বাহুবলে ব্যারাকপুর দখল করতে পারবেন তৃণমূল-বিজেপি ডেইলি প্যাসেঞ্জার অর্জুন সিং?

Arjun Singh: তৃণমূল-বিজেপি ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করা অর্জুন বিজেপির শীর্ষস্তরের নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁ সখ্যকে কাজে লাগিয়ে এলাকার বন্ধ বা ধুঁকতে থাকা কলকারখানার জন্য অনেক কিছুই করতে পারতেন, করেননি।

আসন্ন লোকসভার ভোটে ব্যারাকপুর কেন্দ্রটি ঘিরে এখন নজর সকলেরই। গত প্রায় পাঁচ বছর ধরেই ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র সংবাদ শিরোনামে। এই কেন্দ্রে ২০০৯ সালের ভোটে যখন সিপিআই(এম) প্রার্থী তড়িৎ তোপদার হেরে যান, শোনা যায়, জেতার আনন্দে শাগরেদদের খাওয়ানোর জন্য যে মটন বিরিয়ানি তাঁর বাড়িতে রান্না হচ্ছিল, সমস্তটাই নাকি ফেলে দেওয়া হয়েঠিল আস্তাকুঁড়ে। 'দাদাবৌদি'-র স্নেহের পরশ, 'কালো স্কর্পিও' (জনান্তিক উবাচ) কেঁদেছিল কিনা কে জানে! তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। গঙ্গার বহমানতা তো কেউ আটকাতে পারেনি।

সেই বহমানতার স্রোতেই ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র ২০২৪-এর লোকসভা ভোটেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে দলের টিকিট বন্টনের সময় তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যারাকপুর আসনটি তাঁর দলেরই ২০০৯-এর ভোটে জায়েন্ট কিলার দীনেশ ত্রিদেবীকেই দেন। সেই সময়ে তৃণমূলে ব্যারাকপুর কেন্দ্রের জন্যে দলীয় টিকিটের প্রত্যাশী ছিলেন ভাটপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিং। যে সভাতে মমতা টিকিট বন্টন করেন, টেলিভিশনে দেখা যায়, সেই সভাতেই তিনি অর্জুনকে ঝাড়গ্রামে ভোটের দায়িত্ব দেন। টেলিভিশনের পর্দায় আমজনতা দেখে, মমতার দেওয়া দায়িত্ব ঘিরে অর্জুন খুব গদগদ চিত্তে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানান।

কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, তার কয়েকদিনের মধ্যেই বিজেপির দিল্লির অফিসে গিয়ে ওই দলে যোগ দিলেন অর্জুন। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ব্যারাকপুর কেন্দ্রের জন্যে দলের টিকিটও পেয়ে গেলেন।

আরও পড়ুন- মুর্শিদাবাদে লাল ঝড় তুলতে পারবেন দলের সেনাপতি সেলিম?

এবারেই শুরু হলো আসল খেলা। ভিনরাজ্য থেকে আসা দীনেশ ত্রিবেদী নিজের কেন্দ্রে খুব একটা সময় দিতেন না। অনেকটা অর্জুনের চোখ দিয়েই তিনি দেখতেন ব্যারাকপুরকে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অর্জুন গোটা ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে উঠে পড়ে লাগলেন। নিজের দলকে প্রতিষ্ঠিত করার দিকে তাঁর কোনও লক্ষ্য ছিল না, লক্ষ্য ছিল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা।

এই সময় গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই রাজনৈতিক ডামাডোল চলছে। পরিবর্তনের জোয়ারে এমনভাবেই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলটিকে তৃণমূলের কব্জায় আনার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্জুন সিংয়ের উপর নির্ভর করলেন, যার জেরে অর্জুন দলের উর্ধ্বে এই এলাকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করলেন। তখনই বাহুবলী নেতা হিসেবে অর্জুন সিংয়ের প্রতিষ্ঠাকে কাজে লাগাল তৃণমূল।এই বাহুবলীকে এইভাবে জায়গা দেওয়া নিয়ে তৃণমূলের মধ্যেই যথেষ্ট বিতর্ক ছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের বিশিষ্ট নেতা বিকাশ বসুর খুন হওয়া নিয়ে অর্জুন সিংহের নাম তার আগে জড়িয়ে ছিল। সেই অভিযোগে দীর্ঘদিন অর্জুনকে কারাবাসও করতে হয়েছিল। পরে অবশ্য আদালত থেকে তিনি সসম্মানে এই মামলা থেকে মুক্তি লাভ করেন।

গোটা ঘটনা ঘিরে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ভিতরে তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই দু'টি বিবাদমান গোষ্ঠী তৈরি হয়ে যায়। আর দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, এই গোষ্ঠী দু'টি বাঙালি আর অবাঙালি জনবিন্যাসে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রয়াত বিকাশ বসুর স্ত্রী মঞ্জু বসুর সঙ্গে অর্জুন সিংয়ের বিবাদ-বিসংবাদ এই এলাকায় প্রথম বাহুবলী রাজনীতির বিষয়টিকে তীব্র করে তোলে।

বিশ শতকের শুরুতে অর্জুন সিং যখন সংসদীয় রাজনীতিতে আসেন, (তার আগে অবশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, জেতেননি) তখন থেকেই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে, যেখানে হিন্দিভাষী মানুষদের বাস বেশ ভালোই, এক অদ্ভুত রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা যায়। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার ফল ভোগ যে তৎকালীন শাসক শিবিরের প্রধান রাজনৈতিক দল সিপিআই(এম)-কেই করতে হয়েছে তা নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের বাংলাভাষী বহু মানুষকেও এর ফল ভোগ করতে হয়েছিল। অর্জুন সিংয়ের নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেসের ভেতরেও বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান বিষয়গুলিকে তখন থেকেই তীব্র হয়ে উঠতে দেখা যায়। অর্জুন সিংয়ের যে বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিকল্পনা, অর্থাৎ ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলকে হিন্দুত্ববাদীদের গবেষণাগারে পরিণত করা, সেই ভাবনার সূত্রপাত তিনি তখন থেকেই করেছিলেন।

তৃণমূল কংগ্রেস এই বিষয়টি যেমন বুঝতে পারেনি বা বুঝেও বুঝতে চায়নি, তেমনই সিপিআই(এম) বুঝতে পেরেছিল না কি, পারেনি - এই বিষয়টি ঘিরেও সংশয় থেকে যায়। গোটা রাজ্যের সিপিআই(এম)-এর যে পরিচালন পদ্ধতি আর ব্যারাকপুর মহকুমায় দলের পরিচালন পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা প্রয়োগগত ফারাক ছিল সেই সময়। তৎকালীন সাংসদ তড়িৎ তোপদারের সঙ্গে অর্জুন সিংয়ের সম্পর্ক ঘিরে কান পাতলে বহু কথাবার্তাই শুনতে পাওয়া যায়। সেসবের বাস্তবতা থাকুক, না থাকুক, দু'জনের মধ্যে যে ব্যক্তিগত উষ্ণতা এলাকার মানুষ দেখেছে, তা বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে বিপদের সংকেত হিসেবে তখন থেকেই পেকে উঠতে শুরু করেছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে যে অংশের মানুষ কখনও জাতপাত, ভাষা-ধর্ম ঘিরে রাজনীতি নিয়ে উৎসাহী ছিলেন না, তাদের কাছেও নেতিবাচক হয়ে ওঠে বিষয়টি।

তৃণমূল কংগ্রেস তখন রাজ্যে শাসন ক্ষমতা দখলের খাতিরে বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রে ভালো-মন্দ ভাবার মতো রাজনৈতিক স্থিতবুদ্ধির মধ্যে নিজেদের পরিচালিত করেনি। তাদের ধারণা হয়েছিল, অর্জুন সিং যে বিভাজনের রাজনীতি ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে করছেন, তাতে আখেরে তৃণমূলের লাভই হবে। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্জুন সিংয়ের এই বাহুবলী রাজনীতিকে কখনই বাধা দেননি। সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে বাহুবল প্রকাশের ক্ষেত্রে কী ধরনের আচরণ করেছিলেন অর্জুন সে ছবি আমরা দেখেছি বিধানসভা ভাংচুরে তাঁর ভূমিকাতেই।

অর্জুন সিং যখন ভাটপাড়া পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন প্রশাসক হিসেবে তাঁর কাছে যে ভাষা-ধর্মভিত্তিক সাম্য এলাকার সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করেছিল তা আদৌ দেখতে পাওয়া যায়নি। ভাটপাড়া পৌরসভার বিস্তৃত অঞ্চলে ধর্ম আর জাতপাত ঘিরে সাম্প্রতিক অতীতে কোনও বিভাজন ছিল না। চটকল অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় মিশ্র জনজাতির বাস ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে। বহু ভাষাভাষীর মানুষ একসঙ্গে থেকেছেন এখানে বছরের পর বছর। সকলের ধর্মীয় রীতিনীতি, সামাজিক সংস্কাররের ভিন্নতা সত্ত্বেও একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষদের যাপনের মধ্যে সামাজিক ঐক্য ভাটপাড়া পৌরসভা অধ্যুষিত এলাকায় বজায় ছিল। মিশ্র জনবসতির মিলেমিশে থাকবার দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা সমরেশ বসুর, 'উত্তরঙ্গ',  'জগদ্দল' উপন্যাস থেকে শুরু করে, স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্ব, দেশভাগ ঘিরে লেখা উপন্যাস 'খণ্ডিতা'-তে বিবৃত হয়েছে। সেই পরিকাঠামোটিকে ভেঙে দেওয়াই ছিল অর্জুন সিংয়ের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য।

আরও পড়ুন- চৌকিদারই চোর? বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি নির্বাচনী বন্ডই?

ভাটপাড়া পৌরসভার মধ্যে তিনি লড়িয়ে দিতে শুরু করলেন হিন্দু মুসলমানকে। লড়িয়ে দিতে শুরু করলেন বাঙালি ও অবাঙালিকে।শুধু তাই-ই নয়, বাঙালিকেই বাঙালিদের বিরুদ্ধে লড়ালেন। হিন্দুকে হিন্দুর বিরুদ্ধে লড়ালেন, মুসলমানকে মুসলমানের বিরুদ্ধে, অবাঙালিকে লড়িয়ে দিলেন বাঙালিদের বিরুদ্ধে।

২০১১ সালে বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এই এলাকায় অর্জুন সিংয়ের নেতৃত্বে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, সেই দলের অন্তত খাতায় কলমে যে রাজনৈতিক মতাদর্শ সেই মতাদর্শ বিরোধী কাজ কেবলমাত্র ভাটপাড়া পৌরসভা বা ভাটপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যেই শুরু করলেন না অর্জুন সিং, গোটা ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রেই শুরু করে দিলেন পুলিশ আর প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে।

পৌরপ্রধান হয়ে অর্জুন সিংয়ের প্রথম কাজ হয়েছিল পৌর কর্মচারীদের মধ্যে ভাষাভিত্তিক বিভাজন তৈরি করা।এই কাজে তিনি ঘনিষ্ঠ কিছু লোককে এমনভাবে ব্যবহার করেছিলেন যেটি পরবর্তীকালে তিনি বিজেপির সংসদ হওয়ার সময় তাঁর খুব কাজে লেগেছিল। ভাটপাড়া পৌরসভায় নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির পাশাপাশি আরেক ভয়ঙ্কর কাজ অর্জুন সিং করেছিলেন বলে অভিযোগ। তাঁর নিজস্ব কিছু হিন্দিভাষী মানুষকে ক্যাজুয়াল কর্মী হিসেবে নিয়োগ করেন অর্জুন যা ঘিরে তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল।

হিন্দিভাষী একটা বড় অংশের মানুষকে সামান্য কিছু টাকায় ক্যাজুয়াল কর্মী হিসেবে নিয়োগ করে একদিকে তিনি যেমন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের পেশাজীবনের ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছিলেন, অপরদিকে, ভাটপাড়া পৌরসভার ভেতর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী মানুষদের ভেতরেও এমন অসন্তোষের পরিবেশ তৈরি করেছিলেন যে, বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে যায়নি।

পরবর্তীকালে যখন তিনি বিজেপির সাংসদ হন, তখন ভাটপাড়া পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির বহু অভিযোগ তাঁর দলের পক্ষ থেকেই করা হয়েছিল।  পাশাপাশি, ভাটপাড়া পৌরসভাকেও ভয়াবহ আর্থিক সংকটে ফেলেছিলেন অর্জুন। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পৌরসভার প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে দেওয়ার পরেও পৌরসভার আর্থিক সংকট এমন জায়গায় যায় যে ক্যাজুয়াল কর্মীদের বেতন তো দূর, স্থায়ী কর্মীদের বেতন পর্যন্তও সংকটে পড়ে। পাশাপাশি, অবসরপ্রাপ্ত পৌরকর্মীদের পেনশন ঘিরেও তৈরি হয়েছিল বড় রকমের অচলাবস্থা।

চেয়ারম্যান থাকাকালীন পৌরসভার সম্পত্তি নিজের খেয়াল খুশি মতো বিক্রি করে দিয়েছিলেন অর্জুন সিং, এমন অভিযোগও রয়েছে বহু ক্ষেত্রে। পৌরসভার সম্পত্তি কোনও টেন্ডার ছাড়া অর্জুন সিংয়ের পছন্দের মানুষকে বিক্রি করে দেওয়ার অন্তরালে মোটা অংকের টাকার খেলা হয়েছিল বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠে। তৃণমূল কংগ্রেসে থাকলেও অর্জুন সিংয়ের কথাবার্তা, রাজনৈতিক পদক্ষেপ যে আরএসএস-বিজেপির মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য রেখেই পরিচালিত হচ্ছিল তা স্পষ্ট ছিল। কেউ কেউ বলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে আরএসএস-বিজেপির সেতুবন্ধনে অর্জুন সিংয়ের নাকি বড় ভূমিকা ছিল।

নোটবন্দি বা ডিমনিটাইজেশনের সময় অর্জুন সিংয়ের তৎকালীন শিবির তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধিতা করলেও অর্জুন সিং নাকি ঘনিষ্ঠ মহলে নোটবন্দি ঘিরে বিজেপির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তৃণমূলে থেকেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ মহলে যে ধরনের কথাবার্তা অর্জুন সিং বলতেন তা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। প্রশ্ন ওঠে, এসব কথা কখনই কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছত না? না কি পৌঁছালেও অর্জুনকে বাহুবলী মনে করে দল পরিচালনা, বিশেষ করে দলকে জেতানোর প্রশ্নে তাকে কোনওভাবেই চটাতে চাইতেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?

তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী বলে থাকেন, দলের নেতৃত্বকে যে এইভাবে ব্যক্তি আক্রমণ করতে পারা যায় সেই আচরণ অর্জুন শুরু করে ছিলেন নিজের রাজনৈতিক পরিকল্পনাগুলিকে মাথায় রেখেই। তাই ঠিক যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে অর্জুনকে দলের টিকিট দিলেন না, সেদিনই অর্জুন সোজা প্লেন ধরে দিল্লি চলে গিয়ে বিজেপির সদর দপ্তরে গিয়ে দলে যোগ দিলেন এবং ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হলেন। যদি সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্জুনকে দলীয় টিকিট দিতেন, তাহলে কিন্তু বিজেপিতে যেতেন না তিনি। তবে তৃণমূল কংগ্রেসের ভেতরে থেকেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে ব্যারাকপুর মহকুমা শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দানা বাঁধাবার কাজ করে যেতেন নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী।

তৃণমূল কংগ্রেসের মানুষদের কাছে অর্জুন সিংয়ের রাজনৈতিক দ্বৈততা এবং বাহুবলী বিষয়টি ভয়ঙ্করভাবেই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিগত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে তিনি জয়ী হওয়ার পর। গোটা ব্যারাকপুর মহকুমায় নির্বাচনউত্তর যে ভয়াবহ হিংসা, দাঙ্গা, খুন, অরাজকতার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সেদিন অর্জুনের প্রত্যক্ষ মদতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের মানুষজনেরাই।

তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গিয়ে দীনেশ ত্রিবেদী সেই যে ব্যারাকপুর ছেড়ে গেলেন, তার টিকিটির সন্ধানও এখানকার মানুষ পায়নি আর। যখন তাঁর দলের কর্মী সমর্থকরাই অর্জুনের লুটেরা বাহিনীর হাতে মার খাচ্ছে, সেই সময় আক্রান্ত দলীয় কর্মী-সমর্থকদের পাশে একটিবারের জন্যেও দীনেশ ত্রিবেদীকে দেখা যায়নি।

 ২০১৯ সালে অর্জুন সিং জেতার পর ভাটপাড়া নৈহাটি সংলগ্ন অঞ্চলে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়েছিল। সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের উপরে অর্জুনবাহিনীর পরিকল্পিত আক্রমণকে নিন্দা করার ভাষাও কম পড়ে। হিন্দুত্ববাদী শিবির তখনও এই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে নিজেদের ততটা বিস্তার ঘটাতে পারেনি। তাই এক সুশৃঙ্খল গুন্ডাবাহিনী সেদিন একইসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থক, বামপন্থী কর্মী-সমর্থক এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে ভয়াবহ আক্রমণ করেছিল। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে ভাটপাড়া, নৈহাটি, কাঁকিনাড়া, জগদ্দল ইত্যাদি এলাকা থেকে উৎখাত করার জন্য সমস্ত ধরনের নোংরা পথই ব্যবহৃত হয় অর্জুনের নেতৃত্বে। সেদিনের ভয়াবহ দাঙ্গায় কত যে গরিব মুসলমানের সর্বশান্ত হয়েছেন তার কোনও হিসেব পাওয়া যায় না। দুর্ভাগ্যজনক, তৃণমূল কংগ্রেস পরবর্তী সময়ে সেই অর্জুন সিংকে দলে ফিরিয়ে নিলেও ২০১৯ -এর দাঙ্গায় অর্জুনের নেতৃত্বে যেসব মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছিলেন তাদের অর্থনৈতিক বা সামাজিক পুনর্বাসনের জায়গাটা প্রায় অবহেলিতই থেকে গেছে।

অর্জুন যখন তৃণমূল কংগ্রেসে ছিলেন, সেই সময় ভাটপাড়া নৈহাটি কোঅপারেটিভ ব্যাংক ঘিরে তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ তছরূপের অভিযোগ উঠেছিল। সেই বিষয়টি ঘিরেও কোনওরকম ব্যবস্থা কিন্তু কেন্দ্র সরকার বা রাজ্য সরকার নেয়নি। অর্জুন বিজেপিতে অবস্থানকালে নির্বাচনউত্তর যে সমস্ত হিংসা-হাঙ্গামাতে তাঁর নাম জড়িয়েছিল, যেগুলো ঘিরে আদালতে মামলা মোকদ্দমা চলেছিল, অর্জুন আবার তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরে আসার পর, সেসব মামলারও বোধহয় পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়েছে।

এবার তৃণমূল কংগ্রেস অর্জুনকে প্রার্থী না করায় আবার অর্জুন বিজেপিতে গেছেন। বিজেপি এমনই এক দল, যে লোক দু'বছর আগে তাদের দল ছেড়ে ফের তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরে গেছিল, তাঁর সাত খুন মাফ! যদিও এই দলবদলের জন্য যেমন শিশির অধিকারীর সাংসদ পদ ঘিরে লোকসভার স্পিকার কোনও নড়াচড়া করেননি, তেমনই বিজেপির পক্ষ থেকেও অর্জুন সিংয়ের সাংসদ পদ ঘিরে কখনও কোনও অভিযোগ ওঠেনি। শুভেন্দু অধিকারী প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন তৃণমূলে যোগ দিলেও অর্জুন সিং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এনডিএ মনোনীত প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুকেই ভোট দিয়েছিলেন। সব দিক বিবেচনা করেই হয়তো এককালে যে অর্জুনের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভরসা ছিল, সেই ভরসা টলে যায়। তাই তিনি আস্থা রেখেছেন তাঁর দলের ব্যারাকপুরের ভূমিপুত্র পার্থ ভৌমিকের উপর।

আরও পড়ুন- যাদবপুরে সততা বনাম দুর্নীতি! সায়নী ঘোষের বিরুদ্ধে কতটা শক্তিশালী সৃজন ভট্টাচার্য?

পার্থ ভৌমিক তৃণমূল করলেও তাঁর আপাত নিরপেক্ষ ভূমিকা ঘিরে কেবলমাত্র নৈহাটি অঞ্চলের মানুষ নয়, গোটা ব্যারাকপুর মহকুমাতেই আকর্ষণের জায়গা তৈরি হয়েছে। মানুষের বক্তব্য, পার্থ ভৌমিকের কাছে গেলে, অভিযোগ কে করছেন, তিনি কোন দলের রাজনীতি করেন, এসব গুরুত্ব না দিয়ে অভিযোগকেই তিনি মান্যতা দেন এবং অভিযোগকারী যথোপযুক্ত সুরাহা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পান। দলের কারও সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলেও যে তিনি ব্যবস্থা নিয়েছেন তাও শোনা গেছে। প্রগতিশীল, তীব্র তৃণমূল বিরোধী, বামপন্থী ঘরানার লোকজনদের মধ্যেও পার্থ ভৌমিকের ভদ্রজনোচিত, নিরহংকার ব্যক্তিত্ব এবারের ভোটে অবশ্যই খুব বড় বিষয় হয়ে উঠবে।

জাতীয়তাবাদী রাজনীতি আর কমিউনিস্ট ভাবধারা মিশ্রিত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন পার্থ ভৌমিক। তাঁর ছাত্রজীবন কেটেছে রামকৃষ্ণ মিশনে। ফলে রামকৃষ্ণ মিশনের মূল্যবোধ, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল্যবোধ আর কমিউনিস্ট পার্টির পারিবারিক ধারার ত্রিবেণী সঙ্গমের মধ্যে দিয়ে রুচিশীল, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছেন তিনি।

অর্জুন সিং উন্নয়ন বলতে কী জানেন? কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া, কারও মেয়ের বিয়েতে কিছু আর্থিক সাহায্য করা, কাউকে ওষুধ কিনতে সাহায্য করা। গত পাঁচ বছরে ব্যারাকপুরের সাংসদ থাকাকালীন এই এলাকার বন্ধ বা ধুঁকতে থাকা চটকল নিয়ে দুই একটা আসর গরম করা বিবৃতি ছাড়া তিনি আদৌ কিছু করেননি। তৃণমূল-বিজেপি, আবার তৃণমূল, আবার বিজেপি- এই ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করা অর্জুনের বিজেপির শীর্ষস্তরের নেতৃত্বের সঙ্গেও যথেষ্ট সখ্য আছে। সেই সখ্যকে কাজে লাগিয়ে তিনি এলাকার বন্ধ বা ধুঁকতে থাকা কলকারখানার জন্য চাইলে অনেক কিছুই করতে পারতেন, করেননি।

আজও ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে যতগুলি সাংসদ তহবিল থেকে বরাদ্দ করা অ্যাম্বুলেন্স দেখতে পাওয়া যায়, তার মধ্যে বেশিরভাগই বামপন্থী সাংসদ তড়িৎ তোপদারের দেওয়া, আর কিছু তৃণমূলের সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীর। যখন তৃণমূলের মধ্যে টিকিট বন্টন নিয়ে দড়ি টানাটানি চলছে, তখন নাকি অর্জুন সিং একটি ঝাঁ চকচকে অ্যাম্বুলেন্স তাঁর সাংসদ তহবিলের টাকা থেকে দিয়েছেন। তবে সাধারণ মানুষের অভিযোগ, অর্জুন সিংয়ের সাংসদ তহবিলের টাকা নাকি ঘুরিয়ে তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা বেশ কিছু এনজিওর কাছে পৌঁছেছে।

 

*এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত বামপন্থীরা ব্যারাকপুরে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তাই তাদের বিষয়গুলি এখানে সেভাবে আলোচিত হলো না।

More Articles