ইন্দিরা হত্যা: ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন?

Indira Gandhi Assassination: বেলা প্রায় আড়াইটার সময় ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তবে তখনই সরকারিভাবে মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়নি।

১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। দিল্লির সকালটা ছিল একেবারে সাধারণ দিনের মতো। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রতিদিনের মতোই অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব কিছু বদলে যায়। নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ হারান ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরার মৃত্যুদিনে ঠিক কী হয়েছিল?

ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর একমাত্র মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তিনি রাজনীতির পরিবেশে বড় হয়েছেন। বাবার কাছ থেকেই শিখেছিলেন দেশ চালানোর শিক্ষা। স্বাধীনতার সময় থেকেই কংগ্রেস দলে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। তখন দেশ নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল যেমন খারাপ অর্থনীতি, দারিদ্র্যতা পাশাপাশি চারদিকে অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ। এই সব পরিস্থিতি তিনি শক্ত হাতে সামলেছেন। তাঁর নেতৃত্বে দেশে শুরু হয় গ্রিন রেভলিউশন, যার ফলে খাদ্য উৎপাদন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। তিনি ব্যাংকগুলিকে সরকারি করেন, এরফলে সাধারণ মানুষও সহজে ঋণ ও ব্যাংকের সুবিধা পায়।

আরও পড়ুন

শান্তিনিকেতন থেকে তিহারের জেল! ইন্দিরা এবং গায়ত্রী দেবীর সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে

১৯৮০-র দশক থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়। পঞ্জাবে আলাদা ‘খালিস্তান’ রাষ্ট্রের দাবি ক্রমশ জোরদার হচ্ছিল। প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় সরকার শিখ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৮৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। এই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। এর উদ্দেশ্য ছিল স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নেওয়া শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎখাত করা। নির্দেশ মতো সেনারা মন্দির চত্বরে প্রবেশ করে। বহু মানুষ নিহত হন, স্বর্ণমন্দিরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনার পর শিখ সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়। রক্তক্ষয়ী এই অভিযানে সরকারি হিসাবে ৮৩ জন সেনা নিহত হন, আহত হন প্রায় ২৫০ জন। অন্যদিকে, ৪৯২ জন শিখ যোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান। তবে বিভিন্ন সূত্রের দাবি, হতাহতের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

এই ঘটনার ঠিক পাঁচ মাস পর ৩১ অক্টোবর সকাল ৯টার কিছুক্ষণ পর ইন্দিরা গান্ধী নিজের বাসভবন ১, সাফদরজং রোড থেকে বের হচ্ছিলেন। সেদিন সকালে ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভের-কে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। অফিসে যাওয়ার পথে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুই শিখ দেহরক্ষী— বেয়ান্ত সিং ও সৎবন্ত সিং। ইন্দিরা হাসিমুখে তাঁদের দিকে এগিয়ে যান। ঠিক তখনই বেয়ান্ত সিং রিভলভার থেকে তিনটি গুলি চালান। সঙ্গে সঙ্গে সৎবন্ত সিংও আরও ২৫ রাউন্ড গুলি করেন, ইন্দিরা গান্ধী মাটিতে পড়ে যান। তাঁকে দ্রুত নয়াদিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস (AIIMS)-এ নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে যান— তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়। চিকিৎসকেরা পরে জানান, ইন্দিরার শরীরে ২৮টিরও বেশি গুলির চিহ্ন ছিল।

আরও পড়ুন

কী ভাবে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী?

বেলা প্রায় আড়াইটার সময় ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তবে তখনই সরকারিভাবে মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়নি। সন্ধ্যে ছ'টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় তাঁর মৃত্যুর সংবাদ। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশজুড়ে এর প্রভাব পড়ে। দিল্লি, কানপুর, পাটনা-সহ বহু শহরে ছড়িয়ে পড়ে শিখ-বিরোধী দাঙ্গা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ২,৭৩৩। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যা আরও বেশি। এরপর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধী।

ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর নেতৃত্ব, নীতি ও সিদ্ধান্ত নিয়ে আজও নানা মত রয়েছে। কেউ তাঁকে শক্তিশালী শাসক হিসেবে দেখেন, কেউ বা তাঁর সিদ্ধান্তগুলিকে বিতর্কিত মনে করেন। তবে এটা সত্য, ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪ ভারতের ইতিহাসে এক গভীর ছাপ রয়ে গিয়েছে।

More Articles