এমনও সম্ভব! পৃথিবীতে বাক্সের মধ্যে তৈরি হল সূর্য, অসাধ্যসাধন বিজ্ঞানীদের

Nuclear Fusion: মানবজাতি যে পদ্ধতিতে পরমাণু বোমা বানিয়েছে বা পরমাণু চুল্লিতে শক্তি উৎপাদন করেছে তার একেবারে বিপরীত এই প্রযুক্তি।

লেখা শুরু করব একটা প্রশ্ন দিয়ে। আপনি কখনও সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছেন যে আপনার, আমার, গোটা পৃথিবীর এই যে চালিকা শক্তি, এই যে প্রকাণ্ড শক্তির ভাণ্ডার, তার উৎস কী? কোন পদ্ধতিতে শত কোটি বছর ধরে অবিরাম শক্তি উৎপাদন করে চলেছে এই নক্ষত্র? আরও একটি প্রশ্ন। আপনার কি মনে হয় জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব উষ্ণায়ন কীভাবে ঠেকাতে পারবে মানুষ? জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে, তাই তো? সৌর শক্তির ব্যবহার করে? জল শক্তি, বায়ুর শক্তি ব্যবহার করে? এই দুটো প্রশ্ন একসঙ্গে করার সম্পর্ক কী? তাহলে আসা যাক মূল জায়গায়, যদি আপনাকে বলা হয় আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদকে ঠেকাতে পারব পৃথিবীতে একটি বাক্সের ভিতর সূর্যকে সৃষ্টি করে! অবাস্তব শোনাচ্ছে নিশ্চয়ই। স্বাভাবিক। কিন্তু বিজ্ঞানের কাজই অবাস্তবকে বাস্তবে পরিণত করা। কল্পবিজ্ঞানের রূপকথাকে বিজ্ঞানের কঠিন বাস্তবে রূপ দেওয়া। সম্প্রতি মার্কিন বিজ্ঞানীরা এই অবাস্তবকেই পরীক্ষাগারে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন সফলভাবে। প্রায় ছয় দশকের প্রচেষ্টার পর!

সূর্যের শক্তির উৎস হল নিউক্লিয়ার ফিউশন নামক এক প্রযুক্তি। মানবজাতি যে পদ্ধতিতে পরমাণু বোমা বানিয়েছে বা পরমাণু চুল্লিতে শক্তি উৎপাদন করেছে তার একেবারে বিপরীত এই প্রযুক্তি। আমরা এতদিন নিউক্লিয়ার ফিশন প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই কাজটি করতাম, যেখানে ইউরেনিয়ামের মতো ভারী মৌলকে ভেঙে প্রকাণ্ড পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা হতো। সেই প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র যে প্রচুর পরিমাণে বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের জন্ম নিত তাই নয়, উৎপাদন প্রক্রিয়াও ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। চেরনোবিল বা জাপানের পরমাণু চুল্লির দুর্ঘটনার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সকলের।

কিন্তু সূর্য যে পদ্ধতিতে শক্তি উৎপাদন করে, তা হলো ফিউশন। সেখানে হালকা দুই মৌল উত্তপ্ত হয়ে একটি ভারী মৌল তৈরি করে এবং সেই পদ্ধতিতে প্রকাণ্ড পরিমাণ শক্তির সৃষ্টি হয়। সূর্যের শক্তির উৎস যেমন হাইড্রোজেনের দু'টি মৌল, যারা এই পদ্ধতিতে উত্তপ্ত হয়ে হিলিয়ম নামক একটি ভারী মৌলের জন্ম দেয়। যদিও এই পদ্ধতির জন্য প্রয়োজন প্রচণ্ড পরিমাণ শক্তি এবং চাপ। সূর্যের ক্ষেত্রে সেই শক্তির জোগান দেয় এক কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চেয়ে প্রায় একশো বিলিয়ন গুণ বেশি চাপ।

আরও পড়ুন- ২০৭১ সাল দেখাবে এই ‘ভবিষ্যতের জাদুঘর’! কী কী আছে এর অন্দরে, জানলে আঁতকে উঠবেন

কিন্তু পৃথিবীতে তো এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ভীষণ কঠিন এক কাজ। ১৯৬০ থেকে প্রায় ৫০ টি দেশের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সূর্যের কোরের অবস্থা পৃথিবীতে সৃষ্টি করা এবং তাকে অধিক সময়ের জন্য ধরে রাখা ছিল অসম্ভব এক কাজ। সম্প্রতি আমেরিকার National Ignition Facility ১৯২ টি বিম লেজরের মাধ্যমে এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। সব থেকে বড় কৃতিত্ব হল, যে পরিমাণ শক্তি তারা এই কাজের জন্য ব্যবহার করেছেন তার থেকে অনেকটাই বেশি শক্তি তারা এই পদ্ধতিতে উৎপাদন করতে পেরেছেন।

এবার প্রশ্ন আসতে পারে, এত পরিমাণ শক্তি পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি করা এবং তার মাধ্যমে পৃথিবীবাসীকে শক্তির জোগান দেওয়া কতটা সুরক্ষিত? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পদ্ধতি আসলে সব থেকে ঝুঁকিহীন। এমনভাবেই যন্ত্রের ব্যবহার করা সম্ভব যেখানে শক্তি উৎপাদন যদি মাত্রাছাড়া পরিস্থিতিতে চলে যায় তাহলে যন্ত্র নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে। কোনও ধরনের বিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। সেই সঙ্গেই, এই পদ্ধতিতে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য বিশেষ তৈরি হয়না বললেই চলে। তৈরি হয় না কোনও ধরনের গ্রিন হাউজ গ্যাস। সব থেকে বড় বিষয় হল, এই পদ্ধতিতে শক্তি উৎপাদন করতে যে উপাদানের প্রয়োজন তা হলো জল। পৃথিবীতে যে পরিমাণ জল রয়েছে তাতে আগামী তিন কোটি বছর হেসে খেলে শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

লেখার শুরুতেই দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি ছিল এবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ কীভাবে করা সম্ভব হবে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে। পৃথিবীতে যদি আর একদিনও জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর প্রয়োজন না হয়, তাহলে আজ যে বিপদের সম্মুখীন আমরা, তা ঠেকানো সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তা এক অলীক কল্পনা হলেও এই নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রযুক্তি যেদিন পুরোদমে কাজ করা শুরু করবে সেই দিন গোটা পৃথিবী অনেক সস্তায় শক্তির জোগান পাবে। পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্তে এই পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে এবং তা হবে সম্পূর্ণভাবে দূষণহীন। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে সবে মাত্র পরীক্ষাগারে সাফল্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দিল্লি এখনও অনেক দূর। কিন্তু এই কথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে ভবিষ্যত প্রজন্মকে এক সুন্দর পৃথিবী দেওয়ার পথে অনেক ধাপ এগিয়ে গেল মানবজাতি।

আশাব্যঞ্জক আরও এই কারণে, বিল গেটস, জেফ বেজোসের মতো ধনকুবের এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছেন। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্যি, ধনতান্ত্রিক পৃথিবীতে ধনকুবেরদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া পৃথিবীকে রক্ষা করা অসম্ভব। এবার এটাই দেখার, কত বছরের মধ্যে সাধারণের ঘরের আলো নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে জ্বলে।

More Articles