বাইকে ফুচকা বেচেন বিটেক পানিপুরি ওয়ালি! উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন কি ফুরোচ্ছে তবে?

BTech Pani puri Wali: সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে, বিনিয়োগ করে ফুচকাবিক্রেতা বা চা বিক্রেতা হতে দেখতে চান না কোনও বাবা মা-ই।

যারা সেভাবে পড়াশোনা করেননি, করার সুযোগ পাননি, তাঁদের জন্য সমাজে ধার্য রয়েছে নির্দিষ্ট কর্মবিভাজন। বর্ণাশ্রমের ধারণা থেকে কোনওকালেই ভারতবর্ষ মুক্ত হয়নি। তাই এখনও বেশ কিছু এমন কর্মক্ষেত্র রয়েছে যেখানে প্রথাগত 'শিক্ষিত' যুবসম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নেই। পড়াশোনা করে টাকা রোজগারই শুধু উদ্দেশ্য নয়, টাকা রোজগারের পাশাপাশি কাজের ধরন, পদ ইত্যাদি সামাজিক অবস্থানের নির্ণায়ক বলেই এখনও বিশেষ বিশেষ কাজে বিভাজন স্পষ্ট। পড়াশোনা না করলে কী কী হতে পারে এই বলে বকাবকি করার সময় সন্তানকে অনেকে সেইসব কাজের উদাহরণ দিতে থাকেন। তবে কয়েক বছরে ভারতীয় চাকরির বাজার এই বিভাজনকে লঘু করছে। বড় কোনও সংস্থাতে স্থায়ী নিশ্চিত মাইনের চাকরির বদলে পড়াশোনার উঁচু ডিগ্রি অর্জন করা অনেক মানুষই নিজস্ব নিজস্ব পরিসরে কর্মসংস্থান খুঁজে নিচ্ছেন। উচ্চশিক্ষিত হয়ে চায়ের দোকান দিচ্ছেন, পাইস হোটেল খুলছেন, এই উদাহরণ আর বিরল নয়। এই তালিকাতেই জুড়ে গিয়েছেন তাপসী। তাপসী উপাধ্যায় ২১ বছরের ঝকঝকে স্মার্ট তরুণী। বিটেক করেছেন। তারপর? দিল্লির তিলক নগর মেট্রো স্টেশনের কাছে এখন ফুচকার দোকান খুলেছেন তাপসী৷

তবে যেমন তেমন স্টল তো নয়। 'শিক্ষিত' ও সৃজনশীল মানুষরা এই জাতীয় ফুচকা বা চায়ের স্টলগুলিকেও নানাভাবে পৃথক করে তুলছেন। সে নামেই হোক বা নকশায়। কাজের বিভাজন ঘুচে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু নিজেকে 'স্বতন্ত্র', অন্যদের থেকে ভিন্নভাবে প্যাকেজিং করার তাগিদও বাড়ছে। কারণ এই আনকোরা সম্প্রদায়ের মধ্যেও অজ্ঞাতসারে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। ফলে কলকাতার এম এ করা যুবতীর চায়ের দোকানকে এগিয়ে থাকতেই হবে বেঙ্গালুরুর গ্রাজুয়েট ধোসাওয়ালার থেকে। বিটেক করা ফুচকা বিক্রেতার সঙ্গে অজান্তেই প্রতিযোগিতায় জুড়ে যাচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা স্যান্ডুইচ বিক্রেতা। তাপসী উপাধ্যায়ও স্বতন্ত্র।

আরও পড়ুন- রুটির দোকানের হেল্পার ছিলেন নন্দিনীর বাবা, মেয়ের কাঁধে ভর দিয়েই উড়ান দিচ্ছে পাইস হোটেল

রয়্যাল এনফিল্ড বুলেট মোটরসাইকেল চালান তাপসী। ওই বাইকটিই তাঁর ফুচকার স্টল। নিজেকে ‘BTech পানিপুরি ওয়ালি’ বলে পরিচয় দেন তাপসী। স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, এত পড়াশোনা করে শেষে ফুচকা বিক্রি করছেন কেন? শুধু বর্ণাশ্রম দেখলে তো হবে না, রয়েছে কর্মের লিঙ্গভেদও। ফুচকা বেচা তো 'মহিলা সুলভ' কাজ নয়, তাহলে তাপসী এই পেশায় কেন? কারও কথাতেই কান দেন না ‘BTech পানিপুরি ওয়ালি’।

 
 
 
 
 
View this post on Instagram
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

A post shared by Are you hungry (@are_you_hungry007)

তাপসী উপাধ্যায় জানিয়েছেন, তিনি তাঁর স্টলে তেলেভাজা ফুচকা ব্যবহার করেন না। ফুচকা তৈরি করতে ময়দা বা মিহি আটাও ব্যবহার করেন না। টক জলে কাঁচা ধনে আর জিরেও ব্যবহার করেন না। যে চাটনি তিনি ব্যবহার করেন তা জৈব গুড় এবং তেঁতুল দিয়ে তৈরি। তাপসীর স্টলে বিক্রি হওয়া ফুচকা রাস্তার খাবারের ধারণাকে কিছুটা হলেও বদলেছে। তাপসী স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে খাবার পরিবেশন করেন। শালপাতার বাটিতে তিনি ফুচকা তুলে দেন গ্লাভস পরে। জল ঘাঁটতেও ব্যবহার করেন বড় চামচ। নিজে হাতে সারাক্ষণ পরিষ্কার করেন নিজের স্টল।

আরও পড়ুন- অটোতেই রয়েছে ম্যাগাজিন থেকে ম্যাকবুক, গোটা বিশ্ব এক ডাকে চেনে ভারতের এই অটোওয়ালাকে

তাপসীর এই উদ্যোগকে অনেকে বাঁকা চোখে দেখলেও অভিনন্দন জানানো মানুষের সংখ্যাই বেশি। নিজের কাজের নিজে মালিক হওয়ার এই ধারণাকে পছন্দ করছেন অনেকেই। আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়ার জন্য শুধুই যে চাকরি প্রয়োজন এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছেন অনেকেই। কোনও কাজই ছোট নয় জাতীয় নীতিশিক্ষা শিশুদের দেওয়া হলেও, বাড়ির সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে, বিনিয়োগ করে ফুচকাবিক্রেতা বা চা বিক্রেতা হতে দেখতে চান না কোনও বাবা মা-ই। অথচ চাকরির বাজারের উপর সরকার হাত তুলে নিয়েছে সেই কবেই। বেসরকারি বাজারের প্রতিযোগিতায় আসন কম, প্রতিযোগী অত্যধিক। এমন অবস্থায় অর্থ রোজগারই যদি লক্ষ্য হয়, অন্য কাজে বাধা কী?

অনেকে অবশ্য বলছেন, শিক্ষার লক্ষ্য কোনওদিনই স্রেফ অর্থ উপার্জন নয়, একজন পড়ুয়া সারাজীবন যা শিখছেন সেই শিক্ষা বৃহত্তর ক্ষেত্রে কাজে লাগবে এমনটাই কাম্য। ফুচকা বা চা বিক্রির সঙ্গে কাজের ছোট বা বড় ধারণা জড়িত নেই। কিন্তু এই কাজটির সঙ্গে শিক্ষার অপচয় বিষয়টি জড়িয়ে আছে। বি টেক করে কেউ যদি ফুচকা বিক্রি করেন তাহলে যে শিক্ষা তিনি পেলেন, যে নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের দিশা সেই পড়ুয়ার থেকে পাওয়ার কথা তাতে বড় ফাঁক থেকে গেল। ধীরে ধীরে চাকরির দাবি জানানো বা নিজের শিক্ষাকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর ধারণাটিকেই অপ্রয়োজনীয় করে তোলার 'ট্রেন্ড' হয়ে উঠছে না তো এই ধরনের নিজস্ব ব্যবসা?

More Articles