রান্নার মশলা টিকে থাকবে বছরের পর বছর! শার্ক ট্যাঙ্কে দুই ভাইয়ের যে প্রযুক্তি ঝড় তুলল
Zoff Spices in Shark Tank India : এই প্রযুক্তি আর কাজ ভারতের মশলা ব্যবসা জগতের ছবিটাকেই সম্পূর্ণ বদলে দেবে, এমনটাই মনে করছেন আমান।
ভারতের প্রতিটি ঘরে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক, একটি জিনিস সবসময় রাখা থাকবে। মা-মাসিদের অত্যন্ত কাছের জিনিস, বলা ভালো ‘আসল হাতিয়ার’। আর কিছু নয়, সামান্য মশলার বাক্স। হলুদ, নুন, লঙ্কার গুঁড়ো থেকে জিরে, মরিচ - যুগ যুগ ধরে অজস্র মশলা আমাদের হেঁশেলের সঙ্গী হয়েছে। একেকটির ছোঁয়ায় যেন খাবারে ম্যাজিক তৈরি হয়। বহু বছর ধরে ভারতীয় খাবারে জুড়ে রয়েছে এই মশলার সিলসিলা। ঠিক যেন সাত জন্মের বন্ধন!
ভারত আর মশলার এই সম্পর্ক আজকের নয়। পুরনো শাস্ত্রে এমন বহু মশলার নাম রয়েছে, যা আমরা আজও ব্যবহার করি। একটা সময় এগুলি এতই মূল্যবান ছিল যে, রাজা-রাজড়া কিংবা ধনী ব্যক্তি ছাড়া কেউ সেভাবে ব্যবহার করতে পারতেন না। এই মশলাগুলির ছোঁয়াতেই শাহী গন্ধে ভরে উঠত সেই বাড়ি। সাধারণের হাতের নাগালে তেমন ছিল না এসব। এখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলেছে। একটা সময় যা ছিল কার্যত সোনার মতো, সেগুলিই আজ বাড়ি বাড়ি ছড়িয়ে আছে।
কিন্তু সমস্যা একটাই। জিরে হোক বা লঙ্কার গুঁড়ো, কিংবা গরম মশলা – সবই উদ্ভিদ থেকে আসছে। কোনওটা গাছের ছাল, কোনওটা আবার বীজ থেকে তৈরি হচ্ছে। একেকরকম মশলার উপকারিতাও একেক ধরনের। গোটা থেকে গুঁড়ো – সবেতেই ছেয়ে রয়েছে আমাদের মশলার সাম্রাজ্য। আর সেসব যে উপকারী- তা তো প্রায় অনেকেই জানেন। কিন্তু যে কোনও জিনিসেরই একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে। একটা সময় পর নষ্ট হয়ে যায়, ফেলে দিতে হয় সেই সামগ্রী। মশলাও ঠিক তেমনই। বহু বছর ধরে একটানা ব্যবহারও করতে পারবেন না। আর গোলমরিচ থেকে দারুচিনি, প্রত্যেকের প্রধান উপকরণ হল তার ভেতরে থাকা তেল। সেই ‘এসেনশিয়াল অয়েল’-এই থাকে আসল উপাদান। সেটিও একটু গরম পেলেই হাওয়া হয়ে যায়। ফলে সমস্যায় পড়তে হয় আমাদের মা-মাসিদের।
আর এই সমস্যাকেই তুলে ধরেছেন আকাশ আর আশিস আগরওয়াল। এই দুই ভাইয়ের নাম কি একটু চেনা চেনা লাগছে? ইতিমধ্যেই যারা শার্ক ট্যাঙ্ক ইন্ডিয়া দেখেছেন, প্রতিদিন ফলো করেন এই অনুষ্ঠান, তাঁরা অবধারিত শুনেছেন এঁদের কাহিনি। শুনেছেন ‘জোফ’-এর (ZOFF) কথা, যে সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা আকাশ আর আশিস। ZOFF মানে জোন অফ ফ্রেস ফুড। তাঁদের নতুন প্রযুক্তি কার্যত চমকে দিয়েছে ‘শার্ক’ উদ্যোগপতিদের। বোটের (Boat) প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোগপতি আমান গুপ্তা এগিয়ে এসেছেন এই কাজে। ১.২৫ শতাংশ ইকুইটির বদলে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আকাশ-আশিসের এই প্রযুক্তি আর কাজ ভারতের মশলা ব্যবসা জগতের ছবিটাকেই সম্পূর্ণ বদলে দেবে, এমনটাই মনে করছেন আমান।
কিন্তু কী প্রযুক্তি? খুব সহজ ভাষায় সেটি বুঝিয়েছেন আকাশ আর আশিস আগরওয়াল। বেশিরভাগ ভারতীয় আসলে কী দেখেন? মশলার গুণমান, রং, স্বাদ। মান যদি ঠিক থাকে, তাহলে কোনও জায়গাতেই কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু এই দুই ভাইয়ের দাবি, ভারতের অধিকাংশ জায়গায় আজও সঠিক, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশলা পেষা হয় না। সাধারণত হামানদিস্তা হোক বা বড় মেশিন, যে কোনও গোটা মশলাকে পিষে পিষে গুঁড়ো করা হয়। এখানেই আসল ভুল করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আকাশ-আশিস। তাঁদের বক্তব্য, মশলার ভেতর আসল উপাদান হল তার এসেনশিয়াল অয়েল বা তেল। মোটামুটি ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই তেলটি একেবারে উবে যায়। আর ভারতের বেশিরভাগ মশলা তৈরির কারখানায় যে মেশিনের মাধ্যমে গুঁড়ো করার কাজটি হয়, সেখানে ১২০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা ওঠে। ফলে মশলার ভেতরে থাকা যাবতীয় ভালো গুণ এক মুহূর্তে শেষ হয়ে যায়। ফলে আর কিছুই থাকে না।
সেইসঙ্গে সামনে আসে প্যাকেজিংয়ের কথা। সাধারণত কার্ডবোর্ডের বাক্সে, কিংবা ২-৩ লেয়ারের প্যাকেটে এই মশলা রাখা হয়। তাতে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আরও বাড়ে। এখানেই পরিবর্তন এনেছে জোফ প্রতিষ্ঠানটি। আকাশ-আশিসের বক্তব্য, তাঁরা কোয়াড লেয়ার অর্থাৎ চার স্তরের অ্যালুমিনিয়ামের প্যাকেট তৈরি করেছেন। সেখানে স্রেফ জিপ লকের মাধ্যমে প্যাকেট আটকানোর বন্দোবস্ত। গোটা প্যাকেজিংয়ের জন্যই ওই মশলাকে আর ফ্রিজে ঢোকাতে হবে না, আলাদা জারেও রাখতে হবে না। শুধু জিপ লক খুলুন আর রান্নায় ঢালুন।
এমন কেন? আকাশ-আশিসের বক্তব্য, মশলায় একটু জল লাগলেই সেটি খারাপ হতে শুরু করে। এমনকী রং, স্বাদও নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্যই বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে আসল জিনিস এটা নয়। সেটি লুকানো আছে মশলা তৈরির টেকনিকে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো হ্যামার মিলের ব্যবহার করে না জোফ। তাদের নতুন এই প্রযুক্তির নাম ‘কুল গ্রাইন্ডিং টেকনোলজি’ (Cool Grinding Technology)।
এতে ঠিক কী হয়? এই দুই ভাইয়ের বক্তব্য, প্রথমে স্রেফ হাওয়ার সাহায্যে গোটা মশলাকে ছোটো ছোটো টুকরো করা হয়। তারপর একটু একটু করে পেষা হয়। এতে তাপমাত্রা ততটা বাড়ে না। ফলে মশলার ভেতরের উপকারী তেলটি একেবারে অটুট থেকে যায়। সেইসঙ্গে স্বাদে, গন্ধেও ভরে ওঠে সেটি। পাশাপাশি বেড়ে যায় টিকে থাকার ক্ষমতাও। আকাশ-আশিসের দাবি, হেসেখেলে অন্তত দেড় বছর একটি মশলার প্যাকেট চালাতে পারবেন আপনি! এতটুকুও নষ্ট হবে না! আর এটা পরীক্ষা নিরীক্ষার পরই সামনে এসেছে।
শার্ক ট্যাঙ্ক এমনিতেই ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। সিজন ১-এর পর এবার সিজন ২-ও শেষের মুখে। অসংখ্য নতুন উদ্যোগপতিদের দেখতে পেল গোটা ভারত। তাঁদের গল্প, লড়াই উদ্বুদ্ধ করেছে আরও অসংখ্য অন্ত্রেপ্রেনরকে। সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশ আর আশিস আগরওয়ালের এই উদ্যোগ প্রশংসা কুড়িয়েছে সকলের।