কলকাতা আর দার্জিলিং, বিষাক্ত প্রণয় আখ্যান

Darjeeling Landslide: ১৮৯৯ থেকে এ যাবৎ দার্জিলিংয়ে অন্তত দশবার বড় ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে কিন্তু সেসব ধসের খবর শহুরে বাঙালি রাখেনি, কারণ সেইসব ধসে কোনো সমতলবাসীর ক্ষতি হয়নি, ক্ষতি হয়েছে ঝুপড়িবাসীর।

রোম পোড়ে নিরো হাসে। প্রাচীন প্রবাদ। এ প্রবাদের সবচেয়ে সফল প্রয়োগ দেখা গেল যখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরের মানুষ বানের জলে ভেসে যাচ্ছে জেনেও কার্নিভালে মজলেন। বেহালা বাজালেন। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের প্রতিটি মানুষের অভিভাবক, প্র‍শ্ন উঠছে তাঁর রাজ্যে যখন এত বড় বিপর্যয় চলছে, তিনি কী করে এমন ভাবলেশহীন থাকলেন? আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বডি ল্যাঙ্গ্যুয়েজ প্রতীকী, উত্তরবঙ্গের প্রতি দশকের পর দশক চলে আসা শহুরে মধ্যবিত্তের বৈমাত্রেয়সুলভ মনোভাবেরই প্রতিফলন। যেখানে করুণা আছে, দান আছে, কিন্তু সমানুভবের কোনো জায়গা নেই।

বাঙালির দিঘা, পুরী, দার্জিলিং রুটিন ভ্রমণ-খিদের চুল্লিতে অবিরাম জোগান দিতে নাভিশ্বাস উঠেছে এই জায়গাগুলির। দার্জিলিংয়ে গত কয়েক দশকে পাহাড়ের বুক চিরে নিয়মকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে যত্রতত্র অবৈধ হোটেল গড়ে উঠেছে। শহর কলকাতা থেকে যাঁরা দার্জিলিং যায়, তারা যে পরিমাণ জল খরচ করে তা দেখলেই ঠাওর করা যাবে, গরমের দিনে দার্জিলিংয়ের আম-বাসিন্দাদের জলকষ্ট সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। ব্রিটিশ জমানায় দার্জিলিংয়ের পচিশ হাজার বাসিন্দার জলের জোগান সুনিশ্চিত করতে সেঞ্চাল এবং সাউথ লেক তৈরি হয়েছিল। আজও দার্জিলিং শহরে জলের অন্য কোনো উৎস নেই, তদুপরি লোকসংখ্যা কমপক্ষে এক লক্ষ সত্তর হাজার, সেই সঙ্গে গড়ে বাইরের লোক সারাবছর থাকে ৩০ হাজার। এই ৩০ হাজার লোকের আমোদের জোগান দেওয়ার পর পানীয় জল জোগাড়ের জন্যে তিনটে রাস্তা খোলা থাকে দার্জিলিংবাসীদের জন্যে, ভিক্ষে, চেয়েচিন্তে নেওয়া অথবা চুরি। পরিমল ভট্টাচার্য তাঁর দার্জিলিং গ্রন্থে শীতশেষের দার্জিলিংয়ের ছবিটা বোঝাতে লেখেন, "পৌরপাইপ থেকে, ব্যক্তিগত ট্যাঙ্ক থেকে জলচুরির ঘটনা ঘটে, ঝোরার সামনে লেগে থাকে টুকরো বচসা।"

নব্বইয়ের দশক থেকেই নেপালিদের ভিড় বাড়ছিল দার্জিলিংয়ে। তাদের একটা বড় অংশই কলকাতায় নানা রেস্তোরাঁয় রান্নার কাজ নিয়েছে। সমতলের বাঙালি নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমেই তাদের দাইজু বলে আর শহরে নেপালি মেয়ে দেখতে পেলে আড়ালে আবডালে বলে 'চিঙ্কি'। তাদের একটাই পরিচয়, ভালো মোমো বানায়।

আরও পড়ুন- ১৯৬৮ থেকে ২০২৫: যেভাবে বারবার বন্যায় লণ্ডভণ্ড উত্তরবঙ্গ

পাহাড়ের মানুষের প্রাত্যহিক জীবন তো বটেই, পাহাড়ের ধসও সমতলের বাঙালির প্লেবুকের বাইরে। কারণ ধস নামে মূলত বর্ষায়, সে সময় সমতলের বাঙালি পাহাড়মুখো হয় না। ১৮৯৯ থেকে এ যাবৎ দার্জিলিংয়ে অন্তত দশবার বড় ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে কিন্তু সেসব ধসের খবর শহুরে বাঙালি রাখেনি, কারণ অনুসন্ধান করেনি, কারণ সেইসব ধসে কোনো সমতলবাসীর ক্ষতি হয়নি, ক্ষতি হয়েছে ঝুপড়িবাসীর। জনজীবন স্বাভাবিক হতেই শুরু হয়েছে ফের গাছ কেটে, মাটি আলগা করে হোটেল আর রাস্তা নির্মাণ। দার্জিলিংয়ে সাড়ে ১১ মিটারের বেশি উঁচু যে কোনো নির্মাণই বেআইনি, কিন্তু ক'টা হোটেল এই বিধি মেনেছে, তা দার্জিলিংয়ের যেকোনো শিশু কড় গুণে বলে দেবে। PM10 within Indian standard is achievable by mitigating the sources of PM1: A thirteen years (2009–2021) long study and future prediction (2024) over the eastern Himalayas, India’ নামক গবেষণা দেখাচ্ছে দার্জিলিংয়ের অবস্থা উদ্বেগজনক। দার্জিলিংয়ের নরকগুলজার দশা দার্জিলিংবাসী নিজে বানানয়নি। গবেষকরা এই অবস্থার জন্যে দায়ী করেন মূলত ট্যুরিস্টের অনিয়ন্ত্রিত ভিড় আর অপরিকল্পিত নগরায়নকে। ১৩ বছর ধরে চলা গবেষণায় উঠে এসেছে ট্যুরিস্টের গাড়ির ধোঁয়া দার্জিলিংয়ের সার্বিক দূষণের ৩৩ শতাংশের কারণ।

Landslid in Darjeeling

দার্জিলিংয়ে ধসের চিত্র

২০২০ সালের দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী কোনো হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে শব্দ-নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব রাজ্য প্রশাসনের। এ বছর দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে খ্যাতনামা স্কুলগুলি এ বছর প্রশাসনের দারস্থ হয়ে জানায়, ট্যুরিস্টের গাড়ির হর্নের শব্দের জন্যে ক্লাস নেওয়া যাচ্ছে না। ছাত্ররা পড়ায় মন দিতে পারছে না। ২০২০ সালে দার্জিলিং ট্রাফিক পুলিশের একটি সমীক্ষা দার্জিলিংটা সমতলের দার্জিলিংপ্রীতির কদর্য দিকটা তুলে ধরে। দেখা যায় ট্যুরিস্ট সিজনে বাতাসিয়া লুপে চারহাজারের বেশি গাড়ি আসাযাওয়া করে। যে কোনো সময় দেড়শো গাড়ি পার্ক করা অবস্থায় থাকে। কিন্তু ট্যুরিস্ট সিজন চলে গেলে বাতাসিয়া লুপে ৪৫০ গাড়ি চলে। এ যেন শাখের করাত। ট্যুরিস্ট ছাড়া দার্জিলিংয়ের চলবে না। অথচ ট্যুরিস্টের গাড়ির হর্নের শব্দে, গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় জব্দ শৈলরানি। আর সেই ট্যুরিস্ট চলে গেলে, পর্যটকশূন্য় দার্জিলিং বাঁচে অবসাদ আর নিঃসঙ্গতার চক্রাকার ঘূর্ণনে। ইন্দ্রবাহাদুর রায়ের Pahad ra Khola-য় ধরা আছে সেই ভয়ের কথা:

They all lived in the fear of the house being pulled down by a landslide or a storm. They began to worry about how strong were the foundations and ground on which the house stood or the bonds between the storeys.

আরও পড়ুন- উন্নয়নের নামে যেভাবে বিপর্যয় ডেকে আনা হলো উত্তরবঙ্গে

বর্ষার দার্জিলিংয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে পরিমল ভট্টাচার্য তাঁর দার্জিলিং গ্রন্থে লিখেছেন, "অবিশ্রান্ত বৃষ্টির জল চুঁইয়ে ঢুকে পড়ে মেটামরফিক পাথরের খাঁজে, খুঁজে নেয় ফাটল, কেটে ফেলা গাছের শিকড়ের নালিপথ, ধুয়ে দেয় মাটি, তারপর একদিন আচমকাই বাড়িঘর রাস্তা গাছ বিদ্যুতের খুঁটি ঘুমন্ত মানুষ সমস্ত ধসিয়ে দেয়। এক ধূসর সকালে ঘুম থেকে উঠে দার্জিলিংবাসী আবিষ্কার করে পাহাড়ের গায়ে যে ছোট বসতিটা ছিল-নেই। কয়েকশো ফুট নীচে পড়ে আছে টিন আর তক্তার স্তূপ। তার ভেতর থেকে তুলে আনা হচ্ছে নিথর মাটিমাখা দেহ, কোঁচকানো কাগজের মতো দেহত্বক। যারা বেঁচে গিয়েছে তাদের ঠাঁই হয় স্থানীয় স্কুলবাড়িতে কিংবা তাঁবুতে।" কেভেন্টার্স, গ্লেনারিস, টয়ট্রেন-প্রিয় সমতলের বাঙালি এই অবিরল ক্ষতের খোঁজ রাখে না। 

darjeeling

বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত পাহাড়

ব্যক্তির মুখেরই দানবিক সমষ্টি সমাজ। তাই সমতলকেন্দ্রিক সমাজ-রাজনীতিতে দার্জিলিং চিরকাল অপর। বামেরা ক্ষমতায় এসেছিল ভূমি সংস্কার আইন কার্যকর করে। জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটিয়ে, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি পুনর্বন্টন করে। এই পরিকল্পনায় কোথাও দার্জিলিং ছিল না। যে দূরত্ব দশকের পর দশক তৈরি করেছে সমতলের নেতারা তার ফলশ্রুতি হিসেবেই আশির দশক জুড়ে দার্জিলিংয়ের রাস্তায় কান পাতলেই তাই শোনা গিয়েছে ‘হাম্রো মাঙ্‌ দিনু পড়ছ’, ‘জ্যোতি বসু হায় হায়, বঙ্গাল সরকার হায় হায়’ স্লোগান। ১৯৮৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ভারত সরকার এবং সুভাষ ঘিসিংয়ের নেতৃত্বাধীন গোর্খাল্যান্ড ন্যাশানাল লিবারেশনের ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মধ্যে দিয়ে দার্জিলিং হিল কাউন্সিল গঠিত হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল পার্বত্য জনজাতির আর্থিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। অর্থের অভাবেই হোক অথবা সমতলের বাম নেতাদের অসূয়ার কারণেই হোক, এই কাউন্সিলের নেতৃত্বে কাঙ্খিত উন্নয়ন কখনও হয়নি। ২০০৫ সালে সুভাষ ঘিষিং ষষ্ঠ তফশিলের দাবি করতে থাকেন। এই বছর মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং গোর্খাল্যান্ড ন্যাশানাল লিবারেশন ফন্টের মধ্যে ফের মউ সাক্ষরিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল ভেঙে গোর্খা হিল কাউন্সিল গঠন। যেখানে ভুটিয়া লেপচা শেরপা তামাং, ইয়োলমো, লিম্বুরা প্রতিনিধিত্বের অধিকার পাবে, সামগ্রিক ভাবে পার্বত্য জনজাতির আর্থসামাজিক উন্নতি হবে, জমির অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। বাস্তবে বছরের পর বছর নখদন্তহীন হয়েই থেকেছে হিল কাউন্সিল।

আরও পড়ুন- কেন্দ্রে কার্নিভাল আর প্রান্তে মৃত্যুমিছিল! নেতারা আর কবে দায়বদ্ধ হবেন? 

দার্জিলিংবাসীর দাবিকে চিরকাল শাসকদলের নেতামন্ত্রীরা হয় ছেলেখেলা বলে ভেবেছে অথবা দেশদ্রোহের তকমা দিয়েছে শাসকদল। সময় এলে উপর্যপুরি ব্যবহারও করেছে। ২০০৯ সালে নির্বাচনের আগে বিজেপি বলেছিল তারা গোর্খাল্য়ান্ডের দাবিকে সমর্থন করে। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থনেই বিজেপি প্রার্থী যশোবন্ত সিং লোকসভায় যান। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটেও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা পার্বত্য পরিষদের তিনটি আসনে জয়ী হয়। 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের তেজ পাহাড়বাসীর দাবিদাওয়া বিলক্ষণ জানতেন। সেই কারণেই তড়িঘড়ি জিটিএ চুক্তি সাক্ষর করেন তিনি। চুক্তি অনুযায়ী, রাজ্য সরকারের ৫৯টি দফতর জিটিএ-কে হস্তান্তর করার কথা ছিল। ২০১৭ সালে বিনয় তামাঙ্গরা অভিযোগ করেন, এ যাবৎ ৩৩টি দফতর তাঁদের হাতে পুরোপুরি দেওয়া হয়েছে। পূর্ত দফতর, তথ্য-সংস্কৃতি, দমকল ও জরুরি পরিষেবা, ভূমি সংস্কার, খাদ্য সরবরাহও পুরোপুরি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোট ও উন্নয়ন বোর্ড গড়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়ার কথাও রাখা হয়নি।

যে কোনো রাজনীতি উৎসুক দার্জিলিংয়ে গেলেই বুঝবেন, পাহাড়ে তৃণমূলের কোনো দাপট নেই। জিটিএ চিফ এগজিকিউটিভ অনীত থাপার দল ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার প্রার্থীকে সমর্থন করেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে শাসক দল। এদিকে হামরো পার্টি আর গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা অনীত থাপাকে শাসকের মুখপাত্র দাগিয়ে গোর্খাল্যান্ডের দাবি তুলে যাচ্ছেন আজও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাহাড় হাসছে স্লোগান স্রেফ কাগুজে কথা হয়েই রয়ে গিয়েছে।

এই দড়ি টানাটানিতে সবচেয়ে বেশি অপর, সবচেয়ে বেশি বিপন্ন, বিপর্যস্ত জীবন কাটায় দার্জিলিংয়ের সাধারণ মানুষ। অপেক্ষা করে আরেকটা বড় বিপর্যয়ের। বর্ষার নিঃসঙ্গ দিনগুলিতে অবসাদে ভুগতে ভুগতে খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়ায়, ভাবে, আত্মহত্যা নাকি ঘুমের মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বেঘোরে প্রাণ যাওয়া, কোন মৃত্যুটা অপেক্ষাকৃত কম বেদনার?

(লেখাটি একই সঙ্গে দ্য ওয়ার-এও প্রকাশিত হয়েছে।)  

More Articles