বিসর্জনের পর শূন্য বেদির বিষাদ, পুজোর সঙ্গে বাঙালির আবেগ এইভাবেই মিশে আছে এখনও
তপন সিংহ যে গ্রামে ছোটবেলা কাটিয়েছেন, সেই গ্রামটি বিহার, বীরভূম আর মুর্শিদাবাদের সীমান্ত। সেই গ্রামে পুজোর খবর বয়ে আনতেন তাঁদের ‘গোপালদা’।
সপ্তমী অষ্টমী তিথি
হোক মায়ের নিতি নিতি
কাল হবে বিজয়া দশমী গো
ও দুষ্কনাশিনী
মা নাকি যাবে কৈলাসে গো
ও দুষ্কনাশিনী।
...
চণ্ডীমণ্ডপ থেকে দেউড়ির বড় দরজা দিয়ে যখন আমাদের বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য বাইরে আনা হত, গ্রাম্বাসীরা সমস্বরে এই গানটি গাইত। বিসর্জন হত আমাদেরই একটি পুকুরে। নাম ‘সিদাগড়’। এর মানে জানা নেই। কোনও পূর্বপুরুষ নাম দিয়েছিলেন কিনা তাও জানি না। প্রতিমা বিসর্জন হয়ে গেলে আমরা সবাই শূন্য বেদির নিচে বসতাম। তখন আমার বয়স ছ-সাত বছর। প্রত্যেকের জন্য একটি শরের কলম আর দোয়াত থাকত। মা সাজিয়ে রাখতেন। মাটিতে বসে আমরা লিখতাম—
গনেশ গিরিজা কৃষ্ণচন্দ্রাদিত্য মহেশ্বর,
পিতা গুরু পরম ব্রহ্ম চিত্রগুপ্ত নমোস্তুতে।
মা আকাশের দিকে হাত দেখিয়ে বলতেন, ওই দ্যাখ। হাঁদার মতো দেখতাম। সাদা সাদা অনেক মেঘের ভেলা চলেছে। বলতেন, পুজো আসছে বুঝতে পারছিস না?
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখছেন তপন সিংহ। বর্ষার প্রায় শেষ। পুজো আসব আসব করছে। মাঝেমধ্যেই ঘোর নীল আকাশের মাঝে ছেঁড়াখোঁড়া ফেনা মেঘ। তার সঙ্গে তীক্ষ্ণ রোদ। ভাদ্র মাস পড়বে আর ক'টা দিন পরেই। এমন দিনে মনকেমন লেগেই থাকে। দুর্গাপুজো হোক বা ইদ, বাঙালি উৎসবপ্রিয়। যদিও বছর বছর উৎসবের রং ফিকে হচ্ছে, তবু একদিন না একদিন সেই স্বপ্নের উৎসবের স্বাদ পেয়েছে প্রত্যেকেই। বয়সের জন্য হোক, অর্থনীতির জন্য হোক কি সমাজনীতির জন্যই হোক, বাঙালি মধ্যবিত্তর অতীতে একটা সেরা উৎসব থাকবেই। তপন সিংহও তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর শরীরে আবার ‘লর্ড সিন্হা’ পরিবারের রক্ত বইছে।
তপন সিংহ যে গ্রামে ছোটবেলা কাটিয়েছেন, সেই গ্রামটি বিহার, বীরভূম আর মুর্শিদাবাদের সীমান্ত। সেই গ্রামে পুজোর খবর বয়ে আনতেন তাঁদের ‘গোপালদা’। গোপাল বৈরাগী। পুরুষানুক্রমে তাঁদের বাড়ির ঠাকুর তৈরি করত গোপাল বৈরাগীরা। তাঁর কাজের কিছু বিশেষ ভঙ্গিমা ছিল। গোপাল বেছে বেছে কয়েক আঁটি খড় রাখত চণ্ডীমণ্ডপে। তারপরে দড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বিগ্রহের একটা অবয়ব আনত। ছোট্ট তপন আর তাঁর বোন গীতা বসে বসে হাঁ করে দেখতেন সেইসব কাণ্ডকারখানা। খড় বাঁধতে বাঁধতে গুনগুন করে সারাক্ষণই গান করতেন গোপাল। সে কতরকম গান! তার মধ্যে একটি, ‘মুন বলে মুনের কথা জানি না’, খানিক ঝেড়েবেছে 'হারমোনিয়াম' ছবিতে সেই গান ব্যবহারও করেছিলেন তপন পরবর্তী কালে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর অরুন্ধতী দেবী সেই গান গেয়েছিলেন।
খড়ের ওপর দড়ি দিয়ে সরস্বতীর কাঠামো করত গোপালের ছেলে বটা। তার একখানা চোখ ছিল না। ঠিক তখনই মাস্টারমশাই পড়তে ডাকতেন তপনদের। গীতা তখন বছরচারেকের। সেই ডাকে গুটিগুটি সে তো সোজা বাড়ির ভেতর স্লেট-বই আনতে চলে যেত। তপন খুব বিরক্ত বিরক্ত ভাব করে তাকাতেন মাস্টারমশাইয়ের দিকে। এই এত সুন্দর হাতের কাজ ছেড়ে নীরস পড়াশোনা? মাস্টারমশাইকে কোঁচকানো ভুরু খানিক দেখিয়ে যেতেন মায়ের কাছে। "আমাদের কি পুজোর ছুটি হবে না মা?" সেই যাত্রাপালার মতো গলাকে মোতেই পাত্তা দিতেন না মা। কাজেই বাধ্য হয়ে, বইখাতা বগলে মাস্টারমশাইয়ের মুণ্ডপাত করতে করতে পড়তে যাওয়া।
সেসময় তাঁদের বাড়িতে গোটাচল্লিশ লোক থাকত। সবার দেখাশোনা করতেন তপনের মা নিজে। বাড়ির দণ্ডমুণ্ডর কর্ত্রী তিনি। সবাইকে বেলা বারোটার মধ্যে খাইয়ে দিতেন। কাজের লোকদের খাওয়া শেষ হতে হতে একটা। তারপরে সোজা ওপরে গিয়ে ‘ভারতবর্ষ’ বা ‘প্রবাসী’ পড়তেন। গাঁয়ের মেয়েদের মধ্যে ‘আধুনিক’ হাওয়া আনার চেষ্টা করতেন। বাড়ির যারা কলেজে পড়ত, ছুটিতে তারা দেশে এলে তাদের দিয়ে রাজবংশী পাড়াতে নাইট স্কুল চালাতেন। কারও বাড়িতে উনুন না জ্বললে, সেদিন তপনদের বাড়ি থেকে খাবার যেত তাদের জন্য। বৈশাখের গরম হোক, ভাদ্রের গরম হোক– ছাদে শোয়ার একটা আলাদা মজা ছিল। সেই তারাভরা আকাশের নিচে শুয়ে মা তপনের গোপাদিকে গান শেখাতেন– ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই / নিভে যায় বারে বারে—।' আরেকটু বড় হলে তপন নিজেও গান শিখেছিলেন, 'কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না’। মাস্টারমশাই গীতাকে গান শেখাতেন, আর শুনে শুনে সেইসব তুলে ফেলতেন তপন।
গোপাল বৈরাগী গুণগুণ করতে করতে গান করতেন, আর গীতা সমানে প্রশ্ন করে যেত তাঁকে। শেষমেশ অতিষ্ঠ হয়ে গোপাল বলতেন, কাজের সময় কথা বললে প্রতিমার গড়নে খুঁত থেকে যাবে। ফের মাস্টারমশাইয়ের ডাক। অবাক কাণ্ড! এবার তাঁর হাতে টিনের ছোট বাক্স, বাইরে যাওয়ার জামাকাপড়। বাড়ি যাচ্ছেন মাস্টারমশাই। ছাত্রছাত্রীর মাথায় সস্নেহে হাত রেখে বলতেন, তোমাদের দেড় মাস ছুটি। বছরে একবার পুজোর আগে ছুটি নিতেন মাস্টারমশাইও। বাড়ি থেকে ফিরতেন সেই ভাতৃদ্বিতীয়ার পরে। পুজোর আনন্দের সঙ্গে তাঁদের ছুটির আনন্দ তখন মিশ খেয়ে গিয়েছে। গোপাল বৈরাগীর হাতে প্রতিমায় দু'-মাটির প্রলেপ লাগার পর কলকাতায় রওনা হয়ে যেতেন তপনের বাবা। জওহরলাল-পান্নালাল থেকে বাড়ির সব্বার পুজোর জামাকাপড় আসবে। ফিরতেন পুজো সঙ্গে নিয়েই। তারপর মুসলমান পটুয়ারা আসত প্রতিমা রং করতে। ওঁরাও বংশপরম্পরায় তপনদের বাড়ির প্রতিমা রং করে আসছেন। যে ক'টা দিন কাজ, তপনদের বাড়ির ভেতরেই খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত হত ওঁদের। প্রথমে প্রতিমার গায়ে সাদা রং চড়ত। আট-দশটা নারকেলের মালায় গোলা হতো নানা ধরনের রং। ধীরে ধীরে সেইসব রঙে রাঙিয়ে তোলা হতো প্রতিমাকে। প্রতিমার চক্ষুদান হতো সবার নজরের আড়ালে। কাউকেই দেখতে দিতেন না সেসময় পটুয়ারা। বাঁহাতে একটা কেরোসিনের লম্ফ ধরে ডানহাতে খুব মন দিয়ে চোখ আঁকতেন তাঁরা। তারপর সাদা নতুন কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। চোখ আঁকার পর নাকি খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ বসে থাকতেন পটুয়ারা।
এরপর আঁকা হতো চালচিত্র। রাত আটটা নাগাদ চালচিত্রের ওপর সরু সরু দাগ টানা হতো প্রচুর। নানা রঙের সে দাগ। পরদিন দেখে তাক লেগে যেত সেই চালচিত্র। প্রতিপদের দিন সন্ধ্যায় ঢুলি আসতেন তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে। নাম তাঁর মহাদেব। ঢোলের বোলে নিজেদের আগমন বার্তা রাষ্ট্র করে আসাটাই ছিল তাঁর অভ্যেস। আগমনীতে প্রথমটা সশব্দে প্রচণ্ড হুংকার, তারপর চাপা চারমাত্রার বিভিন্ন সব ছন্দ। কাঠি আর হাতের ফাঁকে বোল ছুটছে হাত থেকে। খুব উপভোগ করতেন ছোট্ট তপন। প্রায় সেই সময়েই রামপুরহাট থেকে পুরোহিত রাখহরি এসে পৌঁছতেন। তিনি থাকতেন কালীপুজোর শেষ পর্যন্ত। গোটা মাসটা দুপুরে মাছ ধরে কাটাতেন। পঞ্চমী থেকে আসতে শুরু করতেন আত্মীয়-পরিজনরা।
দুর্গার স্তব শুনে কিশোর তপনের মনে হতো, এত 'দাও, দাও' কেন!
যশ দাও, ধন দাও! সারাটা স্তব শুধু দাও আর দাও! সাহস করে সে কথা কাউকে বলতে পারতেম না। মনের প্রশ্ন মনেই থেকে যেত।
পুজোতে তাঁদের বাড়িতে এককালে নাকি বলিদানের রেওয়াজ ছিল। কিন্তু মায়ের অনুরোধে বাবা বলিদান বন্ধ করে দেন। সে তপনের জন্মের অনেক আগেই। গঞ্জনা তাঁকে কম শুনতে হয়নি এজন্য। সেই বলিদানে চিহ্ন কিছু রয়ে গিয়েছিল। দেওয়ালে সারি সারি খাঁড়া ঝুলত। নানা আকারের কোনওটা মোষবলির, কোনওটা পাঁঠাবলির। এদিকে মহাদেবদার ঢোলের বোলের সঙ্গে কাঁসি বাজাতেন ছোট্ট তপন। তাঁর জন্য বহরমপুর থেকে একটা ছোট কাঁসি আনিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মহাদেবদাই তাঁকে বাজাতে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। অনেকদিন পরে, ভাগলপুরে পড়ার সময় একবার বাড়ি পৌঁছলেন ঠিক আরতির সময়। কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে চুপি চুপি কাঁসর বের করে বাজাতে শুরু করলেন। সেই আওয়াজ শুনে তাঁর মা বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে, মুখে স্নেহের হাসি। বললেন, শুনেই বুঝেছি তুই এসে গিয়েছিস।
দেখতে দেখতে পার হয়ে যেত সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী। প্রত্যেকটা বছর। তপন সিংহর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণে বারবার ঘুরেফিরে এসে গিয়েছে এই পুজোর কথা। নিজেই বলেছেন,
সম্ভবত এটা বাঙালি হওয়ার দুর্বলতা। তবে এই পুজোর অনুষঙ্গেই যে আমি অনেক কিছু চিনেছি, বুঝেছি, তা অস্বীকার করব কী করে। মানুষ বোধহয় সেইটুকুই রাখে যা থাকে।
পুজো এলেই তাঁর বাবার বয়স যেন কুড়ি বছর কমে যেত। মা এই সময়টা সবথেকে বেশি হাসিখুশি থাকতেন। বিসর্জনের পর একটা নিশ্চল বিরাট শূন্যতা যেন গিলে ফেলত গোটা বাড়িটাকে।
সবাই আছে, সবকিছু আছে, অথচ কিছুই যেন নেই। পূজা বেদির শূন্যতা বড় বেদনাদায়ক। সবার আড়ালে চোখ মুছতেন বাবা। ঐ কান্না যেন জীবন সম্পর্কে কিছু বোঝাতে চাইত।
'মনে পড়ে'
তপন সিংহ
আনন্দ পাবলিশার্স
মূল্য: ১৫০