা সাধ্বী ঋতম্ভরা বলেন, “আমরা কলেজে কী দেখি? মেয়েরা মধ্যরাতে সিগারেট খাচ্ছে। মদের বোতল ভাঙছে, বাইকে বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে বসে অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে… আমরা ভাবতেই পারিনা যে ভারতের মেয়েরা এত লাগামহীন হবে। মেয়েরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অপমানজনক রিল পোস্ট করছে। তারা নগ্ন ফটোশুট করছেন। অন্তর্বাস পরে শরীর প্রদর্শন করছে। এই মহিলারা মানসিকভাবে অসুস্থ… এই মেয়েদের কোনও সংস্কার নেই।”

বৃন্দাবনে এই সাধ্বী ঋতম্ভরার গার্লস স্কুল এবং হিমাচল প্রদেশের সোলানে রাজ লক্ষ্মী সম্ভিদ গুরুকুলম সম্প্রতি ৪০ টি স্কুলের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এই স্কুলগুলি সৈনিক স্কুল সোসাইটির সঙ্গে চুক্তি করেছে। সৈনিক স্কুল সোসাইটি হচ্ছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অন্তর্গত এক স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। এবার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেলেই সৈনিক স্কুল পরিচালিত হবে।

২০২১ সালে কেন্দ্র সরকার ভারতে সৈনিক স্কুলগুলি পরিচালনার জন্য বেসরকারি সংস্থাদের ডাক দেয়। সেই বছর কেন্দ্র সরকার ভারত জুড়ে ১০০টি নতুন সৈনিক স্কুল স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। সৈনিক স্কুল সোসাইটির নিয়ম নির্দিষ্ট পরিকাঠামো-জমি, আইটি পরিকাঠামো, আর্থিক সংস্থান, কর্মী ইত্যাদি সম্পন্ন যে কোনও স্কুলই নতুন সৈনিক স্কুল হিসাবে অনুমোদিত হতে পারে। কেন্দ্র সরকারের তথ্য এবং আরটিআই করে পাওয়া তথ্য এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে। দেখা গেছে, এখনও পর্যন্ত চুক্তি হওয়া ৪০টি সৈনিক স্কুলের মধ্যে, অন্তত ৬২% স্কুলই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং এর সহযোগী সংগঠন, ভারতীয় জনতা পার্টি ও বিজেপির রাজনৈতিক মিত্রশক্তি, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যুক্ত।

সরকার সৈনিক স্কুল সোসাইটি বা এসএসএস-এর মাধ্যমে, বার্ষিক ৫০% স্কুল ফি সহায়তা দেয়। ধরা যাক, যে স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস রয়েছে, এসএসএস বার্ষিক সর্বোচ্চ ১.২ কোটি টাকা সাহায্য পাবে সেখানে। এছাড়া দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়াদের আকাডেমিক পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে বার্ষিক প্রশিক্ষণ অনুদান হিসাবে ১০ লক্ষ টাকাও দেওয়া হয়৷

আরও পড়ুন- বাঙালি বিদ্বেষী মোদি-বিশ্বস্ত সঞ্জীব সান্যাল আসলে কে?

দেশে ১৬,০০০ ক্যাডেট থাকার জন্য ৩৩টি সৈনিক স্কুল ছিল যেখানে সৈনিক স্কুল সোসাইটি মূল সংস্থা হিসাবে কাজ করছে। সৈনিক স্কুল সোসাইটি বা এসএসএস প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি এবং ইন্ডিয়ান নেভাল অ্যাকাডেমির জন্য ক্যাডেট তৈরিতে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিগুলি সৈনিক স্কুলগুলির ভূমিকার উপর জোর দিয়েছে। সৈনিক স্কুলের ১১ শতাংশেরও বেশি ক্যাডেট গত ছয় বছরে সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদান করেছে।

আরটিআই অনুযায়ী ২০২২ সালের ৫ মে থেকে ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত ৪০টি স্কুল সৈনিক স্কুল সোসাইটির সঙ্গে মৌ স্বাক্ষর করেছে। এই ৪০টি স্কুলের মধ্যে ১১টি সরাসরি বিজেপির রাজনীতিবিদদের মালিকানাধীন বা তাদের পরিচালিত ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত, অথবা বিজেপির রাজনৈতিক বন্ধুদের মালিকানাধীন। ৮টি স্কুল আরএসএস এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলি সরাসরি পরিচালনা করে। আরও ছয়টি স্কুলের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বা অতি-ডানপন্থী হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অনুমোদিত স্কুলগুলির কোনওটিই খ্রিস্টান বা মুসলিম সংগঠন বা ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বারা পরিচালিত নয়।

অরুণাচলের সীমান্ত শহর তাওয়াংয়ের তাওয়াং পাবলিক স্কুল হচ্ছে রাজ্যে অনুমোদিত একমাত্র সৈনিক স্কুল। স্কুলটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডুর মালিকানাধীন। স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান পেমা খান্ডু। পেমা খান্ডুর ভাই সেরিং তাশি, তাওয়াংয়ের বিজেপি বিধায়ক, তিনি স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

গুজরাতের মেহসানায়, শ্রী মোতিভাই আর. চৌধুরী সাগর সৈনিক স্কুল দুধসাগর ডেয়ারি অনুমোদিত। এর সভাপতি মেহসানার প্রাক্তন বিজেপি সাধারণ সম্পাদক অশোককুমার ভবসাংভাই চৌধুরী। গত বছর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। গুজরাতের আরেকটি স্কুল, বানাসকান্থার বানাস সৈনিক স্কুল, বানাস ডেয়ারির অধীনে গালবাভাই নানজিভাই প্যাটেল চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত। যার নেতৃত্বে রয়েছেন থারাদের বিজেপি বিধায়ক এবং গুজরাত বিধানসভার বর্তমান স্পিকার শঙ্কর চৌধুরী।

উত্তর প্রদেশের ইটাওয়ার শকুন্তলম ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটি মুন্না স্মৃতি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত, এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যার সভাপতি হচ্ছেন বিজেপি বিধায়ক সরিতা ভাদৌরিয়া৷ তাঁর ছেলে, আশিস ভাদৌরিয়া, যিনি স্কুলের কার্যক্রম বিষয়টি দেখাশোনা করেন। দেখা গেছে, এই নতুন পিপিপি মডেল থেকে বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি নেতারাও উপকৃত হয়েছেন।

হরিয়ানার রোহতকের শ্রী বাবা মস্তনাথ রেসিডেন্সিয়াল পাবলিক স্কুল এখন একটি সৈনিক স্কুল। প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ মহন্ত চন্দনাথ এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজস্থানের তিজারার বর্তমান বিজেপি বিধায়ক মহন্ত বালকনাথ যোগী স্কুলের পরিচালনা করছেন।

মহারাষ্ট্রের নতুন অনুমোদিত স্কুলগুলির মধ্যে রয়েছে আহমেদনগরের পদ্মশ্রী ডক্টর বিঠলরাও ভিখে পাটিল স্কুল। এর সভাপতি প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক রাধাকৃষ্ণ ভিখে পাটিল যিনি ২০১৯ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। রাজস্থানের সিকার জেলা বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি হরিরাম রানওয়া পরিচালিত ট্রাস্ট ভারতীয় পাবলিক স্কুলের পরিচালনা করে। সাংলিতে সৈনিক স্কুল হওয়া এসকে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল সদাভাউ খোট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০১৪ সালে দেবেন্দ্র ফডনবিশে নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র সরকারের মন্ত্রী ছিলেন তিনি। মধ্যপ্রদেশের কাটনিতে, সিনা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল সৈনিক স্কুলের অনুমোদন পেয়েছে যার প্রধান, নিধি পাঠক। নিধি মধ্যপ্রদেশের বিজেপি বিধায়ক সঞ্জয় পাঠকের স্ত্রী।

বিজেপি ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠীর ফাউন্ডেশন পরিচালিত একটি স্কুলও সৈনিক স্কুল হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশের নেলোর জেলার আদানি ওয়ার্ল্ড স্কুলও সৈনিক স্কুল হিসেবে অনুমোদিত। স্কুলটি কৃষ্ণপত্তনম বন্দরের কাছে অবস্থিত। এই বন্দর আদানি গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত। স্কুলটি আদানি কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট ফাউন্ডেশনের মালিকানাধীন।

শুধু বিজেপি নেতারা নন, বেসরকারি সৈনিক স্কুলগুলি চালানোর আদেশ পেয়েছে আরএসএস প্রতিষ্ঠান এবং এর সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকটি হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীও। বিদ্যা ভারতী অখিল ভারতীয় শিক্ষা সংস্থা (বিদ্যা ভারতী) হচ্ছে আরএসএস-এর শিক্ষা শাখা। ভারত জুড়ে বিদ্যা ভারতী স্কুলগুলির অন্তত ৭ টি সৈনিক স্কুলের অনুমোদন পেয়েছে - তিনটি স্কুল বিহারে এবং মধ্যপ্রদেশ, পঞ্জাব, কেরল এবং দাদরা ও নগর হাভেলিতে অবস্থিত একটি করে স্কুল। আরএসএস-এর সমাজসেবী শাখা, রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতীর একটি সহযোগী সংগঠন ভৌসাহব ভুসকুটে স্মৃতি লোক ন্যাস স্কুল পরিচালনাকারী দলের অংশ। হোসাঙ্গাবাদে তাদের স্কুল, সরস্বতী গ্রামোদয় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সৈনিক স্কুলের অনুমোদন পেয়েছে।

ইতিহাসের পুনর্লিখন এবং মুসলিম বিরোধী পাঠ্যক্রমের জন্য বিদ্যা ভারতী সুপরিচিত। ১৯৭৮ সালে আরএসএস বিদ্যা ভারতী প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে এটির অধীনে ১২,০৬৫টি স্কুল রয়েছে, ৩,১৫৮,৬৫৮ জন পড়ুয়া রয়েছে। সম্ভবত ভারতের বেসরকারি স্কুলের বিশাল নেটওয়ার্কগুলির মধ্যে এটি একটি। বিদ্যা ভারতীর লক্ষ্যই হলো, "হিন্দুত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং দেশপ্রেমের উদ্দীপনায় উদ্বুদ্ধ তরুণ প্রজন্ম গড়ে তোলা।"

আরও পড়ুন- ভোটে হারার ভয়েই কর সন্ত্রাস? ভয়াবহ অভিযোগ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে

সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোসাইটি পরিচালিত নাগপুরের ভোনসালা মিলিটারি স্কুলকেও সৈনিক স্কুল হিসাবে পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। স্কুলটি ১৯৩৭ সালে হিন্দু ডানপন্থী মতাদর্শী বি.এস. মুঞ্জে দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। ২০০৬ সালের নান্দেদ বোমা বিস্ফোরণ এবং ২০০৮ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণের তদন্তের সময়, মহারাষ্ট্র অ্যান্টি-টেরর স্কোয়াড ভোনসালা মিলিটারি স্কুলে তদন্ত চালায়। বিস্ফোরণে অভিযুক্তদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এই স্কুলেই।

আরও বেশ কয়েকটি হিন্দু ধর্মীয় ট্রাস্ট সৈনিক স্কুল চালানোর অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হিন্দুত্ববাদী নেত্রী সাধ্বী ঋতম্বরার দু'টি স্কুলও। লিবারহান কমিশন যখন অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তদন্ত করে, ঋতম্ভরা সহ ৬৮ জনের বিরুদ্ধে দেশে 'সাম্প্রদায়িক বিরোধ' ছড়ানোর প্রমাণ মেলে। ঋতম্ভরা সংঘ পরিবারের উল্লেখযোগ্য মুখ এবং বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতার ঘনিষ্ঠ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বৃন্দাবনে যান।

হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রের শ্রীমতী কেশরী দেবী লোহিয়া জয়রাম পাবলিক স্কুলের মালিক ভারত সাধু সমাজের (BSS) জাতীয় সহ-সভাপতি। গুজরাতের জুনাগড়ের শ্রী ব্রহ্মানন্দ বিদ্যা মন্দির ভগবতীনন্দজি এডুকেশন ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত, যার ম্যানেজিং ট্রাস্টি মুক্তানন্দ ‘বাপু’ ২০১৯ সাল থেকে ভারত সাধু সমাজের সভাপতি ছিলেন। কেরলের এর্নাকুলামের শ্রী সারদা বিদ্যালয় আদি শঙ্করা ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত।

More Articles