মৃণালের অঞ্জন অঞ্জনের মৃণাল
Mrinal Sen: এই উদ্দীপনায় ভরা মনই শুধুমাত্র ‘একটি ক্যামেরা’ হাতে কী আশ্চর্য উপায়ে বাঙালির সিনেমাকে আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় পৌঁছে দিয়েছিলেন! জন্ম দিয়েছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের নতুন এক ধারার।
সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে অঞ্জন দত্তের ছবি ‘চালচিত্র এখন’। ওটিটি-র দৌলতে ইতিমধ্যে অনেকেই দেখে ফেলেছেন ছবিটি। দর্শকমহলে বেশ সমাদৃতও হয়েছে ছবিটি। সোশ্যাল মিডিয়াতেও শুরু হয়েছে হইচই। চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনকে নিয়ে ছবি বানিয়েছেন অঞ্জন দত্ত। শ্রদ্ধাস্পদেষুর প্রতি এক উত্তরসূরীর ট্রিবিউট। না, এটুকু দিয়ে ছবিটিকে ধরতে গেলে বোধহয় ভুল হবে। মজার ব্যাপার ছবিটি দর্শককে রীতিমত ফাঁপরে ফেলে দিয়েছে। ছবিটিকে সরাসরি গলাধঃকরণ করা সহজ নয় যেমন, তেমনই আবার সহজও। এ ছবিতে অঞ্জন দত্ত খোদ মৃণাল। কতটা মৃণাল সেন হয়ে উঠতে পারলেন শিষ্য অঞ্জন? শুধুই কি গুরুদক্ষিণা হয়ে থেমে গেল এ ছবি? নাকি তার চেয়ে বেশি কিছু অন্য কোথাও পৌঁছে দিল ‘চালচিত্র এখন’।
এ কথা বলতেই হবে, এ ছবি একান্তভাবেই অঞ্জন দত্তের ছবি। আর কারওর নয়। আর তা কেবলমাত্র অঞ্জন দত্তই বানাতে পারেন এবং তাঁর সেই অধিকার আছে। কারণ মৃণাল সেনের আবিষ্কার অঞ্জন দত্ত নামক এক অসাধারণ অভিনেতা। অঞ্জন একটা বয়স অবধি দিশেহারা জীবন যাপন করতেন। তিনি অনেক কিছুই করতে চাইতেন এবং পারতেনও। কিন্তু শেষ অবধি যেন কিছুই হয়ে উঠছিলেন না। মৃণাল সেনের সংর্স্পশে এসে নিজের নিয়তির দেখা পেয়েছিলেন। অথবা বলা যায় মৃণাল সেনই সেই মোলাকাত সম্ভব করে দিয়েছিলেন। তা-ই বলাই যায়, এই ছবি তাই অঞ্জন দত্তের পিতৃতর্পণসম।
আরও পড়ুন:‘মৃণাল সেনের চোখে দেখেছি আমার শহর’: কথাবার্তায় অঞ্জন দত্ত
বাংলার দর্শক হয়তো এমন একটি ছবির জন্য প্রস্তুত ছিল না। শতবর্ষের শ্রদ্ধা জানানোর যে সব উপায় আজকের বাঙালির জানা আছে, তার মধ্যে অঞ্জনের এই ছবি পড়ে না বা খাপ খায় না। ‘চালচিত্র এখন’ যে ধরনের ছবি তা, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের দুনিয়া তা কখনওই বানাতে চাইবে না। তারা চাইবে মৃণাল সেনকে মিথের পর্যায়ে নিয়ে যেতে। অঞ্জন দত্ত কিন্তু সেই চেষ্টাটাই করেননি। বরং তিনি তাঁর দেখা-চেনা-জানা যে ‘মৃণালদা’, তাঁকে নিজের ছবিতে তুলে ধরতে চেয়েছেন। অঞ্জন প্রথম যৌবনে যেভাবে মৃণাল সেনকে দেখেছিলেন, তাঁর হাঁটাচলা, কথা বলার ধরন, পোশাক পরিচ্ছদ, চশমা ইত্যাদি নিয়ে ঠিক রক্তমাংসের সেই মানুষটাকেই দর্শককের সামনে এনে দিয়েছেন। এটা করতে গিয়ে অঞ্জনকে নিজেই হয়ে উঠতে হয়েছে। এ ছাড়া উপায় ছিল না আর।
এখন দর্শকমহলে প্রশ্ন উঠেছে, অঞ্জন দত্তকে তো মৃণাল সেনের মতো দেখতে নয়! সেক্ষেত্রে মৃণাল সেন হিসেবে অঞ্জন দত্ত নিজেকে ঠিক কতটা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন? আমরা যাঁরা মৃণালদাকে সামনে থেকে দেখেছি, কথা বলেছি, স্টুডিয়োতে বা বিভিন্ন জায়গায় চলে-ফিরে বেড়াতে দেখেছি, তাঁদের কাছে কিন্তু অঞ্জন দত্তকে মৃণাল সেন হিসেবে মেনে নিতে কোনও অসুবিধাই হয়নি। এর কারণ অঞ্জন দত্তের অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতা। যেহেতু তিনি খুব কাছ থেকে মৃণাল সেনকে দিনের পর দিন প্রত্যক্ষ করেছেন, ফলে সামান্য একটা পরচুলা মাথায় চাপিয়ে, মৃণাল সেনের ভাবভঙ্গি হুবহু পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে তাঁর কোনও অসুবিধাই হয়নি। এই ভাবভঙ্গি এতটাই যথাযথ হয়েছে যে দুজনের মুখের অমিলের প্রশ্ন দর্শকের মাথাতেই আসেনি।
তাঁরা মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন, কীভাবে একজন আন্তর্জাতিক মানের বাঙালি চলচ্চিত্রকার পাঞ্জাবি-পাজামা গায়ে নিজের জীবন ও পরিবারকে বাজি রেখে ছবি করে চলেছেন। করতে করতে তিনি নিজে যেমন ছবিগুলিকে আবিষ্কার করে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন, তেমনই তাঁর চারপাশের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করছেন। নিজের ছবির অভিনেতা ও কারিগরদের তো বটেই, এমনকি বয়সে ছোট চলচ্চিত্রকারদের কাছে জানতে চাইতেন কী ছবি তাঁরা করছে। যেন ছবি না করলে বেঁচে থাকারই কোনও মানে নেই। সবাইকে উদ্দীপ্ত করছেন পথ চলতে চলতে। এই উদ্দীপনায় ভরা মনই শুধুমাত্র ‘একটি ক্যামেরা’ হাতে কী আশ্চর্য উপায়ে বাঙালির সিনেমাকে আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় পৌঁছে দিয়েছিলেন! জন্ম দিয়েছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের নতুন এক ধারার। যে ধারা ভারত জুড়ে যেমন নানা চলচ্চিত্রকারের, নানা চলচ্চিত্রের জন্ম দিয়েছিল, তেমনই নানা দিকপাল অভিনেতারাও ভারতীয় সিনেমার পর্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এঁদেরই একজন অঞ্জন দত্ত।
আরও পড়ুন: সত্যজিৎ, ঋত্বিক নন; মধ্যবিত্ত সমাজকে থাপ্পড় কষিয়েছিলেন মৃণাল সেনই!
তাই ‘চালচিত্র এখন’ শুধুমাত্র অঞ্জন দত্তর পিতৃতর্পণ নয়। এ ছবি সমস্ত বাঙালি চলচ্চিত্রকারের কাছেও এমন একটি দলিল যা জানিয়ে দেয়, চলচ্চিত্রের জন্য একজন নির্মাতা, তাঁর কারিগরের দল ও অভিনেতাদের ঠিক কতটা ঐকান্তিক হতে হয়। আর মৃণাল সেনের ভূমিকায় এই অভিনয় অভিনেতা অঞ্জন দত্তকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।