মাতৃগর্ভেই মৃত্যুফাঁদ! ভ্রূণেও নিরাপদ নয় শিশু, উদ্বেগ বাড়াচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা
Child Health: দূষিত বাতাসের কালো কার্বনের ক্ষুদ্র কণা পাওয়া যাচ্ছে শিশু-ভ্রূণের ফুসফুস, মস্তিষ্ক এবং যকৃতে।
পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা বারবার একটা কথা বলে থাকেন। পরিবেশ এক শ্রেণির মানুষের কারণে দূষিত হয়, ধ্বংস হয়, এবং যাঁরা নিরপরাধ, যাঁদের পরিবেশ ধ্বংস করার এই প্রক্রিয়ায় কোনও ভূমিকা নেই, তাঁরাই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। দুঃখের বিষয় হলো, বিজ্ঞান পরিবেশকর্মীদের এই কথাটা বারবার সত্য প্রমাণ করেছে। তা সে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষ হোক, প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপের অধিবাসী হোক বা মাতৃগর্ভে থাকা শিশু- কেউই আজ নিরাপদ নয়। আমাদের বাতাস আজ এতটাই দূষিত যে, মা নিজের সন্তানকে নিজের গর্ভের ভেতরেও সুরক্ষিত রাখতে পারছেন না। আমরা যত অর্থনীতির নিরিখে উন্নত হচ্ছি, তত দ্রুত আমাদের চারপাশের পরিবেশকে আমরা বিষিয়ে ফেলছি। এমন কিন্তু নয় যে, বিপদ সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল নই। কিন্তু তাতেও আমাদের টনক নড়ছে না।
অতি সম্প্রতি বেলজিয়ামের আবেরদিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাসেল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই ভয়াবহ তথ্য। দূষিত বাতাসের কালো কার্বনের ক্ষুদ্র কণা তাঁরা পেয়েছেন শিশু-ভ্রূণের ফুসফুস, মস্তিষ্ক এবং যকৃতে। Lancet Planetory Health ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এই রিপোর্ট তুলে ধরছে এক গভীর আশঙ্কাজনক দিক। অতীতে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছিলেন, কীভাবে বাতাস এবং জলের দূষণ প্রভাব ফেলছে নবজাতকের স্বাস্থ্যের ওপর। এমনকী, ভ্রুণ নষ্ট পর্যন্ত হয়েছে গর্ভের ভেতর। সেই সঙ্গে ওজন কম হওয়া, মস্তিষ্কের বিকাশের অভাব, এই ধরনের সমস্যা তো দেখা যাচ্ছিলই।
আরও পড়ুন: মাতৃদুগ্ধেও প্লাস্টিকের কণা! কতটা নিরাপদ আপনার শিশু
নতুন গবেষণা বলছে, মায়ের প্রশ্বাসের মাধ্যমে দূষিত বায়ু প্রথমে রক্তে, তারপর রক্তের দ্বারা বাহিত হয়ে প্লাসেন্টা এবং অবশেষে শিশুর শরীরে প্রবেশ করছে। জমা হচ্ছে ফুসফুস, মস্তিষ্ক এবং যকৃতে জমা হচ্ছে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই দূষিত কণার সংখ্যা। গবেষকরা জানাচ্ছেন, হাজার হাজার কালো কার্বনের কণা পাওয়া যাচ্ছে ভ্রুণের টিস্যুর প্রত্যেক কিউবিক মিটারে। স্বাভাবিকভাবেই এই সমস্ত শিশুরা কোনও না কোনও ব্যাধি নিয়ে জন্মাচ্ছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই দুরারোগ্য হচ্ছে, বা তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভীষণভাবে দুর্বল হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিও। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না তারা। তাদের সারাটা জীবন হতে চলেছে এক ভীষণ কঠিন লড়াই, এবং এ এক অসম লড়াই। এই শিশুদের একটাই দোষ। তারা এই পুঁজিবাদী পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে, যেখানে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে না রাষ্ট্র, না হাজার লক্ষ কোটি টাকার সংস্থা, কেউ ভাবে না।
এই গবেষণার সবথেকে চাঞ্চল্যকর দিক কিন্তু ভৌগোলিক। মনে হতে পারে, হয়তো ভারতীয় উপমহাদেশের বা উন্নয়নশীল কোনও দেশের দূষিত শহরের নারীরা এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তা নয়। এই গবেষণা করা হয়েছে স্কটল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের মায়েদের শরীরে, এবং তাঁরা কেউই ধূমপান করেন না। স্কটল্যান্ড এবং বেলজিয়াম, এই দুই দেশেরই যথেষ্ট সুনাম রয়েছে দূষণহীন, পরিচ্ছন্ন বাতাসের নিরিখে। বেলজিয়াম এবং স্কটল্যান্ডে যদি এই ধরনের রিপোর্ট আসে, তাহলে ভারতের বেশিরভাগ শহরেই মাতৃগর্ভে থাকা শিশু ঠিক কতটা পরিমাণ বিষ তাদের শরীরে নিয়ে জন্মাবে বা জন্মাচ্ছে- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কী তাদের ভবিষ্যৎ? কীভাবে গড়ে উঠবে আগামী প্রজন্ম? তাদের পূর্বপুরুষদের পাপের ফল ঠিক কতটা ভুগতে হবে তাদের?
যে দুই দেশে এই গবেষণা করা হয়েছে, সেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য তুলনামূলকভাবে কম পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের থেকে। এবার যদি ভেবে দেখা যায়, কীভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বেশিরভাগ মানুষ বাস করেন, তাহলে তাদের শিশুরা ঠিক কতটা ভয়াবহ পরিবেশে বেড়ে উঠছেন, তাহলে শিউরে উঠতে হয়। আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও কৃষ্ণবর্ণের মানুষ এখনও চরম বৈষম্যের শিকার। তাদের বেশিরভাগ শিশুই বেড়ে উঠছে শিল্পাঞ্চলের বিষাক্ত ধোঁয়ার মধ্যে।
মহা-ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রনায়ক, বা হাজার লক্ষ কোটি টাকার সম্পদের অধিকারী পুঁজিপতিরা কেউ সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা পড়েছিলেন কি না, জানা নেই। মনে হয় পড়েননি। পড়লেও, তাঁরা আজকের এই দিন অবধি পরিবেশ রক্ষা করার যা সদিচ্ছা দেখিয়েছেন, তা যদি মায়ের গর্ভে থাকা শিশুরা দেখত, তাহলে হয়তো তারা আর জন্মাতেই চাইত না। প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই কোনও না কোনও গবেষণার ফলাফল সামনে আসছে। বিজ্ঞানীরা আমাদের অবগত করছেন বিপদের সম্পর্কে। কিন্তু তাতে না টনক নড়ছে সাধারণ মানুষের, না কোনও সদর্থক পদক্ষেপ নিচ্ছেন সরকার। বিশ্বের প্রত্যেকটি বৃহৎ শহরের মানুষই চূড়ান্ত খারাপ বাতাসের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের শহরগুলিতে। যেখানে জনঘনত্ব অনেক বেশি। বেশি আর্থিক বৈষম্যও। কী ভবিষ্যৎ সেখানে? কী নিয়ে জন্মাবে সেখানকার শিশুরা?
এই পৃথিবী শিশুর বাসযোগ্য অনেকদিনই নেই, আগামী দিনেও হওয়ার বিশেষ আশা নেই। যারা এই নির্মম পৃথিবীতে জন্মাবে, তারাই ছিনিয়ে নেবে পরিচ্ছন্ন বাতাস, মুক্ত বাতাসে প্রশ্বাসের অধিকার, এই আশা রাখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।