শুধুই 'কালীঘাটের কাকু'! এসএসকেএমের ছত্রছায়ায় আর কোন কোন প্রভাবশালী?
Kalighater Kaku: তবে শুধুই কি কালীঘাটের কাকু! নাকি এসএসকেএমের ছাতা রয়েছে আরও অনেক সুজয়কৃষ্ণদের মাথাতেই? জানতে চাইল কলকাতা হাইকোর্ট
যার কেউ নেই, তার এসএসকেএম আছে! ইডি-র হাতে গ্রেফতার প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ইডি-র জেরা থেকে বাঁচতে এর মতো মোক্ষম এবং সনাতন অস্ত্র বোধহয় আর দু'টি নেই। না, এ কথায় বিন্দুমাত্র ভুল নেই। আর তা ফের একবার প্রমাণ করে দিয়েছেন নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কালীঘাটের কাকু ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের মামলা। আবারও ভিআইপি ইস্যু নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএম।
এই নিয়ে জল গড়িয়েছে হাইকোর্ট পর্যন্ত। ইতিমধ্যেই এসএসকেএম কর্তৃপক্ষের কাছে এ নিয়ে রিপোর্টও তলব করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। এই মুহূর্তে এসএসকেএম হাসপাতাসে ঠিক কতজন ভিআইপি রয়েছেন, যা গ্রেফতার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, সেই সংখ্যাটা জানতে চেয়েছে শীর্ষ আদালত। পাশাপাশি হাসপাতালে তাঁরা কী কী সুবিধা পাচ্ছেন, তা-ও বিস্তারিত ভাবে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইডি হোক বা সিবিআই। বিপদে-আপদে ভিআইপি অভিযুক্তরা সবসময়েই এসএসকেএম-কে পাশে পেয়েছে। নেতা মন্ত্রী-সহ রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই এসএসকেএমে চিকিৎসা করিয়ে থাকেন। তাতে অবশ্য কোনও ভুল নেই। রাজ্যের পয়লা নম্বর সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএম। বেসরকারি হাসপাতালের বদলে তাতে ভিআইপি-রাও চিকিৎসা করাচ্ছেন, এ বড় আশার কথা। কিন্তু গন্ডোগোল অন্য জায়গায়। সেই ভিআইপিদের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকছে বিভিন্ন নিয়োগ দুর্নীতি ইডি-র হাতে কোণঠাসা হওয়া হেভিওয়েটরাও। যেমন জায়গা পেয়েছেন কালীঘাটের কাকু। নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডি-র হাতে গ্রেফতার হওয়া সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র গত চার মাস ধরে এসএসকেএমে ভর্তি।
আরও পড়ুন: তাঁর কণ্ঠস্বরের খোঁজে হন্যে ইডি! কীভাবে ‘কালীঘাটের কাকু’ হলেন বেহালার সুজয়কৃষ্ণ?
এর মধ্যে আবার গত ৭ ডিসেম্বর রাতে হঠাৎই আইসিইউ-তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সুজয়কৃষ্ণকে। তা-ও আবার এমন একটি বেডে, যা কিনা শিশুদের জন্য বরাদ্দ। গত ১২ ডিসেম্বর আবার তাঁকে এসএসকেএমের হাসপাতালের কার্ডিওলজি কেবিনে ফের ফেরৎ পাঠানো হয়। ইতিমধ্যেই ইডি-র হাতে আসে একটি ফোন কলের ভয়েস রেকর্ডিং। যেখানে একটি কণ্ঠ সুজয়কৃষ্ণের বলে অনুমান ইডি-র। সে নিয়ে প্রমাণ জোগাড় করতেই এসএসকেএমে দৌঁড়য় ইডি-র একটি দল। তবে সেখানে এসএসকেএম-এর এমএসভিপি-র কাছে বাধা পায় ইডি। শেষপর্যন্ত বুধবার মধ্যরাতে এসএসকেএম থেকে বার করে ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সুজয়কে। রাত ৩টে ২০ নাগাদ সেখান থেকে সুজয়কৃষ্ণকে নিয়ে বেরিয়ে আসে ইডি। পৌঁছে দেওয়া হয় এসএসকেএম-এ। কণ্ঠস্বরের নমুনা জমা দিয়েই এদিন কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন সুজয়বাবু। সিঙ্গেল বেঞ্চের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যান তিনি৷ আদালতে তাঁর আইনজীবী বলেন, "সুজয়কৃষ্ণকে এই মামলায় যুক্ত না করেই কণ্ঠস্বর পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যা অনুচিত বলেই মনে করছেন সুজয়ের আইনজীবী। তাঁর দাবি, বিচারপতি অমৃতা সিনহার নির্দেশে সুজয়কৃষ্ণের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু মামলাটি বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষের এজলাসে চলছে। তাই বিচারপতি সিনহা ওই নির্দেশ দিতে পারেন না। সুজয়কৃষ্ণের আইনজীবীর যুক্তির প্রেক্ষিতে ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে গিয়ে নির্দেশনামার কপির জন্য আবেদন করতে হবে। কিন্তু বিচারপতি সিনহার এজলাসে গিয়ে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে সুজয়কে৷ বিচারপতি সিনহা জানান, নির্দিষ্ট সময়েই নির্দেশনামা দেওয়া হবে৷
সুজয়কৃষ্ণের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহকে কেন্দ্র করেই ফের বিতর্কে জড়ায় এসএসকেএম হাসপাতাল। সেই নিয়ে কম জলঘোলাও হয়নি। প্রভাবশালীরা হাসপাতালের বেড দখল করে রয়েছে। যার জেরে চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি এমন দাবি করে সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন রমাপ্রসাদ সরকার নামে এক ব্যক্তি। বৃহস্পতিবার এই সংক্রান্ত মামলার শুনানি ছিল হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের ডিভিশন বেঞ্চে। সেখানেই রমাপ্রসাদের আইনজীবী দাবি করেছেন, এসএসকেএম হাসপাতাল দুর্নীতিগ্রস্ত লোকজনের আশ্রয়স্থল হয়ে গিয়েছে। রাজ্যের যে সব প্রভাবশালী জেলে যাচ্ছেন, যাদেরকেই সিবিআই ইডি জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়, তাঁরা এসএসকেএম হাসপাতালে আশ্রয় নিচ্ছে।
অন্যদিকে, আদালতে ইডির আইনজীবী ধীরজ ত্রিবেদী বলেন, 'বিচারপতি অমৃতা সিনহার নির্দেশে বুধবার সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রকে জোকা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁর ভয়েস স্যাম্পেল গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু তাঁকে ফের এসএসকেএম হাসপাতালে ফেরত আনা হয়েছে।' তাঁর দাবি, সুজয়কৃষ্ণ অত্যন্ত প্রভাবশালী। তাই এসএসকেএম-এ এতদিন ভর্তি সুযোগ পাচ্ছেন।' মামলাকারীর আইনজীবী রমাপ্রসাদ সরকার এবং সুস্মিতা সাহা দত্তের বক্তব্য, "কোনও তদন্তে প্রভাবশালীরা গ্রেফতার হলেই এসএসকেএম হাসপাতালে চলে যাচ্ছেন। হাসপাতাল তাঁদের আশ্রয় কেন্দ্র হয়ে উঠছে। মদন মিত্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও সুজয়কৃষ্ণরা ওখানে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকেন।" মামলাকারীর এই বক্তব্য শোনার পরই এসএসকেএম হাসপাতালের ডিরেক্টরের কাছে এ সংক্রান্ত ব্যাপারে রিপোর্ট তলব করে হাই কোর্ট।
নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র যেভাবে রাজ্যের অন্যতম সরকারি হাসপাতালে ঘাঁটি বেঁধে রয়েছেন, তা দেখে এদিন রাজ্যের কাছে প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন, হাসপাতাল কি এখন প্রভাবশালীদের আশ্রয় দিচ্ছেন? বিচারপতি আরও জানতে চান, "এই মুহূর্তে কত জন প্রভাবশালী ওই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন? ১০ জন হবে? কেন তাঁদের তিন-চার মাস ধরে হাসপাতালে রাখা হয়েছে?" এর পরেই এসএসকেএম কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট৷ বিচারপতির সাফ নির্দেশ, "হাসপাতালে ভর্তি প্রভাবশালীরা কী কী সুবিধা পাচ্ছেন? তাঁদের শারীরিক অবস্থা কেমন? এই সব কিছু রিপোর্টে উল্লেখ করতে হবে। একই সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে, এঁদের তুলনায় অন্য রোগীদের কী কী সুবিধা দেওয়া হয়।"
আরও পড়ুন: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ কালীঘাটের কাকুর গলা? কী রহস্য লুকিয়ে কণ্ঠস্বরে?
এদিকে একদিন আগেই হাইকোর্টের কাছে কালীঘাটের কাকু ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের মেডিক্যাল রিপোর্ট জমা করেছে এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ। সেখানে হৃদ্যন্ত্রে পেসমেকার বসার কথা উল্লেখ রয়েছে। জানানো হয়েছে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির কথাও। মাঝেমধ্যে হৃদ্স্পন্দনে ছন্দপতন ঘটলেও ওষুধের মাধ্যমে তা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে বলে জানানো হয়েছে রিপোর্টে। ৬২ বছরের সুজয়কৃষ্ণ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত। তবে তাঁর রক্তচাপ (১০৬/৭০) এবং নাড়ির স্পন্দনে (৮৮/মিনিট) তেমন কোনও অস্বাভিকতা নেই। ইডি হেফাজতে থাকা সুজয়ের অন্য কোনও গুরুতর শারীরিক সমস্যার কথাও উল্লিখিত হয়নি বুধবারের (৩ জানুয়ারি) ওই রিপোর্টে। তবে ওই রিপোর্ট জানাচ্ছে, সুস্থ থাকার জন্য দিনে ৮ রকমের ওষুধ খেতে হয় সুজয়কৃষ্ণকে। তার সবগুলিই ট্যাবলেট। রক্তের ঘনত্ব ঠিক রাখার জন্য ক্লোপিডোজ়েল, লিপিডের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে অ্যাট্রোভ্যাস্টাটিন, হৃদ্যন্ত্রের গতি ঠিক রাখার জন্য মেটোপ্রোলোল সাক্সিনেট রয়েছে এই তালিকায়। রয়েছে, সুগার এবং অন্য কিছু সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ভোগলিবোস, লিনাগ্লিপ্টিন, ডাপাগ্লিফোজ়িনের মতো ওষুধ। এ ছাড়া বেদনানাশক অ্যাসপিরিন এবং গ্যাসের সমস্যার মোকাবিলায় নিয়মিত প্যান্টোপ্রাজ়োল খাওয়ার কথাও জানানো হয়েছে ওই রিপোর্টে।
তবে শুধুই কি কালীঘাটের কাকু! নাকি এসএসকেএমের ছাতা রয়েছে আরও অনেক সুজয়কৃষ্ণদের মাথাতেই? সে ব্যাপারে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে এসএসকেম কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরেই। তবে তাতে কি আদৌ এই প্রথা বদলাবে! দুর্নীতি মামলায় নাম জড়ালেই এসএসকেএমে আশ্রয় নেওয়ার যে অতিপরিচিত ধারা চলে আসছে রাজ্য এবং রাজনীতিতে, সেই ধারাবাহিকতা কি ভাঙবে আদৌ! প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।