নয়ের দশকের স্মৃতি ও একটি সমকামী ভালবাসার পরিণতি

একের পর এক সিনেমাসুলভ জাম্পকাটে রচনা হয় স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর ধরে জনসাধারণের বঞ্চনার, রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি, এক প্রাচীন জনপদের কাহিনি।

উত্তর কলকাতার এক রেলওয়ে কলোনিতে আমার জন্ম। সেখানে বেশিরভাগ গ্রুপ ডি কর্মচারীর বাস। বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে মাঠ, ঝিল, কমিউনিটি হল, বাজার, প্রচুর গাছ, বিশাল সব ছাদ ও কান ঘেঁষে সাপের মতো দূরে চলে যাওয়া ট্রেনলাইন। জ্ঞান হওয়া থেকে পরবর্তী ১৭ বছর এই ছিল পৃথিবী। ঝাঁ চকচকে কলকাতা এই জগৎ থেকে বহু দূরের অন্য কোনও এক গ্রহ। বর্ষায় সবুজ ঘাস ডোবা জলে ভেসে যাওয়া ফুটবল লাথাতাম দেদার! মে মাস থেকে ছাদে আস্তানা গেড়ে ঘুড়ি লাট খাওয়ানোর আর্টে দিতাম মন। সন্ধে নামলেই পাড়ায়-পাড়ায় লাল মিছিল মার্চ করত। যেন আমরা আছি, এইটুকু জানান দিতেই তাদের হানা। আমাদের মতো ছোটদের লাভ হতো ভোটের দিন, পাড়ায় কংগ্রেস এবং বামপন্থী দলের বুথ থেকে বিরিয়ানি ও লুচি-আলুর দম খেয়ে। পড়াশোনা হবে শুধু পরীক্ষার একমাস আগে। তার চেয়ে বরং আনন্দের গরমকালে লোডশেডিংয়ের রাত, মাঠে, মাদুরে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো ভেসে যাওয়া মেঘেদের দিকে চেয়ে কল্পনায় মেতে থাকা। স্কুলে নক্ষত্র চিনতে শেখামাত্রই রাতের আকাশে এক এক করে মিলিয়ে নেওয়ায় মনোনিবেশ করি। কালপুরুষকে চিনে নেওয়ার সময় তখনই। অপুকে চিনব তার অনেকগুলো বছর পরে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ে জানতে পারি, কালপুরুষের প্রেমে মজলে ঘরছাড়া হতে হয়। "যারা কালপুরুষকে ভালবাসে তাদের কি হয় জানিস?- ঘরছাড়া হতে হয়।" মন্টুকেও হতে হবে একদিন ঘরছাড়া; কালপুরুষকে চেয়ে!

‘নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি’ পড়ার সময় চেনা চরিত্রর ভিড়ে মন্টুকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি। কয়েকটা মুখ ভেসে এল চোখের সামনে, যারা মন্টুর মতোই ঢলে পড়েছিল মৃত্যুর কোলে। না! তারা কেউই মন্টুর মতো আদর্শবাদী নয়। আসলে নয়ের দশকে আদর্শহীনতার ঘুণপোকা সমাজকে এতটাই ফাঁপা করে ফেলেছিল যে, এইসব চরিত্ররা সংখ্যালঘু হয়ে উঠছিল। তাদের জায়গায় ধীরেসুস্থে জাঁকিয়ে বসছিল কথায়-কথায় ‘বুর্জোয়া’ উচ্চারণ করা চাটুজ্জেমশাইদের দল, শ্রেণিসংগ্রামের বুলি ঝেড়ে যারা নিজেদের ধীরেসুস্থে গুছিয়ে নিচ্ছিল। গঙ্গার পাশ থেকে বয়ে চলা এক প্রাচীন জনপদে ঘনঘোর এক বর্ষার রাতে এই উপন্যাসের মূল চরিত্র কিংশুকের জন্ম। এরপর পাতার পর পাতাজুড়ে সে কখনও ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে, কখনও গঙ্গায় নৌকায় ভেসে, আবার কখনও মর্গে লাশের পাশে দাঁড়িয়ে খুঁজবে অন্ধকারে আলোর উৎস। মর্গের অন্ধকারে তখন শুয়ে এই প্রাচীন জনপদে জন্ম নেওয়া বীরগাথার নায়ক মন্টু সরকার। ধনুকধারী কালপুরুষের পিছে ছুটে চলা মন্টু খোদ তীরসজ্জায় শায়িত। আশ্চর্য সমাপতন!

এই লেখার বুনন উপন্যাস কম, সিনেমা বেশি। ঘন ঘন ফ্ল্যাশব্যাক সিনেমা হলের পর্দায় ফুটে উঠতে থাকে। উপন্যাসের শুরুতেই একটা থ্রিলার হয়ে ওঠার সব লক্ষণ উপস্থিত ছিল। কিন্তু লেখকের ভাষায় বর্ণনা করতে চাইলে লিখতে হয়, গল্পের ধরাবাঁধা সূত্রপাত, লোমহর্ষক বিচিত্র বুনন নিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার কোনও গরজ নেই তার। অথচ অনায়াসে হয়ে উঠতে পারত এই বাংলা বাজারে ডিমান্ডিং সাসপেন্স থ্রিলার! বা মফসসলি টিন-এজ প্রেমের এক মিষ্টি উপন্যাস! এগুলো কিছুই হলো না। ঠিক যেমন মন্টু কবি না হয়ে হল অন্ধকার দুনিয়ার রাজপুত্র।

আরও পড়ুন: দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবন, যাদের ছবি ধরা রইল না ক্যামেরার লেন্সে

একের পর এক সিনেমাসুলভ জাম্পকাটে রচনা হয় স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর ধরে জনসাধারণের বঞ্চনার, রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি, এক প্রাচীন জনপদের কাহিনি। যে কাহিনি পাতার পর পাতাজুড়ে একফোঁটা স্বস্তি না দিয়ে অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন করে। সমাজকে অস্বস্তির মুখে দাঁড় করিয়ে বলে চলে এক সমকামী, নিঃস্বার্থ প্রেমের কাহিনি। লেনিনের বক্তৃতা সংকলনকে সাক্ষী রেখে দুই পুরুষ দেহের মিলন! উদার অর্থনীতির জোয়ারে নিজেদের গায়ে সুগন্ধি স্প্রে করে মগ্ন হয়ে চেয়ে থাকি সুউচ্চ অট্টালিকাদের দিকে। একদিন এরকমই এক জায়গায় একের পর এক গুলি বুক চিরে চলে যাবে মন্টুকে। আসলে মন্টুদের চলে যেতে হয়। যেমন আজকের পৃথিবীতে হুলোর মতো রূপকথার চরিত্রদের হতে হয় নিরুদ্দেশ!

কিছু লেখা পড়ে নিজেদের গরজে উত্তরের সন্ধান করতে হয়। এই বই সেই গোত্রের। এখানে উত্তরের তোয়াক্কা না করে লেখক একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। প্রয়োজনে পাঠক নিজের গরজেই তার সন্ধান হয়তো করবে। লেখকের আগের লেখা বইগুলো অপেক্ষা এই লেখা সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের। মেখলা ভট্টাচার্যর আঁকা ছবি কল্পনার ঘোড়াকে দুরন্ত গতিতে ছোটায়। বইজুড়ে ভেসে আসে কেওকারপিন তেলের হালকা সুগন্ধ।

 

'নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি'

কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মেখলা ভট্টাচার্য

সুপ্রকাশ

মূল্য: ২৮০

 

 

More Articles