ক্ষমতা আমায় দেখে
CCTV Surveillance: সমাজে নজরদারির উপরে জোর দেওয়া হয়েছে প্রথম থেকেই। তোমাকে, তোমাদের আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখছি।
আমি ফেসবুক (অধুনা মেটা নামে লোকখ্যাত) দেখছি। ফেসবুকে 'সমমনস্ক' বাসিন্দাদের দেখছি। দেখে আশ্বস্ত লাগছে। কেননা এখানে শান্তিকল্যাণ। এখানে স্তুতি। সামান্য খ্যাতি, গুণের কদর। আমি খাওয়া, ঘুম, সামান্য যৌনতা ছাড়া মরপৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখি না আর তেমন। ঘুম ভেঙেই ফেসবুক দেখি। ঘুমোতে যাই ফেসবুক চালু রেখে। এই আমি ভালো আছি। ভালোই আছি।
এই রকমটাই ভাবি আমি। ভাবেন আপনি। আর এই ভাবনার স্থূলেই ভুল। কারণ আমি ফেসবুক/মেটা-কে দেখছি না। আসলে সে-ই আমায় দেখছে। আমায় মাপছে। আমার ব্যবহারের অনুপুঙ্খ বিবরণ তার কাছে আছে। তা যাচাই করে, জেনেবুঝেই সে আমাকে এমন একটা পৃথিবীর সামনে নিয়ে যাচ্ছে, যা আমারই কল্পলোক। আমি দেখে ভাবছি আরে কী নিষ্কলুষ এখানে সব! একদম আমার চাহিদা অনুযায়ী গড়া যেন। ভাবছি আর ভাবছি, স্ক্রল করছি থেকে থেকে (পাশ্চাত্য এর নাম দিয়েছে ডুমস্ক্রলিং)। এভাবেই, ক্রমে সময় যাচ্ছে একজন ব্যক্তির, একটি গোষ্ঠীর। যত বেশি ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড এখানে অতিবাহিত হচ্ছে (পরিভাষায়- ওয়াচটাইম) পণ্য হিসেবে ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মূল্য তত বাড়ছে।
অর্থাৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, আমি-আপনি-আমরা জেনে বা না জেনেই, হয়ে উঠছি বিক্রয়যোগ্য মাল। আরও ভালো মাল কী ভাবে হব পণ্যের বাজারে (এক একটি প্রোফাইলকে একেকটি পণ্য ধরে নেওয়া যেতে পারে), আমার দাম কীভাবে বাড়বে? মোটের ওপর, যত সক্রিয়তা বাড়বে, নজরদারি তত সুনিপুণ হবে। নজরদারিবাবদ প্রাপ্য তথ্যে পছন্দসই পরিবেশ তৈরি করা হবে ক্রমে। যাতে কিছুক্ষণ আরও থাকার ইচ্ছে হয়।
আরও পড়ুন- কে তুমি?
এখানে আমার প্রতিটি আচরণ, লাইক, শেয়ার, কমেন্ট পরিভাষা অনুযায়ী জন্ম দিচ্ছে আচরণগত তথ্য বা বিহেভেরিয়াল ডেটা-র। সেই তথ্য ব্যবহার করে পরিষেবা মসৃণতর হচ্ছে যাতে আমি সেঁটে থাকি। তরলায়িত করে বললে, এই যেমন চাই তেমন পাই, আমার ব্যবহার লুকিয়ে নিরীক্ষণ করে আমাকে এমন একটা অভিজ্ঞতার মাঝে এনে ফেলার নামই অ্যালগোরিদম। এমনকী আমার দেওয়া যে তথ্যটি আপাতভবে কাজে লাগছে না তা থাকছে ডেটা একজস্ট বা উদ্বৃত্ত তথ্য হয়ে। তারও মূল্য আছে। অন্যত্র ব্যবহৃত হবে এই ফেলনা-তথ্য।
দেখা যাচ্ছে, এই ব্যবস্থায় তুমি আর মানুষ নও। তথ্যদাতা একটি যন্ত্রমাত্র। তোমার চিন্তা,মেধা, রক্ত, ঘামের বিন্দুমাত্র দাম নেই। তুমি মানে কিছু আচরণের ফিরিস্তি। তোমার দেওয়া তথ্যকে পুঁজি করে, তোমার যাবতীয় আচরণ আড়াল থেকে দেখে তোমাকেই কৌশলগতভাবে আশ্বাসে ঘেরা একটি রঙিন গুমঘরে বন্দি করে রাখা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থব্যবস্থা। সুজানা যুবফ এই ব্যবস্থার নাম দিয়েছেন সার্ভিলেন্স ক্যাপিটালিজম বা নজরদারি পুঁজিবাদ (এই নামে একটি মহাগ্রন্থ লিখেছেন তিনি)। খোলাবাজার অর্থনীতি মানুষকে ক্রয় বাড়াতে শিখিয়েছে, পণ্যের চাহিদা তৈরি করেছে ক্রমাগত। নজরদারি পুঁজিবাদ মানুষকে পণ্য বানাল।
এখন প্রশ্ন, এই ব্যবস্থা কি শুধু ফেসবুকেই? উত্তর- না। আমার সার্চ করা ভুল বানানটিকেও গুগল ডেটা একজস্ট হিসেবে রেখে দেয়। একটি নমুনা হিসেবে তা সংরক্ষিয় থাকে। আবার, গোটা মাসে কত টাকার খাবার সুইগি বা জোমাটো ব্যবহার করে কিনি, কেনার গতি কী, সেই গতি ও খাদ্যরুচি অনুযায়ী আমি কোন গোষ্ঠীর অংশ, সংস্থাগুলি জানে। জানে বলেই আমার মন কি বাত আমি সুইগিতে দেখতে পাই বিকেল হলে। ভাবি, ওরা কী ভালো বোঝে আমার মন। কৃতজ্ঞ হয়ে খাবার কিনে নিই। আমি খাবার খাচ্ছি নাকি খাদ্যকে সামনে রেখে তৈরি হওয়া একটা জেলখানায় ঢুকে যাচ্ছি যেখানে রক্তকরবীর মতোই দশ-পঁচিশের ছক কার্যকর? যেখানে আমি মানে একটা নম্বর, একটা চিহ্ন, আর পাঁচজনের মতোই? তলিয়ে ভাবলেই দেখা যাবে, আমার মানবিক অস্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করেই তৈরি অপেক্ষাকৃত নবীন এই অর্থনীতি ব্যবস্থার কাঠামো। গোটা পদ্ধতিটা অবশ্য এত ঝকঝকে, তুক এমন, আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝব না ক্ষমতা দেখতে দেখতে আমার বিমানবিকীকরণ ঘটাচ্ছে। আমি ভাবছি পরিষেবা ভালো। আমি ভালো আছি।
আরও পড়ুন- শোকের বিগ্রহ
আমি ভাবতে পারব না যে আদতে আমিই নেই। আমি একটি আমিত্বহীন গড্ডালিকাপ্রবাহের অংশমাত্র, যার পূর্বাপর সবটাই ব্যবস্থা জানে। আমি বুঝি না আমি ব্যবস্থা অনুগত দাসশরীর মাত্র। যে কী খাচ্ছে ব্যবস্থা জানে। কোথায় যাচ্ছে, কতক্ষণ কাটাচ্ছে, কবে যাওয়া হলো না, ব্যবস্থা জানে, সমস্ত দাঁড়ি, কমা, হাইফেন, সেমিকোলন- ব্যবস্থা জানে। আমি ব্যবস্থার একটি স্টেটমেন্ট, একটা স্কোর। এই ব্যবস্থা আমায় কিনে রেখেছে তাৎক্ষণিক পুরস্কারের মাধ্যমে। যেমন- পনেরো মিনিটে খাবার। যেমন- এক হাজার লাইক। এটুকুর জন্য আমি সব তথ্য দিতে রাজি, সারাদিন সময় দিতে রাজি। মরপৃথিবী আমার ভালো লাগে না। আমি এই ভালো আছি। এখানেই খাব, সময় কাটবে একলা অথচ একলা নয়, এটুকুই ভাবতে পারছি। এর বেশি ভাবতে পারছি না।
এই যে দেখাসঞ্জাত অর্থনীতি, এর বীজ কোথায়? রাষ্ট্রে। সমাজে নজরদারির উপরে জোর দেওয়া হয়েছে প্রথম থেকেই। তোমাকে, তোমাদের আমি একটু উঁচু থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখছি। মিশেল ফু্কোঁর মতে, এই দৃশ্যমানতা এক ধরনের ফাঁদ। এর মধ্যে দিয়েই ক্ষমতা বা জ্ঞানের নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা সক্রিয় থাকে। সার্ভিলেন্স বা নজরদারি বোঝাতে ফুকোঁ জেরেমি বেন্থামের নকশা করা প্যান অপটিকনকে তুলে ধরেছেন। জেল কর্তৃপক্ষ আমায় দেখছে, আমাদের সবাইকে দেখছে, এই ভয়ে আমি ও আমরা আচরণ সংশোধন করব। ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলা বজায় রাখব। ব্যক্তিগত এবং সামাজিক- বেঁচে থাকা হবে নজরদারির অধীন। গঠিত হবে আদর্শ সমাজ। এই 'দেখা' ক্রমে আমায় মানুষের থেকে খাটো করে দেবে। রাষ্ট্রের সামনে আমার ব্যক্তিগত, গোপনীয় কিছুই থাকবে না। অন্তরঙ্গতার এতটুকুও অধিকার থাকবে না। ভয় নিয়ে যে বাঁচবে সে একজন কয়েদি, একটি প্যান বা আধার নম্বর। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ধারণার পরিপন্থী এই কয়েদখানা ব্যবস্থা। ক্ষমতাকর্তৃক দাঁড়িপাল্লায় ব্যবহার মাপার ব্যবস্থা এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই ব্যবস্থা ক্রমে শক্ত হতে হতে অবমাননায় জর্জর দাসের গায়ে আপাত-অদৃশ্য দাম বসাবে।
আশা করি কেউ কেউ বুঝবেন, একদিকে কখনও কখনও সামগ্রিক নিরাপত্তার কারণে যেমন সিসিটিভি জরুরি, তেমনই সিসিটিভি ক্ষমতাতন্ত্র কায়েম করতে অব্যর্থ। রাষ্ট্রীয় জেলখানার পেয়াদার নাম সিসিটিভি। সিসিটিভির অবলোকনে মানুষ মানুষের চেয়ে খাটো হয়ে বাঁচতে বাধ্য হয়। মনকে, তার অবাধগামী চরিত্রকে সিসিটিভি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে। সর্বক্ষণ মন জানবে তাকে কর্তৃপক্ষ দেখছে। সে রাজাকে দেখতে পাবে না পাল্টা। এই নজরদারি প্রভুত্ববাদ তো ক্ষমতাতন্ত্রেরই হাত শক্ত করে। স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে এর বিপক্ষেই সওয়াল করতে হবে। সিসিটিভি নিয়ন্ত্রণাধীন জীবন প্রশ্নবিমুখ হতে বাধ্য।
কিন্তু, স্বাধীনতা যে পেয়ে অপব্যবহার করেছে? দাসত্বের শৃঙ্খল সে এড়াবে কীভাবে!

Whatsapp
