প্রাচীন এই মন্দিরের আদলেই তৈরি হয় সংসদ ভবন! ভারতের অজানা ইতিহাস, নাকি স্রেফ মিথ?
Chausath Yogini Temple Mitaoli : মূল ওই গোলাকার মঞ্চেই সেই সময় হতো পুজো পার্বণ। সেইসঙ্গে হতো নাচও। এখন অবশ্য সেসবের প্রতিধ্বনিও মুছে গিয়েছে।
চম্বল নদীর নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। সেই চম্বল থেকে প্রায় ৪৭ মাইল দূরে পাহাড় আর এবড়োখেবড়ো পাথরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে একটা মন্দির। পাথরের তৈরি সেই প্রস্তরসৌধের ওপর রোদের আলো ঝিলিক মেরে যায়। কিন্তু অন্যান্য মন্দিরের মতো নয় এটি। প্রাচীনত্বের ছোঁয়া যেন প্রতিটি ধাপে, ভাঙা ইটের খাঁজে লেগে রয়েছে। আলো আর ছায়ার এই লুকোচুরির মধ্যেই আপনাকে স্বাগত জানিয়েছে মধ্যপ্রদেশের মিতাউলি জায়গাটি। আর সেখানেই রয়েছে এই অদ্ভুত, রহস্য আর মিথে ঢাকা এই শিব মন্দির। তবে ইতিহাস স্রেফ শিব মন্দির হিসেবে একে মনে রাখেনি। বরং স্থানীয়দের কাছে এর পরিচয় ‘যোগিনী মন্দির’ হিসেবেই। আরও ভালো করে বললে, চউসাট যোগিনী মন্দির।
গোয়ালিয়রের কাছেই এই মিতাউলি গ্রাম। আর গ্রামেরই এক পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই যোগিনী মন্দির। একটু ভেতরে ঢুকলে সমস্ত ছবিটা আপনার নজর কাড়তে বাধ্য। ঠিক মধ্যিখানে রয়েছে গোলাকার একটি মঞ্চ। আদতে সেটাই মন্দির। থামের আড়াল আবডালে লুকোচুরি খেলতে খেলতে পৌঁছে যাবেন মূল জায়গায়। ছোট্ট একটি দরজা, আর তার ভেতরেই রয়েছে শিবলিঙ্গ। ইতিহাস বলে, ১১-শ শতকের আশেপাশে কচ্ছপাঘাটার মহারাজ দেবপাল এটি তৈরি করেছিলেন। মূল ওই গোলাকার মঞ্চেই সেই সময় হতো পুজো পার্বণ। সেইসঙ্গে হতো নাচও। এখন অবশ্য সেসবের প্রতিধ্বনিও মুছে গিয়েছে।
এসব ভাঙা কাহিনির পাশেই রয়েছে আরও বিস্ময়। কেবল গোলাকার মঞ্চ নয়, গোটা মন্দিরটিরই আকৃতি বৃত্তাকার। ভেতরে শিব মন্দির ঘিরে রয়েছে ৬৪টি কক্ষ। আর প্রতিটি কক্ষে একজন করে পাথরে খোদাই করা নারীমূর্তি। শাস্ত্রমতে, এঁরাই হলেন যোগিনী। মোট ৬৪ জন যোগিনী ঘিরে রয়েছে পুরো মন্দিরটিকে। সেজন্যই এর নাম চউসাট যোগিনী মন্দির (হিন্দিতে চউসাট মানে চৌষট্টি বা ৬৪)। ঐতিহাসিকরা বলেন, ভারতের নানা প্রান্তে এরকম বেশকিছু যোগিনী মন্দির তৈরি হয়েছিল। মিতাউলির এই মন্দিরটি এখনও ধুলোয় মিশে যায়নি। তাই ঐতিহাসিকদের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
কিন্তু যোগিনী মূর্তি কেন? এর জন্য যেতে হবে প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও পৌরাণিক কথায়। আজকে দিল্লি কিংবা মুম্বইয়ের মতো জায়গাতেও মেয়েরা নিজেদের সুরক্ষিত মনে করেন না। গার্হস্থ্য হিংসা তো আছেই, সেইসঙ্গে রয়েছে ধর্ষণ, খুন। নির্ভয়া থেকে কামদুনি, কিংবা হালের শ্রদ্ধা ওয়ালকরের নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমাদের আতঙ্কিত করেছে। কিন্তু একটা সময় এই মেয়েদেরই সম্মান ছিল অনেকটা উঁচুতে। ইতিহাস সাক্ষী থেকে সীতা, দ্রৌপদী কিংবা গার্গীদের কাহিনির। যোগিনী মন্দির আসলে সেই নারীদের, নারীশক্তিকেই সম্মান জানায়। শিবলিঙ্গ থাকলেও মূলত যোগিনীদের মূর্তি পূজিত হয়। আর মন্দিরের ছাদ বলেও কিছু নেই, পুরোটাই খোলা আকাশের নীচে। প্রকৃতিকে আহ্বান করাও তো একরকমের সাধনাই।
হিন্দু পুরাণ বলে, যে নারীরা যোগশাস্ত্রের অধ্যায়ন করতেন, চর্চা করতেন, তাঁরাই যোগিনী। নারীরা আসলে মুক্ত বিহঙ্গ, প্রকৃতির রূপ ধরা দেয় তাঁদের আত্মায়, শরীরে। সেই কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা এই মন্দির। বেশিরভাগেরই আকৃতি এমন গোলাকার হয়। তবে স্থাপত্যের দিক দিয়েও মিতাউলির এই চউসাট যোগিনী মন্দির অনন্য। গোটা মন্দিরে অজস্র ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে, যাতে বৃষ্টি হলে জল না দাঁড়ায়। সেইসঙ্গে বৃত্তাকার গঠনের জন্য ভূমিকম্পের হাত থেকেও রক্ষা পায় এই মন্দিরটি। তবে এসবের বাইরেও আরও একটা কারণে বিখ্যাত এই যোগিনী মন্দির। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের আধুনিক ইতিহাস আর পার্লামেন্ট বা সংসদ ভবন।
এখন ভারতের নতুন সংসদ ভবন তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পুরনো ঐতিহাসিক ভবনটির কথা এত সহজে মুছে যাওয়ার নয়। ব্রিটিশদের হাতে তৈরি এই সংসদেই একের পর এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। একটা সময় দেখেছে নাশকতামূলক হামলাও। কিন্তু একটু ভাল করে পুরনো সংসদ ভবনের চেহারাটার কথা ভাবুন। তারপর দেখুন মিতাউলির এই চউসাট যোগিনী মন্দিরের দিকে। বেশ অনেকটা মিল পাচ্ছেন না? সেই গোলাকার স্থাপত্য, ভেতরে মূল মন্দির... তবে সংসদ ভবনকে ঘিরে রেখেছে ১৪৪টি স্তম্ভ। এক্ষেত্রে রয়েছে ৬৪ জন যোগিনীর মূর্তি। ঐতিহাসিকদের একাংশের অনুমান, এই মন্দির দেখেই নাকি সংসদ ভবন তৈরির নকশা করেছিলেন এডউইন লিউটিয়েন্স ও হারবার্ট বেকার।
১৯২০-র দশকে ব্রিটিশ ভারতের দিল্লিতে তৈরি হয় সংসদ ভবন। তারপর থেকেই একটু একটু করে সামনে আসে এই তথ্য। সত্যিই কি মধ্যপ্রদেশের এই যোগিনী মন্দিরকে দেখেই নকশা করেছিলেন সংসদ ভবনের স্থপতিরা? নাকি গোটাটাই মিথ? এর কোনও প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায়নি সেভাবে। কিন্তু এতটা গঠনগত সাদৃশ্য কি নেহাতই কাকতালীয়! তবে এই মিথ, রহস্য আর ইতিহাসের ওপরই এসে পড়ে সূর্যাস্তের আলো। যোগিনী মন্দিরেও প্রদীপ জ্বলে ওঠে নিভৃতে। যারা আসেন, তাঁরা নাকি অদ্ভুত একটা শক্তি অনুভব করেন এই মন্দিরে। এভাবেই সবকিছু মিলিয়ে ঠাই পায় যোগিনী মন্দির। নিছক সামান্য মন্দির নয়, নারীশক্তির উদযাপন।